book review

‘না-লোক’এর চোখে লোকজীবন

নাগরিক আধুনিকতায় পরিপুষ্ট আমরা অজানা এক দেমাকে ‘সেই সাপ জ্যান্ত/ গোটা দুই আন্ তো’ আওড়ে ‘লোকসংস্কৃতি’ খুঁজে বেড়াচ্ছি।

Advertisement
অভীক মজুমদার
শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০২১ ০৫:০৪

লোকায়তের আত্মকথা
দীপঙ্কর ঘোষ
৭৫০.০০
দে’জ

লোক-লোকায়ত-লোকসংস্কৃতি-লোকবৃত্ত, এই সব শব্দ নিয়ে বিমুগ্ধতা-বিহ্বলতা কিংবা বিতর্ক-বিসংবাদ কিছু কম হয়নি। কে বা কোনটা আগমার্কা ‘লোক’ আর কে-ই বা ‘ফোক-ফেক-ভেক’, সে নিয়ে ঝড়তুফান যথেষ্ট! তার মধ্যে নীরবে দু’-একটি মূল্যবান কাজ করে চলেছেন কেউ কেউ। দীপঙ্কর ঘোষ তাঁদের এক জন। তাঁর সাম্প্রতিক কাজ লোকায়তের আত্মকথা। নামেই জিজ্ঞাসু হয়ে উঠি। বইটির পরিকল্পনা দেখে চমৎকৃত হই।

Advertisement

বইটিতে রয়েছে ১০১ জন লোকায়ত ভুবনমাঝির সাক্ষাৎকার। ২০০০ সালের ৭ মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি, অর্থাৎ প্রায় কুড়ি-কুড়ি বছরের শ্রমসাধ্য ফসল এটি। ন্যূনাধিক ৬৩০ পৃষ্ঠার এই বইয়ে পাওয়া যাবে লোকসঙ্গীত বিষয়ে ২৮ জন, লোকনৃত্য বিষয়ক ১০ জন, লোকনাট্য বিষয়ক ১২ জন, লোকশিল্প বিষয়ক ২৩ জন এবং লোকজীবন সংশ্লিষ্ট বেশ কিছু মানুষের স্ব-কথন। সংলাপে যাঁরা অংশগ্রহণ করেছেন, তাঁদের বেশ কয়েক জনের নাম রীতিমতো সচকিত করে দেবে। সনাতন সলাবত মাহাতো, কালাচাঁদ দরবেশ, জুলফিক্কার আনসারি, সিন্ধুবালা দেবী, সুবলদাস বৈরাগ্য, বলরাম হাজরা, সুবেদ আলি শেখ প্রমুখ। গ্রন্থভুক্ত হয়েছে লোকশিল্প হিসেবে শীতলপাটি, দশাবতার তাস, মুখোশ শিল্প, এমনকি গয়নাবড়ির প্রসঙ্গ এবং আলোচনাও। পাশাপাশি, আট জন প্রতিনিধি কথা বলেছেন
স্ব-স্ব জনজাতি এবং তৎসংক্রান্ত জীবনচর্যা বিষয়ে। তার মধ্যে লেপচা, রাভা, টোটো বা মেচ-এর অন্তর্ভুক্তি প্রশংসনীয়। শেষাংশে বাংলার লোকায়ত-চর্চার অগ্রগণ্য কয়েক জন স্বজনের সঙ্গেও কথা বলেছেন দীপঙ্কর ঘোষ। তারাপদ সাঁতরা থেকে ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে সেই তালিকায় উজ্জ্বল হয়ে আছেন। পরিকল্পনাটি অভিনব। ত্রিমুখী অভিঘাতে গ্রন্থটি এগোয়। প্রথমত, বহু অচেনা মৃত্তিকালগ্ন শিল্পরূপ এবং শিল্পীর হালহদিস দেয়, দ্বিতীয় ক্ষেত্রে উন্মোচন করে বহমান সৃষ্টিশীলতার বিপুল প্রবাহ, আর শেষে তৃতীয় নেত্রের মতো পাঠককে সন্ধান দেয় আয়তনবান এক জীবন্ত পরিসরের হদিস, যার প্রেক্ষিতে সংস্কৃতির আত্মরূপ তথা বিশ্বরূপের বোধ জাগ্রত করা প্রয়োজন। ঐতিহাসিকতা, সমকাল যেমন তার শরিক, আমাদের ‘আধুনিকতা’ তথা ‘নিরালম্ব’, ‘বায়ুভুক’, ‘ত্রিশঙ্কু’ প্রাত্যহিকতার সঙ্গে তার সংলাপও জরুরি।

