প্রথমেই কবুল করছি, আমি যশোধরা রায়চৌধুরীর গদ্যের এক জন অনুসন্ধানী পাঠক। যশোধরার লেখা একটি আত্মস্মৃতিমূলক গদ্যগ্রন্থ পড়ার পর আমার এই অবস্থান।
কবির গদ্য। কবির গদ্যে মায়া থাকে। মায়াদর্পণ। সেই দর্পণে লেখক যে শুধু নিজের মুখই দেখেন এমনটা নয়, পাঠককেও মুখ দেখার সুযোগ করে দেন। এই মুখ কখনও ভাঙাচোরা, রক্তাক্ত। কখনও বা সুন্দর। এই বইটির ক্ষেত্রে ভাঙাচোরা বা রক্তাক্ত মুখ দেখার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। পড়ে রইল সুন্দরের মুখ। এখানে প্রায় সময়েই সেই সুখ অসম্পূর্ণ। সম্পূর্ণ করার দায় কার?
যাক সে কথা। চোখ রাখি এই গ্রন্থে। দেখি কে কে বসিলেন যশোধরার হৃদয়াসনে। সূচিপত্রে চোখ রাখলেই বোঝা যায় তাঁর হৃদয়ের বিস্তার। গ্রন্থের ৩১টি রচনা। ঠাঁই পেয়েছে রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে নব্বই দশকের লেখালিখি। বাদ যায়নি হাংরি আন্দোলন আর মেয়েদের লেখালিখিও। যশোধরা ভূমিকায় জানাচ্ছেন, “‘গদ্যাবধি’র পরে আর একটি বই যেখানে আমার কিছু গদ্যকে এক মলাটে রাখা হল। সেই সব লেখক-চিন্তকের বিষয়ে যাঁরা আমার কবিতাকে, আমার লেখকসত্তাকে চালিত করেছেন, উদ্বুদ্ধ করেছেন, জলসেচ করেছেন আমার মননে।”
কে বসিলে হৃদয়াসনে
যশোধরা রায়চৌধুরী
৪০০.০০
ধানসিড়ি
জানাচ্ছেন যে, “এই গ্রন্থের কিছু লেখা লঘু চালের। কিছু লেখা ভারিক্কি।” কেমন সে লঘুচাল? রবীন্দ্রনাথ বিষয়ক একটি গদ্যে লিখছেন, “রবীন্দ্রনাথ একদম ঘষা আধুলির মতন। এক্কেবারে ঝরঝরে মাল। এইরকম অভিব্যবহৃত মরচে পড়া ঘিসাপিটা জিনিস আর নেই।” আবার ধরুন কোনও একটি লেখার নাম, ‘চিকরি চিকরি ফার্ন, জীবুদাদা ও আমি’। জীবনানন্দকে ও-পার বাংলার কেউ কেউ জীবনবাবু বলেন বলে শুনেছি, কিন্তু ‘জীবুদাদা’ এই প্রথম। এই লেখাটি অবশ্য চমৎকার!
এ বার দেখি তাঁর ভারিক্কি চাল, “আসলে আমার রবি ঠাকুর কিন্তু এইসব পথচলা, এইসব লড়াই, টেনে টেনে চলা, ক্লান্তির কবি, আমার অন্ধকার চেটে খায়। তার ভেতরে ডোবে, আরাম পায়। আলোর কবি রবিঠাকুর নয়, যে লেখে ‘আমার এ পথ তোমার পথের থেকে অনেক দূরে গেছে বেঁকে’, যে লেখে ‘আমি এলেম তারি দ্বারে, ডাক দিলেম অন্ধকারে’ সে-ই। তার বারংবার কান্না, সৃষ্টি, লজ্জা, হেরে যাওয়া, বারবার আত্মআবিষ্কার, আমি দেখি।”
এখানে আত্মআবিষ্কারের নীচে দাগ টানি। এই বইয়ের প্রত্যেকটি লেখায় নিজেকে খোঁজার, নিজেকে বোঝার, আত্মআবিষ্কারের করছাপ খুঁজে পাই। আর এখানেই যশোধরার ম্যাজিক। সে লেখা কখনও হয়তো রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, কখনও বা জসীমউদ্দীনকে নিয়ে, কখনও বা অন্নদাসুন্দরী— বিস্মৃতির আড়ালে তলিয়ে যাওয়া অন্নদাসুন্দরীকে নিয়ে। অন্নদাসুন্দরীর কাব্য ও জীবন নিয়ে লেখাটি বার বার পড়া যায়। যে ভাবে বার বার পড়া যায় বিভূতিভূষণ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অরুণ মিত্র, কবিতা সিংহকে নিয়ে লেখাগুলিও। এখানে আর একটি লেখার কথা উল্লেখ না করলেই নয়। লেখাটির নাম ‘কবিতায় আমার পিতা ও পরিজনেরা’। তবে বইটির কয়েকটি লেখায় তাৎক্ষণিকতার আনাগোনা। সময় কম ছিল, কোনও পত্রিকায় এখনই লিখে দিতে হবে জাতীয় তাড়াহুড়ো। এই লেখাগুলি বইভুক্ত করার আগে আর একটু মনোযোগ দাবি করে। বিশেষ করে লেখিকা যখন যশোধরা রায়চৌধুরী।
