কী ভয়ানক সেই বাঁচা, সেই কাজ

সাহিত্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ অবশ্যই রসোত্তীর্ণ হওয়া। তবে লেখক যখন সচেতন ভাবে এমন নির্মাণরীতি গ্রহণ করছেন, তখন আন্দাজ হয় কেবল উত্তম রসসৃষ্টিতে তাঁর উদ্দেশ্য সীমিত নয়।

Advertisement
স্বাতী ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৭ ডিসেম্বর ২০১৯ ০০:০৯
ঐতিহাসিক: মহারাষ্ট্রের প্রান্তিক কৃষকদের লং মার্চ, মুম্বই, মার্চ ২০১৮

ঐতিহাসিক: মহারাষ্ট্রের প্রান্তিক কৃষকদের লং মার্চ, মুম্বই, মার্চ ২০১৮

কাস্তে
অনিতা অগ্নিহোত্রী
২৫০.০০

দে’জ পাবলিশিং

Advertisement

অজানা ভূখণ্ডের অচেনা লোকজন, তাদের ভাষা, খাওয়া-পরা, ধরন-ধারণ সবই অন্য রকম। তাদের উদ্বেগ-অসহায়তা বুকের মধ্যে অনুভব করতে হয় চাই সাহিত্য-সিনেমা, নইলে রাজনীতি। ‘কাস্তে’ বইটিকে বলা চলে রাজনৈতিক সাহিত্য। বিষয়বস্তুতে তো বটেই। প্রাকৃতিক সম্পদ, রাষ্ট্রের সম্পদ থেকে গরিবকে দূরে রাখার যে নিপুণ কার্যক্রমটি রাজনীতি পোষণ-তোষণ করে চলেছে, তা নিয়ে এই উপন্যাস। আখ্যান-নির্মাণের রীতিটিও রাজনীতি-প্রণোদিত। চরিত্রদের (অধিকাংশই হতদরিদ্র) জ্ঞান-বুদ্ধির নাগালে যা নেই, তা-ও যাতে পাঠক জানে-বোঝে, সেই তাগিদে লেখক কথাসাহিত্যের জঁর-বন্দি হয়ে থাকেননি। কাহিনির খোলে তথ্যের পুর গোঁজার ভনিতা না করে তদন্ত-রিপোর্টের ধাঁচে লিখেছেন, মরাঠাওয়াড়ার চিনি সমবায়ের নেতা-চাষিরা আখ-কাটা শ্রমিককে কী ভাবে দাস-শ্রমিকে পরিণত করছে। কেমন করে ব্যাঙ্ক তুলোচাষিকে ঋণ শোধের সুযোগ না দিয়ে ঠেলে দিচ্ছে দড়ির ফাঁসের দিকে। নেতা-পুলিশের প্রশ্রয়ে চলছে কন্যাভ্রূণ হত্যা।

যেমন এই অংশটি— ‘‘খরা নিয়ে এক ব্যবসার নিরন্তর চক্র চলেছে বিদর্ভ মারাঠওয়াড়ার খরাগ্রস্ত অঞ্চলগুলিতে। তার থেকে মুনাফা যারা লুঠছে, সেই জনপ্রতিনিধিরাই ঠিকেদার-শিল্পপতি, সরকার পরিচালনাও তাদের হাতে হচ্ছে। একদিকে সেচের জলে ভাগ বসাচ্ছে শিল্প, অন্য দিকে মৃত্তিকালগ্ন জলের সংরক্ষণে হাজার হাজার কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে চলেছে।’’ উপন্যাসের প্রচলিত নির্মাণ আগেও এ ভাবে ভেঙেছেন অনিতা। ‘আয়নায় মানুষ নাই’ উপন্যাসে সাত পাতা জুড়ে মুম্বইয়ে মাফিয়ারাজ আর উগ্রপন্থার ইতিহাস। এই ধাঁচেই লেখা রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অপারেশন রাজারহাট,’ স্বপন চক্রবর্তী যাকে বলেছিলেন ‘ডকু-নভেল।’ পার্থ চট্টোপাধ্যায় প্রশ্ন তুলেছিলেন এক চরিত্রের বকলমে, ‘উপন্যাস লিখতে চাও তো উপন্যাসের নিয়ম মেনে লেখো। আর গবেষণা করে অর্থনীতি-রাজনীতির তত্ত্ব খাড়া করতে চাও তো প্রবন্ধ লেখো। তা না এটা কেমন ইয়ার্কি?’ আর একটি মত, কথনের এই অবিন্যস্ত রূপ আসলে উন্নয়নের যুক্তি-সর্বস্ব নির্মাণকে চ্যালেঞ্জ।