বইটির ‘কথাসূত্র’ অংশে দীপঙ্কর ঘোষ সংক্ষিপ্ত রূপরেখায় তাঁর তন্নিষ্ঠ অভিযাত্রার বিবরণ দিয়েছেন। বাংলার জেলায় জেলায় প্রান্তিক-দুর্গম জনপদে তাঁর অভিজ্ঞতাগুলি মনে রাখার মতো। কত শ্রমে এবং প্রেমে তিনি অনাবিল অনুসন্ধিৎসায় পৌঁছে গিয়েছেন শিল্পীজীবনের অন্তঃপুরে, তার সাক্ষ্য দেবে গ্রন্থের পৃষ্ঠাসমূহ। গ্রন্থে বেশ কিছু রঙিন আলোকচিত্র সন্নিবিষ্ট হয়েছে।

কত অচেনা প্রতিভাবান শিল্পী আর শিল্পের কথকতা, কত আশ্চর্য অভিজ্ঞতা আর শিল্পলগ্ন ইতিহাস, কত অবহেলা-স্বীকৃতি নিরবচ্ছিন্ন সাধনা, আকাঁড়া বাস্তবের হালচাল দু’মলাটের মধ্যে টগবগ করে ফুটছে। কয়েক জন কিংবদন্তি আজ প্রয়াত।

তৎসত্ত্বেও কিংবা হয়তো সেই জন্যেই বিনীত সুরে দু’-একটি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাইব। বইয়ে দীপঙ্কর ঘোষ নামটি মলাটে ছাপা রয়েছে যেন তিনি এর একক স্রষ্টা। সঙ্কলন গবেষণা পরিকল্পনা— এই সব শব্দ হয়তো ব্যবহার করা যেত। প্রশ্নোত্তরের ভাষা-ব্যবহারের চলিত সাম্প্রতিক রূপটি দেখে সন্দেহ হয়, নানা অঞ্চলের বহু বৈচিত্র এবং বহুস্বরিক ভঙ্গিটি সচেতন ভাবেই ‘মার্জনা’ করা হয়েছে। দীপঙ্কর ঘোষই তো আমাদের মনে করিয়ে দেন ‘লোক’ ‘লোকায়ত’ বিষয়টি কোনও একঢালা বাক্স নয়, তাকে যে কোনও একক মাত্রায় ‘নির্মাণ’ করার বদভ্যাসটি বর্জনীয়। মনে রাখতে হবে, দেশজ গান, পালা বা ছড়া সংগ্রহ এবং প্রকাশ করার উদ্যোগে বহু উদ্‌যাপিত মনীষী ‘গ্রাম্য’ ‘অশ্লীল’ শব্দ ‘পরিশীলন’-এ সচেষ্ট হয়েছিলেন। কাজটা মোটেই সমর্থনযোগ্য নয়। ঠাকুরমার ঝুলি-র প্রথম সংস্করণ আর দ্বিতীয় সংস্করণে এত পার্থক্য তৈরি হয় একই প্রণোদনায়। প্রকৃতপক্ষে শহুরে বাবু তথা পাশ্চাত্য প্রযোজিত দেশীয় ‘দিকু’দের ‘লোক-চর্চা’ বারংবার মধ্যস্থতার মৎসরী হস্তাবলেপে জর্জরিত। ‘আমাদের আধুনিকতা’ বস্তুটি প্রথম থেকেই পাশ্চাত্য তত্ত্ব আর প্রয়োগের অবিমিশ্র বিকারে লোকায়তের ভূমিজ-দেশজ-নিম্নবর্গীয় অমোঘ মাত্রাটিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা আর অবহেলা করেছে। প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে নিজেকে ‘উন্নততর’ উদ্ধারকর্তা হিসেবে প্রতীয়মান করে আত্মশ্লাঘা অনুভব করেছে। তার সঙ্গে নিজেই ‘অন্তর্ভুক্তি আর বহিষ্কার’-এর নাগরিক মধ্যবিত্ত মানদণ্ড তৈরি করেছে। অনেকটা গ্রিক দস্যু প্রোক্রাস্টেস-এর কায়দায়। ওই দস্যু, সবাই জানেন, ধৃতদের তার বানানো খাটে শোয়াত এবং বাইরে যে অংশ বেরিয়ে থাকত তাকে কেটে ফেলত!

দুশ্চিন্তা হয়, এ বইটিও সে ভাবে ব্যবহার হবে না তো! সাম্প্রতিক কালে, ‘বিদ্যায়তনিক লোকসংস্কৃতিচর্চা’ নামক এক ভয়াবহ বস্তু চালু আছে। প্রোমোশনের স্বার্থে বা মেজর-মাইনর প্রজেক্টের ‘প্রয়োজনে’ সর্বার্থেই ‘ফিল্ড-ওয়র্ক’ নির্ভর দু’-চার দিনের ‘লোকপ্রেম’ আলগোছে ‘বিশেষজ্ঞ’ প্রসব করে চলেছে। ‘বাহিরানা’র ধুলোকাদা, ‘লোকায়ত’ সম্পর্কে দীর্ঘ একাত্মতা অথবা ‘লোকায়ত’ প্রসঙ্গে জীবনচর্যার অবিচ্ছেদ্য নিরবচ্ছিন্ন মাত্রার কোনও চিহ্নই সেখানে থাকে না। পরবর্তী কালে এঁরাই, গ্লসি কাগজে, গোপ্য-গুহ্য শিল্পসাধনার নানা কিসিম সম্পর্কে অর্ধসত্য অর্ধপাচিত ‘সোয়াস থেকে বকোয়াস’ প্রকাশ করেন। দিশি বা বিলিতি ডিগ্রিও মেলে!

