Book Review

যে প্রতিবেশী আপন ছিল

রোজকার জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে, আবার ভবিষ্যতের স্বপ্নে, আটপৌরে বা আকাশকুসুম যাপনে কী করে এশিয়ার ধারণা অঙ্গাঙ্গি হয়ে ছিল, তুলে ধরে এই বই।

Advertisement
অধীরা মঙ্গলগিরি
শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০২৩ ০৫:৫০
Rabindranath Tagore and Kalidas Nag on their way to China

যাত্রী: চিনদেশে যাওয়ার পথে জাহাজে রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে কালিদাস নাগ।

একুশ শতককে অনেকেই বলে থাকেন ‘এশিয়ার শতাব্দী’— চিন ও ভারতের মতো রাষ্ট্রের নেতৃত্বে এশীয় দেশগুলি বড় ভূমিকা নেবে, বাকি বিশ্বের পথ দেখাবে, এই ভাবনা বা পূর্বাভাস এর পিছনে কাজ করছে। বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ এখন এশিয়ার। তাই এশীয়রা যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও পরিবেশগত ভাবে বিশ্বের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। এ-হেন ভাবনা চার পাশে শোনাও যায় বেশ— বিশ্বের তাবড় নেতাদের মুখে, খবরের শিরোনামে। তবে আমরা কিন্তু প্রায় কখনওই তেমন ভাবতে বসি না, ‘এশিয়া’ মানে কী? শুধুই কতকগুলো জাতির সমষ্টি? জনগোষ্ঠী? পৃথিবীর ভবিষ্যতের এক বিশেষ রূপরেখা? ‘এশিয়া’ শব্দটা কি আজও অর্থবহ, বিশেষত এই মহাদেশটিতে যাঁরা বাস করেন তাঁদের কাছে? আমরা কি নিজেদের ‘এশীয়’ বলে, যে বিশাল জনগোষ্ঠী এশীয় নামে পরিচিত তাদের অঙ্গ হিসাবে ভাবি? না কি, জাতিবোধই এখন এই বিশ্বে আমাদের একমাত্র পরিচায়ক?

Advertisement

সর্বাণী গুপ্তুর লেখা নোয়িং এশিয়া, বিয়িং এশিয়ান বইটি আজকের এই সময়ে ক্রমশ জরুরি হয়ে ওঠা এই প্রশ্নগুলিকে তুলে ধরে। লেখিকা বলেন, বিশ্বায়নের জয়যাত্রা সত্ত্বেও আমরা আজ সংস্কৃতিগত ভাবে কেবল পশ্চিমের সঙ্গেই ভাব বিনিময় করি, প্রাচ্যের সঙ্গে যোগাযোগে আমাদের মনের কী এক বাধা এসে দাঁড়ায়। এশিয়ার প্রতি আমরা যেন অন্ধ, বধির। এই বইটি এশিয়া সম্পর্কে আমাদের বর্তমান ‘স্মৃতিভ্রংশ’কে সারিয়ে তুলতে চায়। আমাদের মনে করিয়ে দিতে চায় সেই সময়ের কথা, যখন ‘এশিয়া’র ধারণাকে সরিয়ে রেখে জাতি হিসাবে ‘ভারত’কে, কিংবা সমগ্র বিশ্বকেও ভাবা যেত না।

নোয়িং এশিয়া, বিয়িং এশিয়ান: কসমোপলিটানিজ়ম অ্যান্ড ন্যাশনালিজ়ম ইন বেঙ্গলি পিরিয়ডিক্যালস, ১৮৬০-১৯৪০

সর্বাণী গুপ্তু

৯৯৫.০০

রাটলেজ

বইটিতে ১৮৬০ সাল থেকে ১৯৪০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত বাংলা সাময়িকপত্র নিয়ে চমৎকার ও বিস্তারিত গবেষণা রয়েছে, যা থেকে ‘এশিয়া’ ধারণাটির নানাবিধ যে অর্থগুলি বাংলাভাষী সংস্কৃতি-পরিমণ্ডলে প্রচলিত ছিল তাদের সন্ধান পাওয়া যায়। বইয়ে ধরা এই নির্দিষ্ট সময়কালে ‘এশিয়া’-র ধারণাটি একাধারে বৌদ্ধিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রূপ পায়— বাঙালি কী ভাবে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসনের বন্ধন থেকে মুক্ত, বিশ্বনাগরিক হিসাবে ভাবত, এসে পড়ে সেই বিস্তৃত তাৎপর্যটি। লেখিকা ৩৭টি বাংলা সাময়িকপত্রে প্রকাশিত ৫৩১টি রচনা মন দিয়ে দেখে বিশ্লেষণ করেছেন, সেই সময়ের বুদ্ধিজীবীরা কী ভাবে ‘এশিয়া’র ধারণাকে বুঝতে এবং রূপ দিতে চেষ্টা করেছিলেন। এশিয়ার ধারণায় তখন যেমন ছিল একটা ঐক্যবদ্ধ অস্তিত্ব, তেমনই ছিল বহুবিধ ও বিচিত্র অতীত-বর্তমান: চিন, জাপান, কোরিয়া, বর্মা, তাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা, তুরস্ক, পারস্য এবং আরও অনেকের। আলোচ্য বইটি দেখিয়ে দেয়, সে কালে অনেক বাঙালির কাছে ঔপনিবেশিকতা-বিরোধিতা, জাতীয়তাবাদ ও বিশ্বজনীনতার বয়ান তৈরিতে এশিয়া সম্পর্কে জানা এবং নিজেদের এশীয় অস্তিত্ব সম্পর্কে ভাবনা কেমন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। জাতি হিসাবে আধুনিক ভারতের অস্তিত্ব গঠনের, এবং সেই জাতির মধ্যেও বাঙালির নাগরিক পরিচয়ের মূলমন্ত্র ছিল ‘এশিয়া’-র ধারণা।