সাহিত্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ অবশ্যই রসোত্তীর্ণ হওয়া। তবে লেখক যখন সচেতন ভাবে এমন নির্মাণরীতি গ্রহণ করছেন, তখন আন্দাজ হয় কেবল উত্তম রসসৃষ্টিতে তাঁর উদ্দেশ্য সীমিত নয়। পাঠক কেবল গল্পের রসে মজলে হবে না, তাকে অবহিত, আন্দোলিত হতে হবে। রাজারহাট বা মরাঠাওয়াড়ায় যে বিপুল অন্যায় ঘটছে দরিদ্রের সঙ্গে, তা বোঝাতে কেবল চরিত্রদের সংলাপে কুলোয় না, তাই লেখক সরাসরি সংলাপে টানেন পাঠককে (রাঘব তো ‘প্রিয় পাঠক’ সম্বোধনও করেছেন)। জরুরি তথ্য পাঠকের নজর এড়িয়ে গেল কি না, গল্পের ঘূর্ণিপাকে সে এক বুঝতে আর এক ভেবে বসল নাকি, এমন একটা উদ্বেগ কাজ করে। মরাঠাওয়াড়ার দুষ্কাল যে কেবল প্রকৃতির কার্পণ্য নয়, জনজাতির মজুরের প্রতি বর্ণহিন্দু নেতা-পুঁজিবাদীর সুপরিকল্পিত হিংসার ফল, তা বোঝাতে অনিতাও আখ্যান-স্রোতের বাইরে গিয়েছেন।

‘‘মানুষ এখানে কাস্তে। যে টাকা আগাম নেওয়া হয়েছে, তার উপযুক্ত পরিমাণ আখ কেটে বোঝাই করে তবেই কাস্তের মুক্তি। শ্রমিককে মানুষ ভাবলে কুড়ি থেকে বাইশ ঘণ্টা কাজ তাদের দিয়ে করানো সম্ভব হত না।’’ ঠিকাদার বা ‘মুকাদম’ আগাম টাকা দেয়, ছ’মাসের খরচ চলে তাই দিয়ে। সেই ধার মেটাতে তাদের আসতে হয় খরাগ্রস্ত লাতুর জেলা থেকে বহু দূরে সাতারা জেলায়। আখখেতের পাশে টোলি তৈরি করে ছ’মাস আখ কাটার কাজ করতে হয়। কী ভয়ানক সেই বাঁচা, সেই কাজ। মুকাদম ধর্ষণ করলে চেঁচানোরও উপায় নেই। দুই সন্তানের মা তের্‌না তীব্র গরমেও ডবল জামা পরে, গলা অবধি বোতাম এঁটে শোয়। দম আটকে যায় যাক, বিবস্ত্র করতে সময় লাগবে মুকাদমের, তার মধ্যে চিমটি কেটে ঘুমন্ত বাচ্চাকে কাঁদানো যাবে। বড় আপন মনে হয় এই তের্‌নাকে যখন দেখি যে টোলিতে এমন নিরাপত্তার অভাব, জলের অভাবের চাইতেও তার বেশি বুকে বাজে এক টুকরো আঙিনার অভাব। দুয়ারের বাইরেই রাস্তা, এ আবার কী?

এমন কাহিনির আশায় পাঠক দিন কাটান। আজকাল পুজোসংখ্যার গল্প-উপন্যাস পড়লে মনে হয়, সাহিত্যিক বুঝি কলম ছেড়ে চামচ ধরেছেন। বেডরুমের ছাতা-পড়া কাহিনিতে কৃত্রিম সংলাপের জ্যাম লাগানোই তাঁর কাজ। এই সময়ে আখ-কাটুনিদের টোলি থেকে অস্নাত, হতক্লান্ত তের্‌না তার ধারালো কাস্তেটি হাতে নিয়ে এসে দাঁড়াল, আর মনে করিয়ে দিল সাহিত্যের কাজটা কী। অন্য ভাষা, অন্য সংস্কৃতির দরিদ্রতম, প্রান্তিক মানুষদের এমন নিবিড় ভাবে ক’জনই বা দেখেছেন? হাতে আছে প্রফুল্ল রায়ের গোড়ার দিকের কিছু উপন্যাস, আর সতীনাথ ভাদুড়ির ক্লাসিক সৃষ্টিগুলো। তবে ‘ঢোঁড়াই’-এ মূল রসটি কৌতুকের। তাৎমা আর ধাঙড়রা কেবলই এ ওকে বিদ্রুপবিদ্ধ করে। কুমড়োয় গানহীবাবার আবির্ভাব থেকেই কাহিনি করুণ হাস্যরসে আর্দ্র। কিন্তু বিমুক্ত ‘বন্জরি’-দের নিয়ে অনিতার কাহিনি? তার রস যেন ‘মড়ি’— চিনিকলের বর্জ্য লালচে তরল যা গলা-বুক জ্বালিয়ে নামে। ‘দুষ্কাল’-এর মরাঠাওয়াড়ায় এক বিন্দু সান্ত্বনা নেই, আখ-কাটার টোলিতে আব্রু নেই এতটুকু। লেখকও রেয়াত করেন না পাঠককে। নালায় ভেসে-যাওয়া শিশুকে বাঁচাতে ঝাঁপিয়ে-পড়া মায়ের বেসামাল অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে এক ধর্ষকামী। তুলোচাষির বউকে ব্যাঙ্কে এনে ‘অন্য ভাবে’ সুদ তোলার হুমকি দিচ্ছে অফিসার।

