Book Review

বয়ে গেল আর রয়ে গেল যারা

মোটা দাগে এঁদের ফেরিওয়ালা বলা হলেও, প্রত্যেকেরই পেশা ও পণ্য ছিল স্বতন্ত্র। তাই তাঁদের পৃথক পেশাজীবী হিসাবেই ধরা উচিত। তেমনই ৪৩টি পেশা আর তাদের উপর নির্ভরশীল মানুষদের নিয়ে এ বই।

Advertisement
শেখর ভৌমিক
শেষ আপডেট: ২৪ অগস্ট ২০২৪ ০৮:৫১
অতীতচিত্র: মশক কাঁধে ভিস্তিওয়ালা। আশির দশকের শেষ দিকের কলকাতায়

অতীতচিত্র: মশক কাঁধে ভিস্তিওয়ালা। আশির দশকের শেষ দিকের কলকাতায় Sourced by the ABP

বরিফ বরিফ বলে/ বরফওয়ালা যান/ গা ঢালো রে, নিশি আগুয়ান।” ‘বরিফ, বরিফ [বরফ] চাই, বরিফ, কুলপি বরিফ’ শুনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যোতিকাকা তো গানই বেঁধে ফেলেছিলেন দু’কলি। এ স্মৃতি তো অবন ঠাকুরের জোড়াসাঁকোর ধারে-রই নয়— হারিয়ে যাওয়া কালের অজস্র মানুষের। মহল্লাতে একের পর এক আসত ফেরিওয়ালারা। হুতোম লিখছেন, “কিছু পরেই পরামানিক ও রিপুকর্ম্ম বেরোলেন।” যাঁরা লিখছেন সব যেন একটা ছন্দে লেখা— রসরাজ অমৃতলাল লিখছেন, “টিকে লেও [কাঠকয়লা গুঁড়িয়ে তাঁর চাকতি]... টিকেওয়ালা বেরিয়েছে... মাখমওয়ালা দুপাত মাখম বাড়ীতে দিয়ে গেল... ‘সরাগুড় তিলকুটো সন্দেশ মুকুন্দমোয়া’ ডেকে গেল, ‘বাত ভাল করি দাঁতের পকা বার করি’ বলতে বলতে বেদিনীও বাজারের দিকে গেল... ‘মাজনমিশি মাথাঘসা’র চুবড়ি কাঁকে মুসলমান বুড়ীও চেঁচিয়ে গেল... ‘রিপুকম্ম’ ‘চাই ঘোল’ ডেকে যাচ্ছে।” বিরামহীন আসা। কৃষ্ণকামিনী দাসী পান্তীর মাঠ-এর ধারে বসে জীবন্ত বর্ণনা দিচ্ছেন, “ঐ চলিল পথে ধর্ম্মদাস ধুনুরী তুঁহু তঁহু শব্দ করিয়া। ঐ আসিল বাঁদর খেলা দেখাইবার দল।... ঐ যায় বাত-ভাল কইরী, দাঁতের-পোকা-ভাল-কইরী, ছুরি-কাঁচি শান, শীল-কাটাও। ভিস্তি মোষক লইয়া চলিল।” যেন এক ছবি। ‘কুয়োর ঘটি তোলা’র আগমনে অবন ঠাকুরের মনে হত, “ঠিক যেন অদ্ভুত কোন্‌ একটি পাখি ডেকে চলেছে।” শশীচন্দ্র দত্ত তাই তো এই ফেরিওয়ালাদের ডাক নিয়ে লেখাটার নামই দিয়েছিলেন ‘দ্য স্ট্রিট সং অব ক্যালকাটা’। মেয়েমহলেও তাদের আনাগোনা ছিল। ঠাকুরবাড়িতে বিকেল তিনটে থেকে চলত প্রসাধনের বেলা— বিবিজি বলে এক ‘গহনা ওয়ালী’ দিয়ে শুরু। তার পর ‘চুড়িওয়ালী’। শেষে বোষ্টমী আসত ভক্তিতত্ত্বের গান শোনাতে।

Advertisement

মোটা দাগে এঁদের ফেরিওয়ালা বলা হলেও, প্রত্যেকেরই পেশা ও পণ্য ছিল স্বতন্ত্র। তাই তাঁদের পৃথক পেশাজীবী হিসাবেই ধরা উচিত। তেমনই ৪৩টি পেশা আর তাদের উপর নির্ভরশীল মানুষদের নিয়ে এ বই। স্বাতী দাসের লেখা তিন ডাক্তারের তিন কম্পাউন্ডারের (নামটি এ কালে অচেনা ঠেকবে অনেকের) স্মৃতিরোমন্থন দিয়ে শুরু। সবচেয়ে জনপ্রিয় বিপুল ডাক্তারের ছোটকু। কী না থাকত তার ব্যাগে— বাচ্চা ভোলানোর খেলনা পর্যন্ত। শৈশবে লেকটাউনের ডাক্তার অনিল চৌধুরীর কম্পাউন্ডার বিষ্টুকাকুকে মনে পড়ল, প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী মিক্সচারটি ধরিয়ে যে হাসিটি দিতেন তা ছিল অভয়বাণীর শামিল।

