Review

তাঁকে ঘিরে যত লেখালিখি

কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তীর ‘বাবা আর কবি’ লেখাটিতে আছে, কেমন করে হাতে-ধরে ছেলেকে বাজার করা শিখিয়েছিলেন বাবা।

Advertisement
রামকুমার মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২৫ ০৮:১৫
বহুমুখী: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতা, গদ্য, অনুবাদ, সম্পাদনায় সিদ্ধহস্ত

বহুমুখী: নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবিতা, গদ্য, অনুবাদ, সম্পাদনায় সিদ্ধহস্ত

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর জন্ম ১৯২৪ সালের ১৯ অক্টোবর ফরিদপুর জেলার চান্দ্রা গ্রামে। তাঁর জন্মশতবর্ষকে কেন্দ্র করে নানা লেখার সংগ্রহ এই বইটি। এর মধ্যে নীরেন্দ্রনাথকে ঘিরে পারিবারিক স্মৃতি থেকে তাঁকে নিবেদিত কবিতা, তাঁর সাহিত্যের সমালোচনা, সাক্ষাৎকার ইত্যাদি বিভিন্ন গোত্রের মোট ৬৮টি লেখা আছে। এই লেখাগুলির অধিকাংশই নানা পত্রপত্রিকা থেকে পুনর্মুদ্রিত। এর মধ্যে চল্লিশ বছর আগে দরবারী পত্রিকার নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সংখ্যায় প্রকাশিত আশাপূর্ণা দেবী এবং মৈত্রেয়ী দেবীর কবিতা যেমন আছে, তেমনই বছর পাঁচ-ছয় আগে প্রথম আলো-য় প্রকাশিত আলতাফ শাহনেওয়াজের নেওয়া সাক্ষাৎকারও আছে। ফলে শতবর্ষে প্রকাশিত হলেও এটি ঠিক শতবার্ষিকী আলোচনাগ্রন্থ নয়। কয়েক দশক ধরে নীরেন্দ্রনাথকে ঘিরে যে সব লেখালিখি হয়েছে, মূলত তার একটি সঙ্কলন। পাঠক ও গবেষকদের এটাই সুবিধে যে, এই একটি সঙ্কলনের মাধ্যমে নীরেন্দ্রনাথের বহুমুখী সাহিত্যকর্মের সঙ্গে অনেকখানি পরিচিত হতে পারবেন।

Advertisement

‘পারিবারিক কথা’ অংশে মোট ১২টি লেখা আছে।‌ এই পর্বে পিসতুতো দাদা দেবদাস পাঠকের লেখাটি বেশ আকর্ষণীয়। নীরেন্দ্রনাথকে ঘিরে শৈশব-কৈশোরের অনেক সুখস্মৃতি ধরা আছে লেখাটির মধ্যে। সে সঙ্গে রয়েছে গত শতকের তিন ও চার দশকের গ্রামজীবনের এক অন্তরঙ্গ ছবি, বিশেষ করে জাতপাতের প্রসঙ্গ। সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায় ‘আমার বাবা’ লেখাটিতে পারিবারিক জীবনের নানা আকর্ষণীয় বিষয়ের উল্লেখ করেছেন। তার মধ্যে একটি হল খেতে না চাওয়া বাচ্চা মেয়েকে ইংরেজি বইয়ের গল্প শুনিয়ে খাওয়ানো। শিউলি সরকারের ‘বাবাকে নিয়ে’ লেখাটিও মন ছুঁয়ে যায়। বাজারের সঙ্গী পাঁচ বছরের মেয়েকে ঠান্ডা দই আর গরম জিলিপি খাওয়াচ্ছেন বাবা, আর এমএ পরীক্ষার আগের রাতে পাওয়ার কাটের পর মেয়েকে রাত দুটো পর্যন্ত হাতপাখা করছেন।

কৃষ্ণরূপ চক্রবর্তীর ‘বাবা আর কবি’ লেখাটিতে আছে, কেমন করে হাতে-ধরে ছেলেকে বাজার করা শিখিয়েছিলেন বাবা। সেই কুমড়োই মিষ্টি হবে যার গাঢ় হলুদ গায়ের পাশে সবুজ পাড়ের মতো থাকে, আর সেই ইলিশই খেতে ভাল যার মাথা ছোট, শরীর গোল, পিঠের দিক চওড়া ও পেটের দিক পাতলা। পাশাপাশি লেখাটিতে আছে টালা ও পাইকপাড়া অঞ্চল ঘিরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, গৌরকিশোর ঘোষ, নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সজনীকান্ত দাস, শিবনারায়ণ রায়, বিমল কর, দক্ষিণারঞ্জন বসু প্রমুখ লেখকের আড্ডার কথা। একটা সময়ের লেখকবৃত্তের খণ্ড সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসও এটি। এর সঙ্গে প্রবন্ধটির দ্বিতীয় অংশে তিনি লিখেছেন শিয়ালদহ অঞ্চলের ২৪বি নুর মহম্মদ লেনের কথা, যা নীরেন্দ্রনাথকে ক্লান্তিকর রিক্ত নগরজীবনের কবি করে তোলে। তাঁর কবিতায় গ্রামজীবনের কথা আছে কিন্তু তাতে বিভূতিভূষণ বা জীবনানন্দের মতো প্রকৃতিলগ্নতা নেই। ব‍্যক্তি ও কবি নীরেন্দ্রনাথকে বুঝতে এই লেখাটি গুরুত্বপূর্ণ।

