পরম্পরা: নিজস্ব শৈলীর কুটিরে বসবাসকারী টোটো পরিবার, উত্তরবঙ্গ
জনগোষ্ঠীর ভাষা ও ভাষাতত্ত্বের নিগূঢ় অনুসন্ধান সমাজ-ইতিহাস আলোচনার অন্যতম দিকচিহ্ন। আঞ্চলিক জনবিন্যাসে সাংস্কৃতিক নানা বিষয়বৈচিত্র ভাষাভিত্তিক পর্যালোচনায় সূচিত হয়। জনসমাজের পরিচিতি প্রকাশে ভাষার নিজস্বতা, আঞ্চলিক রূপশৈলী ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংযোগ-সম্পর্কের নানা কথা নিয়ে রতন বিশ্বাস সম্পাদিত উত্তরবঙ্গের ভাষা ও স্থাননাম (অমর ভারতী, ৯৫০.০০) শীর্ষক সুবৃহৎ এই প্রকাশনা। জনবৈচিত্রে উত্তরবঙ্গ বৃহত্তর বঙ্গদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূভাগ। স্বাভাবিক ভাবে আদিম জনজাতির ভিন্ন ভিন্ন ভাষা-সহ বাংলা ভাষা ও আঞ্চলিক নানা উপভাষার বৈচিত্রের নানা দিক আলোচনায় আছে ‘উত্তরবঙ্গের ভাষা’ শীর্ষক পর্বে। পরবর্তী পর্বে উত্তরবঙ্গের স্থাননাম আলোচনায় স্থানীয় প্রকৃতি-পরিবেশ-সংস্কৃতির খুঁটিনাটি অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বিভিন্ন আদিম জনজাতি ও অন্য জনগোষ্ঠীর লোকায়ত শব্দকোষ-সহ বাংলা ও ইংরেজি শব্দ উল্লেখে একটি প্রয়োজনীয় তালিকা সঙ্কলন করেছেন সম্পাদক। বইটির বিশেষত্ব হল— জনজাতির পরিচয়ের ভাষাভিত্তিক এই প্রয়াস গবেষকদের ক্ষেত্রানুসন্ধানী চর্চায় লিপিবদ্ধ হয়েছে। ভিন্ন ভিন্ন গবেষকের আলোচনায় তাই শুধু ভাষাগত অঞ্চল বিভাগের অনুসন্ধান নয়— ধ্বনিতাত্ত্বিক শব্দগঠন, পদের রূপ, শব্দভাণ্ডার ইত্যাদি ব্যাকরণের খুঁটিনাটি বিষয়েরও গবেষণাধর্মী চর্চা। উত্তরবঙ্গের ভাষা পরিচিতির অন্যতম প্রয়োজনীয় কোষগ্রন্থের মর্যাদা পাবে এই সঙ্কলন।
জল-জঙ্গল আর কৃষিভূমির বৃহত্তর বদ্বীপ অঞ্চল নিয়ে, দক্ষিণবঙ্গের সুন্দরবনের স্বাতন্ত্র্য বজায় আছে তার সংস্কৃতিতেও। ইতিহাসের নানা সময়কালে জনবসতি স্থাপনার ধারাবাহিক পর্যায়ের প্রাচীন সংস্কৃতির প্রমাণও পাওয়া গিয়েছে। সাংস্কৃতিক সূত্র বিবেচনায় বসতি গড়া দ্বীপ বা জনহীন জল-জঙ্গলের মতো রহস্যে ঘেরা হয়ে আছে বহু ক্ষেত্রেই। নদী জলাভূমির জঙ্গলময় এই বসতিতে জনগোষ্ঠীর জীবনধারণ, পেশা, লোকসাংস্কৃতিক উপাদান, পালনীয় লৌকিক রীতি-আচার-ধর্ম জনবিন্যাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে আছে। দেবব্রত নস্কর সুন্দরবন সভ্যতা ও লোকসংস্কৃতি অন্বেষণ (দে’জ পাবলিশিং, ৬০০.