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ অধ্যাপকের আহ্বানে এক বার; মাত্র এক বারই, ‘হাতে-কলমে’ লোকসংস্কৃতিচর্চার শ্রেণিকক্ষে ঢুকি। দেখি এক কোণে মলিন মুখে মাটিতে বসে তিন জন পটশিল্পী গান গাইছেন। ওই তরুণ অধ্যাপক মাঝে মাঝেই তাঁদের থামিয়ে, চেয়ারে বসে, উল্টো দিকের বেঞ্চিতে বসা ছাত্রছাত্রীদের ‘ব্যাখ্যা’ শোনাচ্ছেন। উপরন্তু, উনিশ-বিশ শতকের ইউরো-আমেরিকান তাত্ত্বিকদের ‘বাণী’-সহ তুমুল হুঙ্কার! ক্ষমতা-প্রতাপ-জ্ঞানদম্ভের ত্র্যহস্পর্শে অচিরে ফ্যাকাসে মুখে পালিয়ে আসি। পরে মনে হয়, আমার অবস্থানই বা কি কম সন্দেহজনক?

গ্রন্থপাঠের সময় এই প্রশ্নটাই আমাকে পীড়িত করেছে। আমার মতো অধিকাংশ পাঠকই সাক্ষাৎকারগুলিকে ‘নিরাপদ’ দূরত্ব থেকে ‘জ্ঞানচর্চা’র উপাদান হিসেবে গ্রহণ করবেন, কোনওটিই তার জীবনলগ্ন আবেগের অবিচ্ছেদ্য অংশ কিংবা সুদূরতম ‘আত্মপরিচয়’ নয়। বাংলারই সংস্কৃতি, অথচ ঠিক ‘আমার’ নয়, কিছুতেই নয়। সমধর্মী একটি উক্তি করেছিলেন কেনিয়ার লেখক এনগুগি ওয়া থিয়ংগো তাঁর ডিকলোনাইজ়িং দ্য মাইন্ড: দ্য পলিটিক্স অব ল্যাঙ্গোয়েজ ইন আফ্রিকান লিটারেচার গ্রন্থে। একটা দেশ, একটা সময়কাল, অন্য দিকে বহুত্ববাদী ‘সংস্কৃতি’, বহুবিচিত্র আত্মপরিচয়— কিন্তু তার কোনওটিই অন্তর্গত রক্তের অংশীদার নয়— এ আমি কেমন আমি? শহুরে বাবু সমাজের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত লোকায়তচর্চা প্রসঙ্গে মনে পড়ে দুদ্দু শাহের প্রশ্ন— “কাগজে চিনি শব্দ লেখা যায়/ সেই কাগজ চাটিলে কি মুখ মিষ্ট হয়?”

সত্যিই নাগরিক আধুনিকতায় পরিপুষ্ট আমরা অজানা এক দেমাকে ‘সেই সাপ জ্যান্ত/ গোটা দুই আন্ তো’ আওড়ে ‘লোকসংস্কৃতি’ খুঁজে বেড়াচ্ছি। ওটা যেন একটা কাটাছেঁড়ার বিষয়মাত্র। নিজের শরীরে নিজের অস্ত্রোপচার নয়। মনে হয়, এই গ্রন্থের অর্থবহ পরিপূরক হয়ে উঠতে পারে আমরা যারা ‘নিশ্ছিদ্র’ ‘না-লোক’ তাদের ‘না-লোকের আত্মকথা’। সেই ‘আমরা-ওরা’র সমন্বয়ে-টানাপড়েনে-সংশ্লেষে হয়তো বাঁচার স্পষ্ট তলদেশ দেখা দেবে।

বহু বছর আগে সুভাষ মুখোপাধ্যায় মনে করিয়ে দিয়েছিলেন কবিয়াল রমেশ শীলের গানের দু’টি কলি— “নাতি রে আমার,/ জলের ধারেতে থাকো/ জানো না সাঁতার।” কী ছিল এই উচ্চারণে? শ্লেষ? হাহাকার? সন্তাপ?

দীপঙ্কর ঘোষ তাঁর গ্রন্থের মাধ্যমে এত সব প্রশ্নের সামনে দাঁড় করালেন। তাঁকে ধন্যবাদ।

আরও পড়ুন
Advertisement