রোজকার জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রে, আবার ভবিষ্যতের স্বপ্নে, আটপৌরে বা আকাশকুসুম যাপনে কী করে এশিয়ার ধারণা অঙ্গাঙ্গি হয়ে ছিল, তুলে ধরে এই বই। বহু বাঙালি প্রতিবেশী দেশগুলি মন দিয়ে ঘুরে ভ্রমণকথা লিখেছিলেন, মেয়েদের জন্য এবং মেয়েদের কলমেও লেখা হয়েছিল অনেক কিছু, শিশুদের জন্য লেখা হয়েছিল শিক্ষামূলক ও বিনোদনমূলক রচনা। বাঙালির কল্পনা অধিকার করে ছিল ‘এশিয়া’। ‘এশিয়া’কে বাঙালি জনসাধারণের কাছে নিয়ে আসতে রবীন্দ্রনাথের বিরাট ভূমিকার কথা এ বইয়ের পাঠককে নতুন করে বলতে হবে না নিশ্চয়ই— জাপান চিন ও বর্মায় তাঁর ভ্রমণের সুবাদে তিনি অনেক লেখা লিখেছিলেন (১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে আনন্দবাজার পত্রিকা-তেও তাঁর কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল), বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা এবং বিশেষত ‘চীনা ভবন’ তৈরির মধ্য দিয়েও এশিয়াকে বাঙালির কাছে তুলে ধরেছিলেন তিনি। তবে লেখিকা দেখাচ্ছেন, রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র, ঠাকুরবাড়ির নানা কার্যকলাপের বাইরেও এশিয়া নিয়ে একটা বড় উৎসাহ ছিল। বিশ্বপর্যটক ক্ষিতীশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সাইকেলে চিন ভ্রমণ করেন ১৯৩৫ সালে। তাঁর মতো পরিচিত মানুষ তো বটেই, তথাকথিত অখ্যাত বহু সংস্কৃতিব্যক্তিত্ব, এমনকি নাম-না-জানা অনেক মানুষ, বলতে গেলে বঙ্গীয় বৌদ্ধিক জীবনের সঙ্গে যুক্ত প্রায় সকলেই এশিয়ার ধারণাকে তুলে ধরেছিলেন নানা ভাবে। এশিয়াকে জানার সূত্রে বাঙালি লেখক ও পাঠকেরা নিজেদেরকেই আরও ভাল ভাবে জানতে পেরেছিলেন, তা সে এই পড়শি দেশগুলির মানুষের সঙ্গে নিজেদের জীবনের মিল বা তফাতগুলি খুঁজে বার করার সূত্রেই হোক, কিংবা উপনিবেশবাদের অভিঘাতকে বুঝে, ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তির উপায় সন্ধানসূত্রেই।

বাঙালি মনস্বীরা কী করে ‘এশিয়া’ নামের ধারণাটির অর্থ ও তাৎপর্যকে গড়েপিটে নিলেন, আলোচ্য বইটি সেই বিস্তারিত অন্বেষণের বাইরে আরও বেশি কিছু— বাঙালির পত্রপত্রিকা-সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। বঙ্গীয় মননজীবনে সাময়িকপত্রগুলি কেমন অপরিহার্য ছিল, এ বই সেই ছবি তুলে ধরে। সেই সময়ের জরুরি প্রশ্নগুলি তুলে ধরার, বা তাদের উত্তর সন্ধানের পরিসর হয়ে উঠেছিল এই পত্রপত্রিকাগুলি, কাছে-দূরের বাঙালি পাঠকদের মধ্যে গোষ্ঠীগত ঐক্য গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল। কোথায় বহু দূরে কোন প্রতিবেশী দেশের মানুষ, বাঙালি ঘরে ঘরে বয়স ও লিঙ্গ-নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষকে তাঁদের সম্পর্কে অবহিত করেছিল পত্রপত্রিকাগুলি। বঙ্গীয় পত্রপত্রিকাগুলিতে ফুটে ওঠে সেই ‘এনগেজড পাবলিক’-এর ছবিটি, যাঁরা বৌদ্ধিক প্রতর্কে যোগ দিতে উন্মুখ, ঘরের বাইরের বিশ্ব সম্পর্কে কৌতূহলী, এবং সবচেয়ে বড় কথা, নিজের জীবন ও ভাবনার চৌহদ্দির বাইরে ছড়িয়ে আছে যে বিচিত্র জীবন ও ভাবনারা, তাঁদের জানতে আন্তরিক ভাবে আগ্রহী।

আজ থেকে একশো বছর পর ভবিষ্যতের কোনও গবেষক আমাদের এখনকার সংস্কৃতিমাধ্যমগুলি খোঁজ করলে কী কী পাবেন? যাঁরা ভিন্ন, যাঁরা অন্য রকম, তাঁদের সম্পর্কে উপহাস, ‘মিম’, শত শত লেখাপত্রে ঘৃণার চাষ? না কি একশো বছর আগের অনেক ভারতীয়ও যেমন চেয়েছিল একটা সৎ, ন্যায়নিষ্ঠ বিশ্বকে, তা খুঁজে বার করবেন তিনি— যেমন করেছেন এই বইয়ের লেখক?

আরও পড়ুন
Advertisement