Book Review

রসিকতার গভীর সমুদ্রে অবগাহন

ইহুদিদের জীবন-পরম্পরা যে পথে এগিয়েছে তাতে কেবলই কাঁটা আর ধারালো পাথর, যার নির্মম আঘাতে তাঁদের ইতিহাসের গায়ে অজস্র ক্ষতচিহ্ন।

Advertisement
কুমার রাণা
শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:০৭
—প্রতীকী চিত্র।

—প্রতীকী চিত্র।

“গ্রুন: আমরা না কি ঈশ্বরের পছন্দ করা মানুষ? ইহুদি জাতি?

Advertisement

রোট: তাই তো মোজ়েস আমাদের সেই প্রতিশ্রুত ভূমিতে নিয়ে গেছেন।

গ্রুন: তা ইজ়রায়েল কেন? মোজ়েস আমাদের সুইৎজ়ারল্যান্ড নিয়ে যেতে পারতেন না?”

এটা নমুনামাত্র, রসিকতার উপচে পড়া ভান্ডার ইহুদি রসিকতা বইটি থেকে তুলে নেওয়া। রসিকতার সঙ্কলনমাত্র নয়, এটি একটি মৌলিক গ্রন্থ। ব্যাপারটা যতই লঘু শোনাক না কেন, কঠিন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকা মানুষ যে নানা রসদ সৃষ্টি করে, তার মধ্যে রসিকতার গুরুত্ব বিরাট। আর ইহুদিদের জীবন-পরম্পরা যে পথে এগিয়েছে তাতে কেবলই কাঁটা আর ধারালো পাথর, যার নির্মম আঘাতে তাঁদের ইতিহাসের গায়ে অজস্র ক্ষতচিহ্ন। প্রচণ্ডতার গুরুভার লাঘব করার জন্য পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে রসিকতার এত আদর-কদর। হীরেন সিংহরায়ের বড় কৃতিত্ব হল, বিশ্বের নানা দেশের ইহুদি রসিকতা কুড়িয়ে এনে, তাঁর নিজের ভাষা-সম্প্রদায়, বাংলাভাষী পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া। বইটির উপস্থাপনায় সুন্দরের ছোঁয়া, বুদ্ধির ঔজ্জ্বল্য।

সুন্দরের ছোঁয়াটি এসেছে লেখকের বিশ্বমানবিক মন থেকে, যে মন গড়ে উঠেছে বীরভূমে তাঁর পূর্বজদের বসত পুদিমা গ্রামে, ছোটবেলা কাটানো ঝরিয়া কয়লাখনি অঞ্চলে, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে, চাকরিসূত্রে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্নতায় একত্র মানুষের সঙ্গে আলাপে-সংলাপে। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে, জার্মান ভাষা জানার সুবাদে, তাঁর আলাপ হল ইদিশ ভাষার সঙ্গে— যে ভাষা ‘ইউরোপীয় ইহুদিদের মামা লশেন বা মাতৃভাষা’, এবং যা গড়ে উঠেছিল ছিন্নমূল ইহুদিরা জার্মানিতে আসার পর। ভাষাটির সঙ্গে আকস্মিক পরিচয়ের পর তিনি খোঁজ পেলেন ইহুদি রসিকতার গভীর সমুদ্রের। এই খোঁজের বিবরণের সঙ্গে সঙ্গে তিনি সন্ধান করছেন ভাষাটির উৎস, সেই শিকড় ধরে ইহুদি জাতির উৎস ও পরিক্রমা, নানা দেশে তাঁদের পরিচিতি ও জীবনের লড়াইয়ের কথা। পাশাপাশি তিনি এক-এক করে মেলে ধরেছেন রসিকতার বৈচিত্র।

রসিকতাগুলো বিভিন্ন পরিচ্ছেদে ভাগ করা। ব্যক্তির নাম, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্থাননাম, ঘটকালি ও যৌতুক, ডাক্তারি, ঈশ্বর, হিটলার ও নাৎসি আমল, পূর্ব ইউরোপ, রাশিয়া, যুদ্ধক্ষেত্র, ধর্ম, রেস্তরাঁ— বিচিত্র বিষয় নিয়ে ইহুদি-বিশ্বে প্রচলিত জীবনের অমূল্য রসদগুলিকে সাজিয়ে দেওয়ার সময় প্রতি পরিচ্ছেদেই লেখক আমাদের ধরিয়ে দিচ্ছেন সেগুলোর নির্মাণের প্রেক্ষাপট। প্রেক্ষাপটের সন্ধানটি এ বইয়ের আর এক বিশেষত্ব। লেখক আমাদের হাত ধরে নিয়ে যান জার্মানি, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, আমেরিকা, আবার পরমুহূর্তে ফেরত নিয়ে আসেন আমাদের ঘরের আঙিনায়, যেখানে রবীন্দ্রনাথের বাসা, যেখানে আমরা উৎপল দত্তের নাটক দেখি, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন ইহুদি সিনেমা দেখি, মোহনবাগানের খেলা দেখি, আর প্রমথ চৌধুরীর প্রবন্ধ পড়ি।

বইয়ের একটি পরিচ্ছেদের নাম ‘মিশপখে’। এই হিব্রু শব্দটির অর্থ পরিজন। আজ যখন একদা বিশ্বসন্ধানী বাঙালিও ক্রমশ নিজের পরিজনের বৃত্তকে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর করে তুলতে মরিয়া, তখন খাঁটি বাংলা ভাষায় লেখা ইহুদি রসিকতা আশা জোগায়, যুগপৎ বাঙালি ও বিশ্বমানব হবার আশা। সেই সঙ্গে ভরসার কথা, সৈয়দ মুজতবা আলীর বেরাদরিটি এখনও লুপ্ত হয়ে যায়নি। এখনও পাণ্ডিত্য ও মমত্বকে এক গেলাস ঠান্ডা জলের মতো বাড়িয়ে দেওয়ার লেখক আছেন।

ইহুদি রসিকতা হীরেন সিংহরায় ৪২৫.০০ দে পাবলিকেশনস

Advertisement
আরও পড়ুন