কর্মসূত্রে যাঁরা নীরেন্দ্রনাথকে খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন, তেমন কয়েকজনের লেখা আছে বইটিতে। অমিতাভ চৌধুরী শুনিয়েছেন আনন্দবাজার পত্রিকার অফিসে নীরেন্দ্রনাথের টেবিলের উল্টো দিকে বসে নানা নতুন কথা জানা ও শোনার আনন্দের কথা। লেখাটিতে ‘নিরু-ঠাকুরের পাঁচালি’ নামে পাঁচটি ছড়া আছে যার শেষ ছড়ায় নীরেন্দ্রনাথের ছন্দের অসামান‍্যতা তুলে ধরতে লিখেছেন— “ডাঙা জুড়ে চলেন তিনি/ গভীর জলের মাছ!/ ছন্দে ছন্দে চলাফেরা—/ এক দুই তিন চার পাঁচ।” সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, কবিতার ছন্দ ও নানা বিষয়ে নীরেন্দ্রনাথের কাছে শিখেছেন। শুনিয়েছেন অরুণকুমার সরকারের কথা, যিনি বন্ধুর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসায় তৎকালীন সিগনেট প্রেস থেকে নীরেন্দ্রনাথের বই প্রকাশের পথ সুগম করেছিলেন। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় কৃতজ্ঞতার সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, নীরেন্দ্রনাথের উৎসাহে তিনি প্রথম কিশোরদের জন্যে লেখেন। পবিত্র সরকার জানিয়েছেন, নীরেন্দ্রনাথের সঙ্গে বিষ্ণু দের কবিতা-সমগ্র সম্পাদনা তাঁর এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ প্রাণচাঞ্চল‍্য দেখেছেন নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর মধ্যে, সঙ্গে লক্ষ করেছেন তাঁর ‘স্থিতপ্রাজ্ঞের দায়িত্ববোধ’।

শতবর্ষে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

সম্পা: আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোনালি চক্রবর্তী বন্দ্যোপাধ্যায়

৯০০.০০

পারুলবই

প্রভাতকুমার দাস বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, নীরেন্দ্রনাথের কবিজীবনের সূচনা থেকে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রথম পর্যায় পর্যন্ত নিরুক্তপূর্বাশা পত্রিকার বিশেষ অবদান ছিল। পিনাকেশ সরকার আলোচনা করেছেন চল্লিশ ও পঞ্চাশের কবিতার মধ্যে সেতুবন্ধনে নীরেন্দ্রনাথের ভূমিকা; সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় আলোচনা করেছেন, মানবিকতার ছোঁয়ায় কেমন উষ্ণ ছিল তাঁর কবিতা। দেবারতি মিত্র লিখেছেন, নীরেন্দ্রনাথের কবিতায় নিসর্গের রূপ নিজস্ব, এক‌ই সঙ্গে আশ্চর্য ও মনোগ্রাহী।

জয় গোস্বামীর বক্তব্যের বিষয় হল, একটি কবিতার সজ্জা বা আকার পরবর্তী কালে বদলে গেলে পাঠকের কোথায় নান্দনিক সমস্যা তৈরি হয়। নীরেন্দ্রনাথের ‘স্বপ্ন-কোরক’ কবিতাটি কুড়ি বছর বয়সে জয় পড়েছিলেন আর মনে গাঁথাও হয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরবর্তী কালে কবি সে কবিতার গঠনগত পরিবর্তন করলে পাঠক হিসাবে কবিতাটির সঙ্গে তাঁর ভাবগত দূরত্ব গড়ে ওঠে। আবার তিনি উল্লেখ করেছেন নীরেন্দ্রনাথের ‘লক্ষ্মীর প্রতিমা’ কবিতায় তা হয়ে ওঠে বাস্তবের পরিপূরক। ২০১২ সালে লালগড় থেকে ফেরার সময় দু’পাশের জনমানবহীন গ্রামের এক মাকে দু’টি বাচ্চা সমেত বসে থাকতে দেখে নীরেন্দ্রনাথের ‘লক্ষ্মীর প্রতিমা’ কবিতার ‘অচঞ্চলা লক্ষ্মীর মতন’ যে মা তার কথা মনে পড়েছিল। মনে হয়েছিল, বাস্তব আর কবির ‘ভিশন’-এর মাঝে ক্রমান্বয়ে যাতায়াত করছিল ওই সময় ও সমাজ।