০০) বইতে এই সার্বিক প্রেক্ষাপট আলোচনা করেছেন। এই বই বিভিন্ন সময়কালের সুন্দরবন অঞ্চলের জীবন-সংস্কৃতির অন্বেষণ। লোকধর্ম ও লোকদেবতা, উৎসব-অনুষ্ঠান, সম্প্রদায়গত সংস্কৃতি-সহ লুপ্ত সভ্যতার আলোচনায় বহুবিচিত্র সাংস্কৃতিক উপাদানের তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। সমাজ-সংস্কৃতির অন্য বিষয় চর্চাও আছে লেখার তালিকায়। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সে সব লেখা সন্নিবেশ করতে গিয়ে কিছু কিছু বিষয় অধ্যায়ের সঙ্গে মানানসই হয়নি।
বঙ্গদেশের বহুবিচিত্র জনগোষ্ঠীর সমাজ-সংস্কৃতির চিহ্নবহ অন্যতম ভূভাগ উত্তরের তরাই-ডুয়ার্স। এই ভূভাগ অসম, সিকিম, বিহার প্রদেশের সীমা সম্পর্কে শুধু নয়; এখানে নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সঙ্গেও সংযোগ-সম্পর্কের ভিত্তি গড়ে উঠেছে। পাহাড়, নদী, জঙ্গল আর সমভূমির দৃশ্যমান প্রকৃতির মাঝে বহুবর্ণী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার মিলে গড়ে ওঠা এটি একটি স্বতন্ত্র ক্ষেত্র। আব্দুর রহিম গাজী সম্পাদিত তরাই-ডুয়ার্সের লোকসংস্কৃতি (বঙ্গীয় সাহিত্য সংসদ, ৫০০.০০) এই সার্বিক পটভূমিতে আলোচনার সঙ্কলন। সাত পর্বে বিভক্ত প্রায় অর্ধশত লেখকের চর্চায় এই ভূভাগের সাধারণ পরিচয় থেকে লোকসাহিত্য, লোকভাষা, পুজোপার্বণ, মেলা উৎসব, লোকবিশ্বাস, পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, লোকচিকিৎসা, লোকনৃত্য, লোকসঙ্গীত, লোকনাট্য, লোকশিল্প, জনজাতীয় সংস্কৃতি ইত্যাদির আলোচনা নিয়ে এই সঙ্কলন। এসব লেখার বৃহদংশই ক্ষেত্রসমীক্ষাধর্মী। আর বিশেষ ভাবে তাৎপর্যের যে, জনজাতির কথায় টোটোদের নিয়ে লিখেছেন ধনীরাম টোটো, রাভা নিয়ে সুশীল রাভা, ধিমাল নিয়ে গর্জনকুমার মল্লিক, ওঁরাও সমাজ নিয়ে বিমলকুমার টোপ্পো, মেচ নিয়ে রমেশচন্দ্র সুবা। নিজ জনগোষ্ঠীর চর্চায় তাঁরা পরিচিত লেখক— এ বিষয়ে আগেও লিখেছেন সবিস্তারে। এ ক্ষেত্রে সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তি হলেও, বিস্তৃত আঞ্চলিক জনজীবন ও সংস্কৃতিচর্চায় তা প্রাসঙ্গিক। সঙ্কলনের প্রয়াস ধন্যবাদার্হ হলেও, ৮০০ পৃষ্ঠার কলেবরে নানা পর্বে কোনও কোনও বিষয়-আলোচনা মিলেমিশে গিয়েছে। বাংলাদেশের রংপুর ডিভিশনের লোকসংস্কৃতি চর্চার প্রেক্ষিত স্পষ্ট নয়।