খেটে-খাওয়া মানুষেরা আজ বাংলা সাহিত্যে কোথায়? আফসার আমেদ, অমর মিত্র, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, আনসারউদ্দিন, তন্বী হালদার, এমন কতিপয় লেখকের কিছু রচনায় তাঁদের পাওয়া যায়। অনিতার বিভিন্ন উপন্যাস, গল্পে বারবার এসেছে মেয়ে শ্রমিকরা— মুম্বইয়ের বহুতলের ফ্ল্যাটের পরিচারিকা, আন্ধেরির বিশেষ শিল্পাঞ্চলের মেয়ে-শ্রমিক, তসরগুটি থেকে সুতো বানানোর কারিগর। ইটভাটা কি আখখেতে মেয়েদের আলাদা মজুর বলে ধরা হয় না। স্বামীর কাজের হিসেবেই ঢুকে আছে স্ত্রীর কাজ। অনিতার নানা লেখায় খেটে-খাওয়া মেয়েদের ডবল-দাসত্বের জীবন। স্বামী-শ্বশুরের বশ্যতা, তদুপরি মালিক-ঠিকাদারের বশ্যতা। তের্‌নার স্বামী জানিয়ে দেয়, মুকাদম ঘরে ঢুকলে বউ তকলিফ নেবে কি মজা লুটবে সে তার ব্যাপার, কিন্তু গর্ভ যেন না হয়। তাই দুটো বাচ্চা হতেই বাচ্চাদানি খসিয়ে এসেছে বছর ছাব্বিশের তের্‌না। মরাঠাওয়াড়ার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে মূলত দু’টি সম্পদকে। জল আর নারী।

এই বইয়ের একটা প্রাপ্তি দয়া জোশীর চরিত্রটি। কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে আন্দোলনরত উকিল-অ্যাক্টিভিস্ট দয়াতাঈয়ের সাহস, সকলকে আপন করার ক্ষমতা, পরিশ্রম-শক্তি, সাংগঠনিক দক্ষতা, আবার তাঁর বিষণ্ণতা, একাকীত্ব, সন্তানের জন্য উদ্বেগ— নারী-নেতৃত্বের এই ঘনিষ্ঠ চিত্রণটির বড় অভাব ছিল বাংলা সাহিত্যে। দয়া, তের্‌না, বৈশালী-র মতো ন্যায়পিয়াসী মেয়েরা গিয়ে মিলেছে মহারাষ্ট্রের প্রান্তিক চাষিদের লং মার্চে। সেই পদযাত্রা, যা তার যাত্রাপথে ইতিহাস রচনা করতে করতে এগিয়েছে। সংবাদ তার প্রতি সুবিচার করতে পারেনি। চাষির চাহিদা আর সরকারের জোগান-ক্ষমতার হিসেব কষেছে কেবল। অনিতা অর্থনীতির ছাত্রী, কিন্তু দেখালেন যে ক’টা সুবিধের জন্য মানুষ পায়ে ফোস্কা ফেলে হাঁটে না। হাঁটে অন্যায়ের প্রতিবিধানের জন্য।

বইয়ের গতি ক্ষিপ্র। একটানে পড়া হয়ে যায়। তবু একটু খুঁতখুঁত ওই গতি নিয়েই। ‘ক্লাসিক’ হওয়ার সব উপাদান এই বইয়ের ছিল, শুধু যেন দরকার ছিল কথনে আর একটু স্থৈর্য, আরও একটু কাব্যময়তা। বিশেষত লং মার্চের অংশে। এই বই সম্ভবত ভারতীয় ভাষায় তার প্রথম সাহিত্য-বিবরণ। সাড়ে পঁচিশ পাতায় তার বিবরণ কণ্টকিত, ব্যথিত করে। তবু নিজেকে মনে হতে পারে ট্রেনের সওয়ার, সব কিছু যেন বড় দ্রুত সরে সরে যাচ্ছে। বিশেষত গ্রামের আইআইটি-পড়ুয়া চাষির ব্যাটা রঞ্জন আর তুলোচাষির বিধবা বৈশালীর রোমান্সটার একটা অতুলনীয় সম্ভাবনা ছিল। তার বোধহয় প্রয়োজনও ছিল এই নিষেধ-কণ্টকিত সময়ে। পাঠক কি লেখকের কাছে আর একটু সময় দাবি করতে পারেন না? কাহিনি কি চাইতে পারে না আর একটু প্রশ্রয়?

আরও পড়ুন
Advertisement