Jeet Ganguly

Jeet Ganguly: ‘বন্ধুরা ঠাকুর দেখতে যেত, দু’পয়সা রোজগারের জন্য আমি ছুটতাম জলসায়’

কোথাও যেন এখনও দেখতে পাই, পুরনো ছেঁড়া জামা-প্যান্ট পরে পুজোর জলসায় কাজ করতে যাওয়ার সময়টা।

Advertisement
জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
জিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০২১ ১৮:৩৫
চেষ্টা করি পুজোর সময়টা কলকাতাতেই কাটাতে। মনে-প্রাণে আমি ষোলো আনা বাঙালি।

চেষ্টা করি পুজোর সময়টা কলকাতাতেই কাটাতে। মনে-প্রাণে আমি ষোলো আনা বাঙালি।

পুজোর স্মৃতি হাতড়াতে বসলে আমার বন্ধুদের অধিকাংশেরই হয়তো মনে পড়বে, নতুন জামা, ধুনোর গন্ধ, প্যান্ডেলের প্রেম, ফুচকার টক-ঝাল স্বাদের কথা। আমারও যে সেই স্মৃতিগুলি নেই, তা নয়। তবু পুজোর কথা উঠলেই এক লপ্তে যেটা মনে পড়ে যায়, তা হল গান।

আমাদের বাড়ি ছিল বরাহনগরে। প্রতি বছর পুজোর সময়ে বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে যেতাম। প্যান্টের ভাঁজে মায়ের দেওয়া এক টাকা, দু’টাকার নোট লুকিয়ে রেখে এক প্যান্ডেল থেকে আর এক প্যান্ডেলে ঘুরে বেড়াতাম আমরা। বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে মা বলে দিত, বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বেরোচ্ছি, ঠিক আছে। কিন্তু সিঁথির মোড়ের থেকে দূরে যেন না যাই।

এ রকমই কোনও একটা বছরের কথা। বনহুগলির একটা প্যান্ডেলে ঢুকেছি। কানে এল ‘কোথা কোথা খুঁজেছি তোমায়...’। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। কত ক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, এখন আর মনে নেই। বোধহয় পুরো অ্যালবামটা যত ক্ষণ চলেছিল। যখন আচ্ছন্ন ভাবটা কাটল, দেখলাম আমার কোনও বন্ধুই আর প্যান্ডেলে নেই। চলে গিয়েছে। এই আমার পুজো। এই আমার ছোটবেলার পুজোর উদ্‌যাপন।

পুজোর কথা উঠলেই, ছোট ছোট স্মৃতি মনের মধ্যে ভি়ড় করে ফেলে। ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগিতা, বাড়িতে মিথ্যে কথা বলে অষ্টমীর আমিষ, বন্ধুদের সঙ্গে ঝগড়া, আবার তাদের সঙ্গেই ভাব। তবে ছোটবেলার সব পুজো যে খুব আনন্দে কেটেছে, এমনটা বলতে পারি না। তখন সবে মাধ্যমিক পাশ করেছি। তার আগেই বাবা দুর্ঘটনায় পড়লেন। পরিবারের জন্য আমায় কাজ শুরু করতে হল। কাজ বলতেও, সেই গান। গানের দলের সঙ্গে বাদ্যযন্ত্র বাজাতাম। বন্ধুরা ঠাকুর দেখতে যেতে বলত। যাওয়া হত না। আমি তখন ছুটতাম জলসায়। দুটো পয়সা রোজগারের জন্য।

মা লুকিয়ে কাঁদতেন। ধুনোর ধোঁয়া চোখে ঢুকে গেলেও কান্না পায়। স্বল্পস্থায়ী সে কান্নার সঙ্গে পুজোর আনন্দ মিশে থাকে। মায়ের পুজোর কান্নায় মিশেছিল আক্ষেপ। শুধুই আক্ষেপ!

তবে সেই মাকেই আবার বহু বছর পরে দেখেছি, আনন্দ ধরে না। পুজোর আগে আমার নতুন অ্যালবাম বেরিয়েছে। অ্যালবামের সিডির বাক্সে থাকা কাগজটা মাথার কাছে নিয়ে ঘুমোতে যেতাম। মা বলল, পুজোয় ওটা দেবী দুর্গার পায়ের কাছে রেখে আসতে। সে দিন আনন্দ পেতে দেখেছি মাকে। পুজো প্যান্ডেলে যখন আমার সুর করা গান বেজেছে, মা যারপরনাই খুশি হয়েছে। কান্নার দিনগুলি তখন সত্যিই অনেক অনেক দূরের মনে হয়েছে।

Advertisement
কান্না, আনন্দ আর বহু পাওয়া, না পাওয়ায় মেশা আমার পুজো।

কান্না, আনন্দ আর বহু পাওয়া, না পাওয়ায় মেশা আমার পুজো।

মনে-প্রাণে আমি ষোলো আনা বাঙালি। তাই চেষ্টা করি পুজোর সময়টা কলকাতাতেই কাটাতে। এক বার পুজোর সময়ে মার্কিন মুলুকে যেতে হয়েছিল। সেখানেও বাঙালিদের মধ্যে খারাপ লাগেনি। কিন্তু কলকাতায় থাকার মজাই আলাদা। আমি আর আমার স্ত্রী চন্দ্রাণী এখন পুজোর সময় কলকাতাতেই থাকার চেষ্টা করি। বাড়িতেই আনন্দে কেটে যায়। নবমীর পোস্তটার লোভ এখনও কমেনি।

অতীত মানুষকে ছেড়ে যায় না। সময় বদলেছে। সেই কষ্টের দিনগুলি, কষ্টের মধ্যে আনন্দ খুঁজে নেওয়ার দিনগুলি এখন অনেক দূরের। তবু তার প্রভাব আজও ছেড়ে যায়নি আমায়। এখনও তাই পুজোর কেনাকাটা করা হয়ে ওঠে না। কোথাও যেন এখনও দেখতে পাই, পুরনো ছেঁড়া জামা-প্যান্ট পরে পুজোর জলসায় কাজ করতে যাওয়ার সময়টা।

ছেঁড়া জামার সঙ্গে পুজোর আরও একটি স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। ২০০৯ সাল। উত্তর কলকাতার এক প্রেক্ষাগৃহে আমার অনুষ্ঠান শেষ করে বাড়ি ফিরেছিলাম ছেঁড়া জামা পরে। সেই জামাটি চন্দ্রাণীর কিনে দেওয়া। ও ভয় পেয়ে গিয়েছিল। যদিও সে বার জামা ছেঁড়ার কারণ ছিল ভক্তদের আদর। তবে তাতে দু’জনেরই কারও মনখারাপ হয়নি। বরং উল্টোটাই হয়েছিল।

পুজোয় চন্দ্রাণী এখনও নতুন জামা কিনে দেয়। মা’ও দেয়। ধুতি-পাঞ্জাবি পরি পুজোর ক’টা দিন। তবু টের পাই, তার তলায় এখনও চেপে বসে আছে ছেঁড়া প্যান্ট, আর তার ভাঁজে বহু যত্নে, বহু স্বপ্নে লুকিয়ে রাখা এক টাকা, দু’টাকার নোট। আমার ছোটবেলার পুজোর প্রাপ্তি। কান্না, আনন্দ আর বহু পাওয়া, না পাওয়ায় মেশা আমার পুজো।

Advertisement
আরও পড়ুন