শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে পৌঁছে আমি প্রথম প্রথম তো দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়তাম।
আমার কলকাতা যাপন মানে প্রথম দিকে মফসস্ল। ঠিকানা ছিল দমদম ক্যান্টনমেন্ট, গোরাবাজার। কলকাতা-২৮। তখন সেই পাড়াটাই ছিল আমার পৃথিবী। তার বাইরে আমার শহর চেনার খুব একটা সুযোগ ছিল না। আমি বাড়ির সামনেই একটি ক্যাথলিক স্কুলে পড়তাম। অক্সিলিয়াম কনভেন্ট। স্কুল আর বাড়ি ছাড়া খুব বেশি এ দিক-ও দিক যাওয়ার সুযোগ হত না।
তার পর অক্সিলিয়াম থেকে পার্ক সার্কাসের ডন বস্কো স্কুলের ফেস্টে যখন যাওয়া শুরু করলাম তখন থেকেই এই ব্যস্ততম শহরটা চেনা শুরু। পার্ক সার্কাসের ওই জনবহুল রাস্তা পার হতেই কত ক্ষণ সময় চলে যেত। দাঁড়িয়েই থাকতাম। তবে ছোটবেলায় দক্ষিণের চেয়ে উত্তর কলকাতাই আমার বেশি ভাল লাগত। উত্তর কলকাতার স্বাদ পেয়েছি বাবা মায়ের হাত ধরে। মা-বাবার সঙ্গে মিনার, বিজলী, প্রাচীতে মাঝেই মাঝেই সিনেমা দেখতে যেতাম।
তারপর ধীরে ধীরে কিশোরী থেকে তরুণী হলাম। স্কুলের পালা চুকল। কলেজে ভরতি হলাম। কলেজে পড়ার সময় থেকেই আমার বৃহত্তর কলকাতাকে চেনার শুরু। শ্যামবাজারে আমার কলেজ ছিল। শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়ে পৌঁছে আমি প্রথম প্রথম তো দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়তাম। পাঁচ দিক থেকে গাড়ি আসছে। এত মানুষ জন। কলেজের রাস্তা ভুলে যেতাম বলে নেতাজির মূর্তি দেখে মনে রাখতাম। মূলত বাসে করে কলেজ আসতাম। কোনও দিন হয়তো কোনও কারণে মূর্তি না দেখতে পেয়ে আমি আমার গন্তব্য থেকে এগিয়ে গিয়ে নামতাম। আমি এমনিও রাস্তাঘাট খুব একটা মনে রাখতে পারতাম না। স্নাতক প্রথম বর্ষের এক পরীক্ষায় আমার সিট পড়েছিল সিটি কলেজে। আমি ভুল ট্রেনে উঠে শিয়ালদহে নামার বদলে সোজা ক্যানিং চলে গিয়েছিলাম। সে কী বিড়ম্বনা!
সেই প্রথম কফি হাউস চেনা। কলেজ থেকে বন্ধুদের সঙ্গে কলেজ স্ট্রিট আসা। একা একা নিউমার্কেট চত্বর চষে ফেলা। তার আগে বাবার সঙ্গে হয়ত দু-এক বার এসেছিলাম পুজোর বাজার করতে। তবে নিজের মতো করে কলকাতা চেনার সেই শুরু। কলেজ থেকে ক্লাস কেটে সিনেমা দেখতে যেতাম। কোনও দিন আগে ক্লাস শেষ হয়ে গেলে হেদুয়ায় আড্ডা মারতে যেতাম। আমার মনে আছে বন্ধুদের সঙ্গে প্রথম বইমেলা যাওয়া। একটু একটু করে কলকাতা আপন হয়ে উঠছিল। বিশেষ করে উত্তর কলকাতা।
দক্ষিণ কলকাতার সঙ্গে তখনও আমার খুব একটা পরিচয় হয়নি। আমার পিসির বাড়ি ছিল যাদবপুরে। মাঝেমধ্যে সেখানে যেতাম। তবে অভিনয় জীবন শুরু হওয়ার পর আমার দক্ষিণ কলকাতার সঙ্গে একটা সম্পর্ক তৈরি হল। সবগুলি স্টুডিয়ো যেহেতু দক্ষিণে, ফলে শ্যুটিং করতে যেতেই হত।
কলকাতা বলতেই আমার এই শহরের শিল্প-সংস্কৃতির কথাই সবার আগে মাথায় এসে। যখন কলেজে পড়তাম তখন ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, বইমেলা, নাটক দেখা, নন্দনে সিনেমা দেখতে যাওয়া— এ ভাবেই সময় কাটত আমার।
তবে এখন পরিবর্তনের কলকাতায় আমি কাজ ছাড়া খুব একটা বেরোই না। শহর আগের চেয়ে অনেক বেশি ঝাঁ চকচকে হয়েছে। আধুনিক হয়েছে। পাশাপাশি হাঁটার বদলে এখন কাচ ঢাকা কাফেতে প্রেম করার চল হয়েছে। প্রেমের কথা বলতেই আমার একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমি কলেজে পড়তাম এবং একটি প্রেম করতাম। মনে আছে সেই পাঁচমাথার মোড়ে গোলবাড়ির কষা মাংস নিয়ে প্রেমিকের জন্মদিনে অপেক্ষা করেছিলাম। সেটা অনেক ক্ষণ। এই ছুটে চলা শহরে সেই অপেক্ষার বড় অভাব।