Smaranjit Chakraborty

বয়ে যায় এক ঝলক ‘কবিতা-বাতাস’

যুগযুগান্তর ধরেই কোনও কোনও কবি ভিড়ের হৃদয়কে (পড়তে হবে, সাধারণ পাঠকের মনকে) স্পর্শ করতে চেয়েছেন। জনমানসে ঠাঁই পেয়েছেন। স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর সারাজীবনের মতো বইটি তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।

Advertisement
প্রচেত গুপ্ত
শেষ আপডেট: ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১ ০৬:৪৮

সারাজীবনের মতো

স্মরণজিৎ চক্রবর্তী

Advertisement

২৫০.০০

বুক ফার্ম

কবিতা কেমন হবে?

আধুনিক বাংলা কবিতার দীর্ঘ ভাঙা পথের রাঙা ধুলোয় হেঁটে যাওয়ার পরও কেউ কেউ মনে করেন, কবিতা হবে দুর্বোধ্য, দুরূহ, দুর্গম। কবিতা অর্থ বোঝানোর দায় রাখে না, পাঠকেরই কাজ তার অনুভূতিকে স্পর্শ করা। তাকে কাছে পাওয়ার পথ একটাই, অধ্যবসায়। জনমানসে তার মন নেই, সে এক দল নিবিষ্ট পাঠক তৈরি করতে চায়। এখনও কারও বিশ্বাস, কবিতা অনেকের বোধগম্য হলে নাকি সে তার ‘কৌলীন্য’ হারায়‌‌‌। সুতরাং কবিতা দূরে থাকো। দেখো, যে কেউ যেন তোমায় ভালো না বেসে ফেলে।

জীবনানন্দ দাশ অবশ্য একটু অন্য ভাবে ভেবেছিলেন। তঁার ‘কবিতার কথা’য় লিখেছিলেন, ‘ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তন করতে হবে।’

‘ভিড়ের হৃদয় পরিবর্তন’ করা গিয়েছে কি না, বলতে পারবেন কাব্য গবেষকরা। তবে ‘দুরূহ, দুর্গম’ বাংলা আধুনিক কবিতা তার পাঠক বাড়িয়েছে, না পাঠককে দূরে সরিয়েছে, তা নিয়ে আলোচনা চলবে চিরকাল। সে চলুক। কিন্তু যুগযুগান্তর ধরেই কোনও কোনও কবি ভিড়ের হৃদয়কে (পড়তে হবে, সাধারণ পাঠকের মনকে) স্পর্শ করতে চেয়েছেন। জনমানসে ঠাঁই পেয়েছেন। স্মরণজিৎ চক্রবর্তীর সারাজীবনের মতো বইটি তার সাম্প্রতিকতম উদাহরণ। অতিমারির ভয়ঙ্কর কালে প্রকাশিত এই বইটি শেষ করার পর মনে হয়, এক ঝলক টাটকা ‘কবিতা-বাতাস’ বয়ে গেল। যে বাতাস অরণ্যের ফিসফিসানির মতো আপন, ঝর্নার জলের মতো পরিচিত‌, চলে যাওয়া শেষ ট্রামের মতো মন কেমন করা। স্মরণজিৎ তাঁর গদ্যের মতোই সহজ ভাবে কবিতাকে এঁকেছেন। রোম্যান্টিক সৌন্দর্যে সিক্ত করেছেন। বাক্য, শব্দ বা ভঙ্গিকে বানানো কাঠিন্যে কখনও ভারাক্রান্ত করেননি। জীবনের সুখ, দুঃখ, মন কেমন, অভিমান, বিস্ময়ের কথা বলতে গিয়ে পাশে অভিধান নিয়ে বসেননি। কাব্যরসের হদিস দিতে দিয়ে কোথাও উচ্চকিত হননি, কবিতার পর কবিতায় কাব্যরস বয়ে চলেছে নিঃশব্দ ধারায়।