বইটির পৃষ্ঠা ওল্টাই, যাঁদের কথা বললাম তাঁরা ছাড়াও একে একে চোখে ধরা পড়ে বুদ্ধদেব গুহ, মহাশ্বেতা দেবী, অরবিন্দ গুহ, শঙ্খ ঘোষ, ভূমেন্দ্র গুহ, বিনয় মজুমদার, তারাপদ রায়, বিজয়া মুখোপাধ্যায়, নবনীতা দেব সেন, গীতা চট্টোপাধ্যায়, ভাস্কর চক্রবর্তী, নাসের হোসেন, হাংরি আন্দোলন, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখাগুলি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখাটি পড়তে পড়তে শেষের দিকে এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। যশোধরা লিখেছেন, “যেকালে লিখেছিলেন, ‘মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদের চিৎকার করে’, এক আমূল অকবিতায় কেঁপে উঠেছিলাম এই লাইনটি পড়ে।” কেঁপে উঠতেই পারেন যশোধরা, তবে এটি কোনও কবিতার লাইন নয়, লাইনের অংশ, আর এই লাইনটিও শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের নয়, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। এটি ১৯৭১-এ লেখা একটি কবিতার নাম— শুধু কবিতার নামই নয়, কবিতাটি যে পুস্তিকায় ছিল তার নামও মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে। প্রকাশ ১৯৭২।
আমি আবার যশোধরার লেখা লাইনটিতে ফিরে যাই। যশোধরা লিখেছেন, “এক আমূল অকবিতায় কেঁপে উঠেছিলাম এই লাইনটি পড়ে।” আমি অকবিতা শব্দটির নীচে দাগ টানি। একটি কবিতার একটি বিচ্ছিন্ন অংশকে কী করে এত সহজে অকবিতা বলে চিহ্নিত করা যায়। আমার পুনরায় সম্পূর্ণ কবিতাটি পড়ার সাধ আগে। মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে। কবিতানামের নীচে একটি উদ্ধৃতি: “দি আর্থ ইজ় ফিলড উইথ মার্সি অব গড।”
এ বার কবিতাটি পড়া যাক: “অসীম করুণা তার, ঐ বধ্যমঞ্চ, যাকে বলি মাতৃভূমি,/ জল্লাদেরা প্রেম বিলায় কোলের শিশুকে, তাঁর লীলা—/ কবিরা কবিতা লেখে, দেশপ্রেম, ক্রমে গাঢ়তর হয় গর্ভের ভিতর রক্তপাত—/ মুণ্ডহীন ধড়গুলি আহ্লাদে চিৎকার করে, ‘রঙ্গিলা! রঙ্গিলা!/ কী খেলা খেলিস তুই!’/ যন্ত্রণায় বসুমতী ধনুকের মত বেঁকে যায়/ বাজারে মহান নেতা ফেরি করে কার্লমার্কস লেনিন স্তালিন গান্ধী/ এক এক পয়সায়।” এ বার কি এই কবিতাটিতে অকবিতা ঠাহর হচ্ছে! যদিও অকবিতা কাকে বলে তা নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। তবুও বলি, দেশজননী যখন সন্তানের রক্তে স্নাত, সেই সময় জাতকের চোখে চোখ রেখে লেখা কবিতার ভাষাও কিছুটা নিরাভরণ তো হবেই। এ সব সত্ত্বেও শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে লেখাটি অনেকগুলি প্রশ্নের সামনে আমাদের টেনে আনে। এই টেনে আনাটাই বইটির জাদুবাস্তবতা। একটি বই পড়ে মনে যদি প্রশ্ন না-ই জাগে, তর্ক করার মন উত্তেজিত না-ই হয়ে ওঠে, সেই বই পাঠের কোনও অর্থ হয় কি?
স্বচ্ছ, তীব্র, তর্কপ্রবণ এই বইটি আপনার অপেক্ষায়।