ভরকেন্দ্র বীরভূম। কিন্তু, বাংলার বৃহত্তর চৌহদ্দি বিষয়ভিত্তিক চর্চায় এনেছেন আদিত্য মুখোপাধ্যায়। পরিচিত বিষয় হলে আলোচনার ক্ষেত্রে পূর্বজদের চর্চায় কিছু সুবিধা, আবার বাড়তি প্রত্যাশাও তৈরি হয়। বাংলার পট-পটুয়া চর্চা শতাব্দীপ্রাচীন। নানা প্রেক্ষাপটেই সে সবের চর্চা গবেষণা হয়েছে। আদিত্যর বাংলার পট ও পটুয়া (বলাকা, ২২০.০০) শীর্ষক পর্যালোচনা একটু অন্য মাত্রার। পটুয়ার জীবনজগৎ, কালীঘাট পট, যমপট, দুর্গাপট, আদিম জনজাতির পট ও গাজিপট, পটুয়াদের সমকালীন অবস্থান, পট ও পটুয়ার শেষের কথা— ইত্যাদির বিষয় অন্বেষণে সার্বিক চিত্র তৈরি হয়েছে লেখকের পর্যবেক্ষণ ও অনুভবের অনুসারী হয়ে। তাতে কথায় কথায় আলোচ্য বিষয়ের চৌহদ্দি বিস্তৃততর হয়েছে। ‘পটের মেলায় নয়া গ্রামে’ লেখায় তাঁর সমীক্ষার দৃষ্টিকোণ বাংলার পটচর্চায় নতুন তথ্যের ইঙ্গিত জোগাবে। লেখকেরই বাংলার ডোকরা শিল্প (বলাকা, ১৬০.০০) লৌকিক প্রযুক্তি ও শিল্পীসমাজের কথালাপে এই সময়ের প্রয়োজনীয় তথ্য নিবন্ধীকরণ। ডোকরা পরম্পরা, ঢেকারো চরিত, বিকনা শিল্পডাঙা, দরিয়াপুরের কথাকাব্য, ডোকরা: শিল্প ও শিল্পী এবং ডোকরা শিল্পীদের সমকালীন অবস্থান নিয়ে বইটির কথালাপ। এই শিল্পের প্রসঙ্গকথায় ইতিহাসের বয়ান আছে, যাতে ধাতুশিল্পের অন্য বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। পরিচিত শিল্পকেন্দ্র হিসাবে বিকনা ও দরিয়াপুরের শিল্পীদের দারিদ্রকাতর বয়ান উঠে আসে আবার বিপণনের মাত্রায় কী ভাবে পাল্টে যাচ্ছে শিল্পীজীবন তাও উল্লেখ করছেন লেখক। স্বল্পজ্ঞাত, অচেনা শিল্পকেন্দ্রগুলি নিয়ে এই অনুভবী আলোচনার পরিসর তৈরি করা সম্ভব হলে, এই শিল্পকাজের সার্বিক মানচিত্র তৈরির কাজ আরও এগিয়ে যেত।
‘যদি শোনে কবির কথা/ খুইল্যা ফেলে গায়ের কাঁথা’। ওপার বাংলার কবিগানের আকর্ষণী ভাব নিয়ে এমন কথাও শোনা যায়। যদিও কবিগান বাংলার সর্বপ্রান্তেই কমবেশি সজীব ধারা হিসাবে পরিচিত ছিল। কবির লড়াইয়ে দু’পক্ষের কথা ছড়া মিশেলে যে সংলাপ তা আজও অন্যতম ক্ষীয়মাণ লোকআঙ্গিক। স্বপনকুমার ঠাকুর রচিত রাঢ় বাংলার কবিগান (বীরাসাত, হাওড়া; ১৭০.০০) আলোচনায় কবিগানের পরিচয় পর্যালোচনার সঙ্গে আছে বিস্তৃত অঞ্চলের কবিগানের শিল্পী পরিচিতি, দোহার ও ঢুলিদারদের নাম-পরিচয়। এই সঙ্গে কবিগানের পালা সংকলনে এই ধারার অন্তররূপ জানা যায়। শেষ পর্বে কবিয়ালি লোকগল্প। ছোট ছোট গল্পে বুদ্ধিদীপ্ত নীতিশিক্ষা আর সর্বোপরি জীবনবোধের রসিক কথন। এই ব্যতিক্রমী প্রয়াসটি এই বইতে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন। তবে উল্লিখিত হয়নি পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রামের মতো রাঢ়বঙ্গের অন্য অঞ্চলের কবিগানের কথা।