মফসস্লের জল, হাওয়ায় বেড়ে উঠলেও কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না এমনটা নয়।
আমার ছোটবেলাটা কলকাতায় কাটেনি। আমি বর্ধমানের ছেলে। বর্ধমান এখন অনেক উন্নত হলেও আমি যখন ছোট ছিলাম তখন মফসস্লই বলা হত। মফসস্লের জল, হাওয়ায় বেড়ে উঠলেও কলকাতার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না এমনটা নয়। আমার অনেক আত্মীয়রাই উত্তর কলকাতায়, সল্টলেক ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন। ফলে উৎসব-অনুষ্ঠানে মাঝেমাঝেই আসা যাওয়া লেগেই থাকত। এখন যেমন ছুটি পেলেই লাদাখ বা মলদ্বীপ চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু যখন বর্ধমানে থাকতাম তখন ঘুরতে যাওয়া মানেই নিকো পার্ক, সায়েন্স সিটি, অ্যাকোয়াটিকা।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে যখন হেরিটেজ কলেজে এসে ভর্তি হলাম তখন থেকেই শুরু হয় আমার কলকাতা যাপন। কলেজে পড়ার সময়ে আমি বিজয়নগরে থাকতাম। পুরোপুরি দক্ষিণ কলকাতা। প্রথম প্রথম এই দক্ষিণী পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে একটু অসুবিধে হত। তবে মফসস্লের মানুষ হল জলের মতো। যখন যে পাত্রে রাখা হয়, সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। ধীরে ধীরে আমিও তাই এই পরিবেশের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম।
অভিনয় করার স্বপ্ন আমি ছোট থেকেই দেখতাম। একটা সময়ের পর বুঝতে পারলাম স্বপ্ন সত্যি করতে হলে আমার এক মাত্র গন্তব্যে কলকাতা। কলেজে ভর্তি হওয়ার আগেও বাবার হাত ধরে বর্ধমান থেকে পোর্টফোলিও জমা দিতে টালিগঞ্জে আসতাম। স্টুডিওগুলিতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতাম। কাজ মিটতে মিটতে রাত হয়ে যেত। আবার শেষ ট্রেন ধরে বর্ধমানে ফিরতাম। প্রায় দিনই বর্ধমান-কলকাতা যাতায়াত করতাম।
২০১০ সালে মুক্তি পায় আমার প্রথম ছবি ‘কেল্লাফতে’। তার পর থেকেই গোটা শহরটা আমার কাছে কেমন যেন নতুন ঠেকতে লাগল। আগে যখন মন খারাপ হলে কলকাতার আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। ২০১০ সালের পর থেকে আকাশের দিকে তাকাতে গেলে চোখ হোঁচট খায় আমার ছবির হোর্ডিংয়েই। কী অদ্ভূত না!......
সিনেমা দেখতে আমি বরাবরই ভালবাসতাম। কত বার যে কলেজের ক্লাস কেটে সিনেমা দেখতে গিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। লেকটাউনের ‘জয়া’-তে প্রায়ই চলে যেতাম। ক্লাসের বদলে ভিক্টোরিয়া, ময়দান তো বটেই গোটা কলকাতা জুড়েই বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম।
এখন সেই দিনগুলি খুব মনে পড়ে। বিখ্যাত হয়ে যাওয়ার পর অনেক কিছুতেই বিধিনিষেধ চলে আসে। ইচ্ছা থাকলেও সব সময় বিভিন্ন কারণে তা হয়ে ওঠে না। ওই জায়গাগুলির সামনে দিয়ে গাড়ি করে যখন যাই কাচের জানলার এ পাড় থেকে আমার ফেলে আসা সেই সময়টাকে দেখতে পাই।
প্রেমের সপ্তাহ শুরু হয়ে গিয়েছে। আর কলকাতা তো আদ্যপান্ত প্রেমের শহর। বেহিসাবী প্রেমের সাক্ষী কলকাতা। কলেজ জীবনে আমারও প্রেম এসেছিল। কলকাতার রাজপথে ধরে প্রেমিকার হাতে হাত রেখে হেঁটে গিয়েছি বহু দূর। এখন হাঁটার সুযোগ হয় না। তবে ঐন্দ্রিলাকে নিয়ে মাঝে মাঝেই লং ড্রাইভে বেরিয়ে পড়ি।
ইংরেজিতে যাকে ‘সেকেন্ড হোম’ বলে, কলকাতা আমার কাছে তাই। বর্ধমানে আমি জন্মেছি। বড় হয়েছি। স্বাভাবিক ভাবেই ওই জায়গাটির প্রতি একটি নাড়ির টান রয়েছে। তাই বলে কলকাতাকে আমি কম ভালবাসি না। আমার জীবনের সব প্রাপ্তিযোগ এই শহরটার হাত ধরে ঘটেছে। ব্যর্থতা যে আসেনি বলব না। তবে সব কিছুকে পিছনে ফেলে মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি আমি কলকাতা থেকে পেয়েছি। এই শহরের মানুষ আমাকে ভালবেসে আপন করে নিয়েছে। আজ আমি যা কিছু করতে পেরেছি তাতে এই শহরের অবদান বিশাল। কলকাতাই আমাকে নায়ক অঙ্কুশ বানিয়েছে।