নীরেন্দ্রনাথের কিছু কবিতার নিবিড় পাঠ আছে বইটিতে। প্রমোদ বসু ‘স্বপ্নে-দেখা ঘরদুয়ার’ আলোচনায় বলেছেন, কাঁসাই নদী পেরিয়ে যে হেঁটে যাচ্ছে সে কবির অপর এক বিবাগী সত্তা যে চলেছে মর্তভূমের সীমা ছেড়ে অনন্তের দিকে। ‘চল্লিশের দিনগুলি’র আলোচনায় আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, নীরেন্দ্রনাথের দশক বর্ণনাতে রাবীন্দ্রিক আদর্শবাদ, নেহরুর বিশ্ববীক্ষা, এক গোত্রের উদারপন্থা ও আশাবাদী আস্তিক‍্যের ছায়াপাত ঘটেছে। অভিরূপ সরকার কবিতার পরিবর্তে ছোটদের ছড়া নিয়ে আলোচনা করেছেন। সুকুমার রায় ও অন্নদাশঙ্কর রায়ের ব‍্যঙ্গের পথ ছেড়ে নীরেন্দ্রনাথ যে রঙ্গের পথ ধরেছিলেন, তা উদাহরণ দিয়ে স্পষ্ট করেছেন। সঙ্গে উল্লেখ করেছেন, নীরেন্দ্রনাথের ছোটদের কবিতার বীজ আছে রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ-এ।

শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, নীরেন্দ্রনাথের কবিতার সবচেয়ে বড় সামর্থ্য কবিতার মধ‍্যে লুকিয়ে-রাখা গদ‍্য, যা ভিতরে ভিতরে তাঁর কবিতার মজ্জা তৈরি করে দিয়েছে। এ-ও স্মরণ করেছেন যে, গদ‍্যের ভূমিতে বেঁচে থাকা বিস্তীর্ণ পাঠকসমাজের কাছে যে কবিরা একটা সময়ে পৌঁছতে চেয়েছিলেন, নীরেন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে এক জন। তা থেকেই তাঁর কবিতার মধ্যে প্রাত‍্যহিক গদ্যের চালচলন।

এ ছাড়াও নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর বহুমুখী কাজকর্ম নিয়ে বেশ কয়েকটি ছোট-বড় আলোচনা আছে। বিশেষ ভাবে উল্লেখ করতে হয় নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর ভাষাচিন্তা এবং আনন্দমেলা সম্পাদনা নিয়ে তিনটি লেখার কথা। নীরেন্দ্রনাথের ভাষা-ভাবনার মৌলিকতা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে সুভাষ ভট্টাচার্য সুনির্দিষ্ট মতামত প্রকাশ করেছেন, আনন্দমেলা সম্পাদনা বিষয়ে শ্যামলকান্তি দাশ ও রতনতনু ঘাটি তথ্যসমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন। এ ছাড়াও নীরেন্দ্রনাথের কথাসাহিত্য, অনুবাদ, সারস্বত প্রতিষ্ঠান পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়ে‌ও একাধিক প্রবন্ধ আছে ব‌ইটিতে। রয়েছে গ্রন্থতালিকাও।

নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী দীর্ঘ জীবন পেয়েছিলেন। বিশ শতকের চল্লিশের দশক থেকে শুরু করে প্রায় পঁচাত্তর বছর ধরে লিখেছিলেন। ফলে তাঁর শতবর্ষে প্রকাশিত স্মারকগ্রন্থটি আকারে যেমন বড় হ‌ওয়ার কথা, তেমন‌ই হয়েছে এই সঙ্কলনটি। কোন‌ও কোন‌ও লেখা কিছুটা আবেগতাড়িত মনে হয়েছে। ফুলের মালা, দীপের আলো, ধূপের ধোঁয়া সব মন্দিরের মতো সাহিত্যমন্দিরেও দেখা যায়। আর এক‌টা সমস্যাও ব‌ইটি পড়ার ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে। এক‌ই তথ্য একাধিক লেখায় ঘুরেফিরে এসেছে। পুনর্মুদ্রিত লেখা বলে হয়তো সম্পাদনার পর্যায়ে বাদ দেওয়া সম্ভব হয়নি।

Advertisement
আরও পড়ুন