এই বইয়ের অধিকাংশ কবিতাই প্রেমের কথা বলেছে। সেই ‘প্রেম’ যে সব সময় কোনও নারীর সঙ্গে, এমনটা নয়। সেই ‘প্রেম’ কখনও মন কেমনের সঙ্গে। “যা পাইনি/‌ সেইসব টুকে রাখে মন/‌ আসোনি, বাসোনি আর/‌ কার কাছে গিয়েছো কখন।” কখনও শহর, শহরতলি, মেঠো পথ বা পাহাড়তলির সঙ্গে তার ‘প্রেম’। “সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল যেন কোনও পাহাড়ি বিকেল/‌ যেন কুয়াশায় ঢাকা কাঠের স্টেশনে ছোট রেল।” কখনও ‘প্রেম’ নিজের ভিতরের হাহাকারের সঙ্গে। “একটা জীবন লুকিয়ে রাখে/‌ চক্রব্যূহের হাজার ক্ষত/‌ নিজের কথা বলব কাকে? শান্ত থাকি ট্রামের মত।”

আর নারী? কবিতা পর কবিতা জুড়ে নারী রয়েছে। রয়েছে প্রেমে, প্রেম ভাঙায়, প্রেম না হওয়ায়। এই বিষয়ে স্মরণজিৎ সর্বদাই আন্তরিক। “মধ্যরাতের ট্রেনে তোমার কথা এনে/ মনকে না হয় উলটোপালটা করি” বা “এই মৃত্যুর আবহে জানি তুমি দূরেই থাকো/ তবু কেন যে মনে হয় এত কাছে।”

স্মরণজিতের বইটি প্রকাশিত হয়েছে করোনা অতিমারিতে। চার দিকে শুধু দুঃসংবাদ, শুধু স্বজন হারানোর, অসুস্থতার অথবা জীবিকাচ্যুত হওয়ার বিষণ্ণ ধারাবিবরণী। মানুষ যখন ভীত, বিপর্যস্ত। এক জন কবির এই সময় করণীয় কী হতে পারে? কোন ভরসা নিয়ে মানুষের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে পারেন তিনি? পারেন কবিতা দিয়েই‌। বইটি সেই পথ খানিকটা দেখিয়ে দিল। মন খারাপও কি তিনি করেননি? করেছেন বইকি। তবে তা দুঃসময়ের নয়, কবিতার। তবে কবি কি দুঃসময়কে থেকেছেন ভুলে? থেকেছেন এড়িয়ে? একেবারেই‌ না। তাই কবিতায় এসেছে এই সব পঙ্‌ক্তি— “ভেতরে জ্বরের মতো লাগে সবসময়/ লোকে বলে পরীক্ষা করাও দ্রুত।” অথবা, “বন্ধ হয়ে আসছে শহর/‌ পথে মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষ” অথবা “এই মৃত্যুর আবহে জানি তুমি দূরেই থাকো/‌ তবু কেন যে মনে হয় এত কাছে!”

কবিতা ছাড়াও বইটি আরও দু’টি কারণে আলাদা ও আকর্ষণীয়। একটি হল শুরুতে স্মরণজিতের গদ্য— ‘সারাজীবনের মতো ঋণী’। সচ্ছল গদ্যে তিনি তাঁর শৈশব থেকে পরিণত বয়েসের কবিতা জীবনের কথা বলেছেন। বলেছেন, কী ভাবে কবিতা লেখা শুরু করলেন, কী ভাবে কবিদের প্রেমে পড়লেন, কী ভাবে কবিতার সঙ্গে শুরু হল তাঁর বসবাস, কারা তাঁকে কবিতা লিখতে উৎসাহ দিলেন— স্মরণজিৎ সবই লিখেছেন অকপটে। সুন্দর আত্মপ্রকাশ।

বইটির অন্য আকর্ষণ, এর অভিনব, মনকাড়া চেহারা। যত্ন আর ভাবনার ছাপ এই কবিতার বইয়ের পাতায় পাতায়। প্রায় প্রতিটি কবিতার পাশে ছবি এঁকেছেন সব্যসাচী দত্ত। সে ছবিও একেবারে গল্পের মতো। যেন কবিতাকে দেখা যায়, ছোঁয়া যায়। প্রকাশক ‘বুক ফার্ম’কে শুধু সাধুবাদ জানালে চলবে না, এই অতিমারিরর সময়ে তাঁরা একটি জরুরি দায়িত্ব পালন করলেন।

আরও পড়ুন
Advertisement