‘প্রেসপরিবার ও কাঙালের উত্তরাধিকার’-এ লেটার প্রেস-এর অবলুপ্তি নিয়ে আক্ষেপ। সুবলবাবু, পঞ্চাদার মতো কম্পোজ়িটর আজ হারিয়ে গিয়েছে। পরিবারে সামান্য বইয়ের ব্যবসাসূত্রে বাড়িতে গোটানো প্রুফ আসত। ভুল ধরলেই ১০ পয়সা বরাদ্দ ছিল। ইচ্ছে করে ঠিকটাও ভুল দেখিয়ে বাপ-জেঠাদের বোকা বানানোর বৃথা চেষ্টা করতাম।

বড় বড় শপিং মল, প্লাজ়ার দাপটে সিনেমা-হল শেষ। উত্তরের হাতিবাগান পাড়ার হলগুলো, আমার এলাকার জয়া-মিনিজয়া-শেলী সব আজ প্রায় ইতিহাস। ‘সিনেমাওয়ালা’রাই যখন নেই, তখন ‘ব্ল্যাকার’ আর টেকে কী করে? দু’টো লেখাতেই হারানো এক কালের ছবি— যে সময়ে আমাদের পাড়ার দাদারা ‘বেলাকে’ দরদাম করে কেউ শোলে দেখেছে দশ বার তো কেউ পাঁচ বার অমানুষ। আর স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে শোনাত সে সব গল্প আমাদের। উজ্জ্বলের মতো পুরনো ব্ল্যাকারদের সঙ্গে তাই অতিমারির ত্রাণ শিবিরেই তো দেখা হবে লেখকের।

‘বিয়ে গাউনি’-দের নিয়ে মীর রাকেশের লেখা খুবই তথ্যবহুল। জাকেরা বেওয়াদের মৌলবাদের দাপটের বিরুদ্ধে লড়াইটাও লেখার অন্য দিক। বহু হিন্দু বাঙালি বাড়িতেও বিয়েতে গানের চল ছিল, তার জায়গা নিয়েছে ‘সঙ্গীত’-এর মতো অবাঙালি পরম্পরা। সুতো কাটা কাটুনিদের নিয়ে লিখেছেন মেয়েদের গানের দীর্ঘদিনের সংগ্রাহক চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়। হাতে কাটা সুতোর চাহিদা কমতে থাকায় তাঁদের কঠিন পরিস্থিতির শিকার হওয়ার উল্লেখও আছে। ঝুমঝুম ঘণ্টা বাজানো ডাকহরকরা বা রানার তো স্বাভাবিক নিয়মেই বিদায় নিয়েছে। যেমন ফ্লেক্সের দাপটে হারিয়েছে ‘লেখালেখির [সাইনবোর্ড] শিল্পীরা’। তবে ‘কৌলাল কৌলীন্যহীন’ সর্বাংশে সত্যি নয়। পুজো-আচ্চা থেকে শুরু করে চা-দোকানে তো বটেই, ইদানীং মাটির থালা, গেলাস এক প্রকার শৌখিন বস্তু হিসাবে নামী রেস্তরাঁ আর বিয়েবাড়িতেও ঢুকে পড়েছে।

বাংলায় স্মৃতির পেশা ও পেশাজীবীরা প্রথম খণ্ড

সম্পা: সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়

৬৯০.০০

সুপ্রকাশ

বাংলাদেশে পালকি-বাহকদের ইতিহাসটা তুলে ধরায় ‘হুঁ হুম না’ অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়েছে। নজরকাড়া ‘হুঁকাবরদার’ ‘পাঙ্খাওয়ালা’দের (মহাফেজের নথির ‘পাঙ্খাপুলার’) গল্পগুলোও। নিউ মার্কেটের নাহুম সাহেব যে ফুলবাগানের কবরখানায় নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে, তা তো জানতামই না ‘জেগে রয় একা মৃতদের ভিড়ে’ না পড়লে। ‘শ্মশানের বিভিন্ন পেশা’ প্রসঙ্গে ডোম থেকে পুরুত, কাপড়ওয়ালা সব থাকলেও কচুরি ও চা-ওয়ালারাও লেখকের চোখ এড়ায়নি।

সেই ‘পদ্মকাটা নক্সা আঁকা শিল’ই আজ ক’টা বাড়িতে পাবেন? তবু রহমত মিয়াদের ‘শিল কাটাও’ বলে মাঝে মাঝেই হাঁকতে দেখি, ‘ধুনুরি’দের বিশেষত শীতকালে। খেজুর রস সংগ্রাহক ‘সিউলি’রাও হারায়নি। তবে লেখকের কথা ঠিক— সে রমরমা নেই। আগে সকালে ‘চাই খেজুর রস’ বলে এদের হাঁকও শোনা যেত বলে লিখেছিলেন অতুল সুর।

