Book

হঠাৎ আলোর ঝলকানি লেগে

এই আলোচনার সূচনাবিন্দু ১৮৮০ সাল, কেননা ওই বছরই দুর্ভিক্ষ কমিশন প্রথম বার স্পষ্ট ভাষায় কবুল করে যে, এ দেশের বৈষয়িক উন্নতির অভাব আর শিল্পায়নের অনটনের জন্য দায়ী হল কারিগরি বিদ্যা আর প্রযুক্তির অপ্রতুলতা।

Advertisement
অরবিন্দ সামন্ত
শেষ আপডেট: ১৬ জানুয়ারি ২০২১ ০০:০১

সাম্রাজ্যের ভাঙাগড়া বা অভিজাতদের জীবনচর্যা রচনায় বহু দিন থেকেই আর ইতিহাসবিদদের তেমন গরজ নেই। সাধারণ মানুষের সামাজিক রীতিনীতি, দৈনন্দিন অভ্যাস, বিশ্বাস-অবিশ্বাস, কিংবা নিম্নবর্গের যে অনুচ্চ জীবন, তা-ই আজ ইতিহাসবিদদের সামাজিক অন্বেষার অন্যতম অনুষঙ্গ। আরও সাম্প্রতিক কালে, ইতিহাসবিদরা অনুসন্ধান করতে এগিয়ে এলেন, কী ভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চালিকাশক্তি গুরুত্বপূর্ণ সমাজ পরিবর্তনের অন্যতম নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। সেই পরম্পরা অনুসরণ করেই শুভব্রত সরকার ব্রতী হয়েছেন একটি নতুন ধরনের গবেষণা-কর্মে, যার বিষয়বস্তু হল ঔপনিবেশিক বাংলায় ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষা, প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পোদ্যোগ ও বিদ্যুদয়নের সামাজিক অভিঘাত।

এই আলোচনার সূচনাবিন্দু ১৮৮০ সাল, কেননা ওই বছরই দুর্ভিক্ষ কমিশন প্রথম বার স্পষ্ট ভাষায় কবুল করে যে, এ দেশের বৈষয়িক উন্নতির অভাব আর শিল্পায়নের অনটনের জন্য দায়ী হল কারিগরি বিদ্যা আর প্রযুক্তির অপ্রতুলতা। কারিগরি বিদ্যা বলতে এ যাবৎ শুধু সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বোঝাত। ১৮৮০ সালের পর থেকেই, লেখকের মতে, এ দেশে ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার নানা শাখা— মেক্যানিক্যাল, ইলেকট্রিক্যাল, মাইনিং ইত্যাদি— খুলে যায়। আর এই সময় থেকেই ছোট আর মাঝারি মাপের বহু বাঙালি উদ্যোগপতি নিজেদের ব্যবসায়িক উন্নয়নে আধুনিক প্রয়োগশাস্ত্রের কৃৎকৌশল কাজে লাগালেন। এঁরা প্রমাণ করেছিলেন, ঔপনিবেশিক প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাঙালি জাতির মধ্যে শিল্প-উদ্যোগের খামতি ছিল না।

Advertisement

বইটিতে মূল পাঁচটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ে বাংলার আধুনিক কারিগরি বিদ্যার প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে লেখক শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও যাদবপুরের কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি-র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছেন। বলেছেন ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষার বিবর্তনে এক দিকে সরকারি আমলা ও প্রযুক্তিবিদদের ঔপনিবেশিক স্বার্থ, আর অন্য দিকে ভারতীয় বিজ্ঞানী ও কারিগরীবিদদের জাতীয় আকাঙ্ক্ষার টানাপড়েনের কথা। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের মামুলি বুনিয়াদি শিক্ষাক্রমে কলকাতার শহুরে বুদ্ধিজীবীরা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁরা দাবি করেছিলেন আধুনিক উন্নততর প্রযুক্তির প্রশিক্ষণ। ব্যর্থমনোরথ হয়ে তাঁরা শেষ পর্যন্ত দেশীয় উদ্যোগে ও দেশীয় পরিচালনায় উচ্চতর কারিগরি শিক্ষার সঙ্কল্প নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশন, যা পরে হয়ে ওঠে যাদবপুর কলেজ অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি।

লেট দেয়ার বি লাইট: ইঞ্জিনিয়ারিং, অন্ত্রপ্রনরশিপ অ্যান্ড ইলেকট্রিসিটি ইন কলোনিয়াল বেঙ্গল, ১৮৮০-১৯৪৫

