নিজের মতো করে পোশাক, শাড়ি বানানো এক সময় নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সারা বছর এবং পুজোয় নিজেকে সাজিয়ে তুলেছি।
রূপালী বসু দারুণ কেতাদুরস্ত। দুর্দান্ত সাজেন। ওঁর সাজ সবার থেকে আলাদা। ছোট থেকে এ কথা শুনে বড় হয়েছি। আমায় হাতে ধরে কে সাজতে শিখিয়েছিলেন, জানেন? আমার বাবা। বাবা ইঞ্জিনিয়ার হয়েও খুব ভাল ছবি আঁকতেন। একই সঙ্গে পুজোয় বাবা নিজে হাতে কাপড় কেটে মেশিনে সেলাই করে জামা বানিয়ে আমাদের সাজাতেন। একজন ইঞ্জিনিয়ার নিজের হাতে জামা বানিয়ে ছেলেমেয়েদের সাজাচ্ছেন, এ রকম কথা কেউ কোনও দিন শুনেছেন? এই কারণেই চিকিৎসক পরিচিতির পাশাপাশি আমার সাজসজ্জা সবার থেকে আলাদা। বাবার মাধ্যমে ডিজাইন করা, পোশাক বানানো, মেশিন চালানো, সবই আমার নখদর্পণে। কলেজে পড়ার সময় থেকে নিজের পোশাক নিজে বানিয়ে নিতাম। রূপালী বসুর সাজে আভিজাত্য, আধুনিকতা আর বনেদিয়ানার মিলমিশ। তাই সবার থেকে আলাদা।
পরে নিজের পোশাকের পাশাপাশি অন্যের জন্য পোশাকও ডিজাইন করতাম। ১০ বছর আগে আমার তৈরি কাটপেস্ট শাড়ির প্রচণ্ড চাহিদা ছিল। কখনও তসরের জমিনে বেনারসির পাড় বসিয়ে তৈরি হত এই বিশেষ শাড়ি। অথবা কাঞ্জিভরম শাড়িতে পাড় বসত টাঙ্গাইলের। আমার জীবনে এ ভাবেই পুজোও নানা ভাবে ধরা দিয়েছে। চিকিৎসক রূপালী বসুর পুজো, ডিজাইনার রূপালি বসুর পুজো আর ছোট্ট আমি, যে দুর্গাপুরে বড় হয়েছে তার পুজো। চিকিৎসাশাস্ত্র পড়ার পাশাপাশি নিজের মতো করে পোশাক, শাড়ি বানানো এক সময় নেশায় দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। প্রদর্শনী করেছি, উপহার দিয়েছি প্রচুর। একই ভাবে সারা বছর এবং পুজোয় নিজেকে সাজিয়ে তুলেছি।
আবার এই রূপালীই কলকাতায় এসে কলেজে পড়া থেকে পরিচিত চিকিৎসক হয়ে ওঠা পর্যন্ত একটা দীর্ঘ সময় পুজো থেকে দূরে থাকত। এত ভিড়, হুল্লোড়, ধাক্কাধাক্কি করে ঠাকুর দেখা সত্যিই ভাল লাগত না। বরং সেই সময় মনে পড়ে যেত দুর্গাপুরের দুর্গাপুজোর কথা। ছোটখাটো, আধুনিক শহরে ঘরোয়া পুজো হত। বন্ধুরা মিলে সারা দিন ঠাকুর দেখে বেড়াতাম। অষ্টমীর সকালের অঞ্জলি, ভোগ খাওয়া, কিছুই বাদ যেত না। আর ছিল পুজোর গান, পুজো সংখ্যা। ১৫-১৬ বছর বয়স তখন। গান শুনতে ভালবাসতাম। খাতায় তালিকা বানিয়ে রাখতাম, কী কী গান বেরোচ্ছে সন্ধ্যা-হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, শ্যামল মিত্রের। সে সব জোগাড় করে শুনতাম। আর ছিল পর্দা টাঙিয়ে ছবি দেখা। সে যেন পরম পাওয়া! পাড়া থেকে খোলা আকাশের নীচে পর্দা টাঙিয়ে ছবি দেখানো হচ্ছে। দেখতে দেখতে আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। নিজের অজান্তেই সাত সমুদ্র তেরো নদি পেরিয়ে কল্পনার দুনিয়ায় হারিয়ে যেতাম।
পুজোর প্রতি নতুন করে আকর্ষণ তৈরি হল পুজোয় বিচারক হওয়ার পর থেকে। ফাঁকায় ফাঁকায় প্রতিমা, প্যান্ডেল, তার অপূর্ব কারুকাজ দেখার সুযোগ হতেই মনে হল, কলকাতার পুজো ততটাও বোধ হয় মন্দ নয়।
এ বার আসি চিকিৎসক রূপালী বসুর কথায়। এমনও অনেক পুজো গিয়েছে, অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়ার মুখে হাসপাতাল থেকে জরুরি তলব। অঞ্জলি না দিয়েই ছুটেছি কাজে। এখন যদিও বিজ্ঞানের কল্যাণে ফোন, হোয়াটসঅ্যাপ, ই-মেলের সাহায্য নিয়ে ঘরে বসেই সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়। কাজ না থাকলে সপ্তমী পর্যন্ত সবার সঙ্গে থাকি। দুপুর দুপুর বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুরও দেখতে বেরোই। অষ্টমীর সকাল থেকে বিজয়ার আগে পর্যন্ত সূর্যও আমায় দেখতে পায় না! পুজোর বাকি দিনগুলো এ ভাবেই শুধু আমার আমি।
এ বারের পুজোয় আমার সাজে শাড়ির পাশাপাশি থাকবে কুর্তা, কাফতান টপ, পালাজো, ট্রাউজার্স। কারণ, অতিমারি যায়নি। তাই এমন পোশাক বাছতে হবে, যা সহজে ধুয়ে নেওয়া যায়। এ বছর টিয়া-সবুজ, ঘিয়ে, গোলাপি, নীলের সব স্তর এবং কমলা রং পোশাকে রাজত্ব চালাবে। পোশাকের সঙ্গে দু’ভাবে নিজেকে সাজাব। একটি রেট্রো লুক। পাশে সিঁথি কেটে হাত খোঁপা। তাতে দু'টি বড় ফুল গোঁজা। নয়তো ভাল করে চুল সেট করে খুলে দেওয়া। সঙ্গে মানানসই বড় কানের দুল অথবা গলার হার। একটি পরলে আরেকটি বাদ। কব্জিতে সোনার ঘড়ি। চোখ আঁকব ভাল করে। ন্যুড লিপস্টিক। ছোট্ট টিপ। এই সাজ আমার কাছে যথেষ্ট। খাওয়া দাওয়ায় একমাত্র ভাত, রুটি বাদ। বেশি জোর দেব মাছ, মাংসের বিভিন্ন পদের উপর। চিংড়ি মাছ দিয়ে পেঁয়াজকলি বড্ড প্রিয়।
(লেখক পেশায় চিকিৎসক)