তবে ছ’মাস ধরে কিস্তিতে শোধের অলিখিত চুক্তিতে শাল দেওয়া ‘নীল চোখের শালওয়ালা’রা গেলেন কোথায়! শ্রীনগরে অকালপ্রয়াত রশিদ ভাইয়ের বাড়ি গেলে কী যত্নটাই না আমাদের, পরিচিতদের করতেন তিনি এবং তাঁর স্ত্রী মুবিনা! স্মৃতি থেকে সেই শালওয়ালা বন্ধুর সঙ্গে বিচ্ছেদের বিধুর-মধুর গল্প শুনিয়েছেন শুভদীপ।

সুখের খবরও কিছু আছে। এ কালের ক’জন শ্রীনাথ বহুরূপীর গল্প বলেছেন রূপা সেনগুপ্ত— ২০০৪ সালে সুকুমার চৌধুরীর লালশুকরা ওরাওঁ পুরস্কার প্রাপ্তির উল্লেখও করেছেন। বাঁচার স্বপ্ন কে না দেখে! এ বইয়ের ‘চাঁদশী ডাক্তার চিনু চ্যাটাতির’ও ছিল। স্বপ্ন দেখতেন এক দিন ‘চাঁদশী বিজ্ঞানের মেডিকেল কলেজ হইবো’। হয়নি।

ছোট আকারে হলেও এমন বই আগে লেখা হয়েছে— রাধাপ্রসাদ গুপ্তের কলকাতার ফিরিওয়ালার ডাক আর রাস্তার আওয়াজ, কিন্নর রায়ের লুপ্তজীবিকা লুপ্তকথা বা নবকুমার ভট্টাচার্যের বিচিত্র পরম্পরা বিচিত্র পেশা-র মতো। তবে এ বইয়ের প্রকৃতি আলাদা। এখানে হারিয়ে যাওয়া পেশাজীবীদের পাশাপাশি টিকে থাকা লোকেদেরও অনেক প্রাবন্ধিক তুলে এনেছেন। রসরাজ লিখেছিলেন ‘পতিত পাবনী সুরধুনী... কলনলবাহীণি রূপে কলিকাতা বাসীর গৃহে গৃহে’ প্রবেশ লাভের সঙ্গে ভিস্তিওয়ালারাও শেষ। কিন্তু প্রচুর তত্ত্বতালাশ করে মৌসুমী দেখিয়েছেন, জল ভরার সেই মশক আজও তৈরি হয়। আর উত্তর ও মধ্য কলকাতার বহু বাড়ি আর হোটেল চলে এঁদের সরবরাহ করা জলেই। তবে বইয়ের ‘গাড়োয়ান’ ‘গোচারক রাখাল’ আর ‘মৈষাল’রা বিলুপ্তই। ‘কবিয়াল’ গল্পে ভোলা ময়রা, রাম বসুদের উল্লেখ বাঞ্ছনীয় ছিল। ইতিহাস আশ্রয় করেছেন বলেই ‘কোচোয়ান’ বা উৎপল ঝা-র চৌকিদার নিয়ে লেখাটি সমৃদ্ধ হয়েছে।

কালের নিয়মে হারাবে তো সবই। সম্পাদক বইটি উৎসর্গ করেছেন ‘বিজ্ঞান থেকে প্রযুক্তিতে পরাশ্রয়ের বিশ্বধারা-স্রোতে যারা ভেসে গেল’, তাদের। সেই তারিণী মাঝিদের, এ বইয়ের ‘হারিয়ে যাওয়া আমোদ আলি, নিরঞ্জন মাঝি’দের। নতুনকে জায়গা দিতেই হবে। তারাশঙ্করের ‘খাজাঞ্চিবাবু’কে কৌশলে তাড়ানো হল কেন? “ইংরেজীতে অ্যাকাউন্ট রাখা হবে বলে।” আমার দেখা কলকাতা-য় প্যারীমোহন মুখোপাধ্যায় লিখছেন, “আধপোড়া বিড়িটা মুখে দিয়ে... আস্তে আস্তে খালি পায়ে চলে গেল “রিপুকম্য, রিপুকম্য” (রিপুকর)...” সবাই এমন আস্তে আস্তে চলে যায়। তবে একেবারে কি বিলুপ্ত হয়? ‘পৃথিবী নামক এই গ্রহটির কোথাও-না-কোথাও তারা জেগে আছে’, আধুনিক বিশ্বের ‘ডেলিভারিপার্সন’দের মধ্যে। বইটিতে মুদ্রণপ্রমাদ কম। ছাপা, কাগজ দুই-ই উন্নত মানের। তবে সম্পাদকের কথা স্পষ্ট ও বিশদ হলে ভাল হত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
আরও পড়ুন
Advertisement