শুভব্রত সরকার

৮৫০.০০, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস

দ্বিতীয় অধ্যায়ে শিল্প ও প্রযুক্তির প্রায়োগিক প্রশ্নে মুখ্যত দু’জন বাঙালির ভূমিকা আলোচিত হয়েছে। এঁরা হলেন ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প-উদ্যোগের চূড়ামণি স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এবং বিশিষ্ট রসায়নবিদ ও বিজ্ঞানী প্রফুল্লচন্দ্র রায়। সে যুগে ইঞ্জিনিয়ারিং ও শিল্পোদ্যোগের সমন্বয় সাধন প্রকল্পে বাঙালিদের দেখা পাওয়া দুষ্কর ছিল। বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রাক্তনী রাজেন্দ্রনাথ চলতি হাওয়ার বিপরীতে হেঁটে প্রমাণ করেছিলেন, একই সঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার ও উদ্যোগপতি হওয়া বাঙালি ঠিকুজিতে ঈশ্বর লেখেন না, এ কথা পুরোপুরি সত্যি নয়।

তথ্য হিসেবে এ সব কথা নতুন নয়; নতুন কোনও তত্ত্বের খোপে পুরে লেখক এই সব পুরনো কথা নতুন করে শোনালেন, তা-ও নয়। তা হলে এ গ্রন্থের গুরুত্ব কোথায়? তত্ত্ব, তথ্য আর বিষয়গৌরবের গুরুত্ব শুরু হচ্ছে গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায় থেকে, যার বিষয়বস্তু হল বাংলায় বিদ্যুতের প্রবেশ। ঔপনিবেশিক বাংলার প্রেক্ষিতে পূর্ণাঙ্গ গবেষণামূলক আলোচনায় বিদ্যুতের আলোচনা বা প্রবলেমেটাইজ়েশন সম্ভবত তিনিই প্রথম করেছেন। ১৮৯৫ সালের ‘ক্যালকাটা ইলেকট্রিক লাইটিং অ্যাক্ট’ অনুসারে, কলকাতার বিদ্যুদয়নের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রস্তাব আহ্বান করা হয়েছিল। অন্যান্য প্রতিযোগীদের সঙ্গে ১৮৯৬ সালের মার্চ মাসে ‘মেসার্স কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানি’ শহর কলকাতায় ও কলকাতা ট্রাম পরিবহণে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা পেশ করেছিল। ১৮৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে সরকার কিলবার্ন অ্যান্ড কোম্পানিকে প্রাথমিক ভাবে ২১ বছরের জন্য কলকাতায় বিদ্যুৎ সরবরাহের বরাত দেয়। পরের মাসে এর নাম বদলে ‘ক্যালকাটা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোং লিমিটেড’ বা সিইএসসি রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

কলকাতার উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়ার নাগরিক জীবনে বিদ্যুদয়ন-পুষ্ট যান্ত্রিক আলোর উদ্ভাস আর পাখার তুমুল বাতাস আরামপ্রিয় বাঙালির দিবারাত্রির কাব্যে নতুন অর্থ এনে দিল। অন্য দিকে, টানাপাখার কাজে নিযুক্ত বহু সরকারি, বেসরকারি গরিব মানুষ চাকরি হারানোর গভীর উদ্বেগের মধ্যে পড়লেন। কলকাতার সামাজিক ইতিহাসে আলোকিত ও অনালোকিত দু’ধরনের যে নগর ও নাগরিক জীবনের সৃষ্টি হল, লেখক সে বিষয়ে বিশেষ কিছু বলেননি।

চতুর্থ অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে বিদ্যুতের শৃঙ্খলিত গার্হস্থ্য জীবনের উপাখ্যান। টমাস হিউজ় পশ্চিমের শিল্পায়নের দু’টি ভিন্নধর্মী তরঙ্গের কথা বলেছিলেন। তাঁর দৃষ্টি প্রধানত বিদ্যুতের উৎপাদন আর বণ্টনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল— এমনতর অভিযোগ নিয়ে পরবর্তী কালে ডেভিড নাই প্রশ্ন করলেন, বিদ্যুদয়নের সামাজিক সঙ্কেত-চিহ্নিত সাধারণ মানুষের জীবনযাপন নতুন কী অর্থে প্রতিভাত হয়েছিল, তার বিবরণ কোথায়? বর্তমান গ্রন্থের লেখককেও আমরা একই প্রশ্ন করতে পারি। তিনি নিজেই এ প্রশ্ন তুলেছিলেন, কিন্তু যত্ন করে উত্তর দেননি। তিনি জানিয়েছেন, বিদ্যুতের ব্যবহারে কী ভাবে বাড়িঘর-রাস্তাঘাট আলোকিত হয়ে উঠল, চিকিৎসা ব্যবস্থা বিদ্যুতের আশীর্বাদে কী ভাবে উন্নততর সেবায় উত্তীর্ণ হল, কলকাতার গণপরিবহণে বিদ্যুৎচালিত ট্রামগাড়ির প্রবর্তন হল, বাংলার মফস্সল জীবন কী ভাবে দ্রুতগামী বৈদ্যুতিক ট্রেনের দ্বারা শহরের সঙ্গে সংযুক্ত হল, গঙ্গার তীরবর্তী অঞ্চলে কী ভাবে বিদ্যুৎচালিত কলকারখানা গড়ে উঠল। বিদ্যুদয়নের এই অর্থনৈতিক আশীর্বাদ আমাদের অজানা ছিল না। কিন্তু বিদ্যুৎ কী ভাবে নাগরিক জনবিন্যাস, নাগরিক শৈশব, লিঙ্গ-সম্পর্ক, দাম্পত্য, লেখাপড়া, খেলাধুলো, অবসর বিনোদন, সর্বোপরি নাগরিক জাতি, বর্ণ ও শ্রেণি-সম্পর্ক বদলে দিল, তা অজানাই রয়ে গেল। জানা হল না, বিদ্যুৎ-উত্তর আধুনিকতা কতটা পশ্চিমবাহিত আর কতটা ট্র্যাডিশন-শাসিত।

শেষ প্রশ্নটির উত্তর পঞ্চম তথা শেষ অধ্যায়ে লেখক কিছুটা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। আসলে, প্রযুক্তির ইতিহাস যতটা না যন্ত্রের কাহিনি, তার চেয়ে ঢের বেশি মানুষের যন্ত্রের প্রায়োগিক কল্পনার উপাখ্যান; যন্ত্রের সঙ্গে মানুষের সংযুক্তি বা বিচ্ছেদের কথকতা। টেলিগ্রাফ থেকে কম্পিউটার, সবই পশ্চিমের দান। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, পশ্চিমের সব দেশেই প্রযুক্তিকরণ একই সময়ে, একই ছকে প্রস্তাবিত হয়েছিল। আসলে, দেশ থেকে দেশান্তরে একই প্রযুক্তির প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন সাংস্কৃতিক চিহ্ন নিয়ে অর্থবহ হয়ে ওঠে। একই প্রযুক্তির অর্থ ও উদ্দেশ্য পৃথিবীর সর্বত্র এক নয়। সমাজ তার নিজস্ব কল্পনা আর প্রয়োজন দিয়ে একটি প্রযুক্তির উপর নিজস্ব সামাজিক মালিকানা আর সাংস্কৃতিক আধিপত্য রচনা করে। লেখক বলেছেন, উনিশ শতকের শেষ থেকেই ভারতের জাতীয়তাবাদী চৈতন্য পশ্চিমী প্রযুক্তিকে আত্মসাৎ করার পর নিজস্ব স্বপ্নসম্ভব কল্পনা আর স্বকীয়তা দিয়ে আত্তীকরণ করে ফেলেছিল। বিশ শতকের শুরুতে এই ভাবেই বাংলায় প্রযুক্তির স্বরাজ পরিকল্পিত হয়েছিল।

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিল্প পরিচালনায় বাঙালির উদ্যম ও দক্ষতার অভাব সমকালে প্রফুল্লচন্দ্র রায়, প্রমথনাথ বসু প্রমুখ অনেককেই ভাবিয়েছিল। তাঁদের মনে হয়েছিল েয, বিজ্ঞান শুধু জ্ঞানতত্ত্বের বিষয় নয়, প্রায়োগিক উদ্যোগ না থাকলে বিজ্ঞানশিক্ষা নিরর্থক। এই বিশিষ্ট মানুষদের স্বদেশভাবনা সে যুগে বেশ কিছু অনামা স্বশিক্ষিত কারিগরকে অনুপ্রাণিত করেছিল। তবুও এ দেশে শিল্পায়ন বিলম্বিত হল কেন, তা বলতে গিয়ে লেখক বহুচর্চিত ঔপনিবেশিক পরিস্থিতির প্রতিবন্ধকতার গল্প শুনিয়েছেন।

গ্রন্থের এই সব সীমাবদ্ধতার কথা উঠছে, কেননা গবেষক আমাদের প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। দেশ-বিদেশের বহু লেখ্যাগার থেকে আহৃত বিপুল প্রাথমিক তথ্য ও নানা গ্রন্থ, পত্রপত্রিকা, বিজ্ঞাপন ইত্যাদির বিচিত্র সূত্রসম্ভারের সামনে দাঁড় করিয়েছেন তিনি। কিন্তু সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রশ্ন আরও একটু শাণিত করে গড়ে তুলতে পারলে পাঠকের রসাস্বাদন সম্পূর্ণ হত। বহু বৈধ প্রশ্ন তিনি তুলেছিলেন, কিন্তু উত্তরে অনেক সময়েই মৌন থেকেছেন। তবুও এ গ্রন্থের গুরুত্ব অপরিসীম, কেননা আধুনিক ভারত নির্মাণের প্রেক্ষিতে শিল্প, শিল্পায়ন, প্রযুক্তি, কারিগর, কারিগরি, বিদ্যুৎ, বিদ্যুদয়ন ইত্যাদি বহুবিধ বিষয়ের সামাজিক ইতিহাস রচনার উদ্যোগে তিনি যে শ্রম ও নিষ্ঠা দেখিয়েছেন, তা প্রশংসনীয়।

আরও পড়ুন
Advertisement