আপনি এত খারাপ লেখেন কেন! কফি হাউসে এই প্রশ্ন শুনে ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলাম।
আমার শৈশব ও বাল্যবেলাটা কেটেছে ঠিক কলকাতায় নয়, কলকাতা ঘেঁষা একটি জায়গায়। বাঙুর অ্যাভিনিউতে। যদিও পিনকোডে এই জায়গাটি কলকাতার মধ্যেই ছিল। তবুও তখন বাঙুর অ্যাভিনিউকে মফস্বলই বলা হত। সেই সময় এখনকার মতো এত বড় বড় বাড়ি ছিল না। এক ফালি জমিতে তৈরি একতলা বাড়িতেও ছিল অগাধ আনন্দ। অফুরন্ত আকাশ ছিল। দিগন্তবিস্তৃত মাঠ ছিল। এক দীঘি জল ছিল। বর্ষাকালে জল জমত, ব্যাঙ ডাকত, আরও কত কী!
বাঙুর থেকে বাসে উল্টোডাঙার দূরত্ব ছিল সাত-আট মিনিটের।কখনও সখনও আত্মীয়ের বাড়ি ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাবা মায়ের সঙ্গে কলকাতা যাওয়া হত। স্মৃতি যদি খুব বেইমানি না করে তবে মনে হচ্ছে পুজো দেখতেও বার দুয়েক কলকাতা যাওয়া হয়েছিল।
এরপর...
শৈশব পেরিয়ে আমি যখন কৈশোর আর তারুণ্যের মাঝমাঝি, সেই সময় আমি গিয়ে পড়লাম একেবারে সত্যিকারের কলকাতায়। কলকাতার সঙ্গে তৈরি হল আমার রাগের সম্পর্ক, অনুরাগের সম্পর্ক। একদিকে ঝগড়ার, অন্যদিকে অভিমানের সম্পর্ক। কলকাতা ছাড়া ভাবতে পারতাম না। কলকাতা তখন আর শুধু শহর নয়, উন্মুক্ত বিশাল এক পৃথিবী হয়ে গেল।
তখন তো একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি থেকেই কলেজে পড়তে হত। ভর্তি হলাম উত্তর কলকাতার স্কটিশচার্চ কলেজে। এখানে এসে বুঝলাম কলকাতার সবচেয়ে দর্শনীয় হল মানুষ। এই শহরে সংকীর্ণতার অভাব আছে। যেকোনও বিষয়ই সবাই ভীষণ বড় করে ভাবার চেষ্টা করে। আমিও একটা ভাবনার পরিসর পেলাম।
কলকাতার প্রত্যেকটি অলিগলি কিছু গল্প বলে যায়। আমার ব্যক্তিগত প্রেম পর্যায়ের একটা বিশাল অংশ গলিতে ঘুরেই কেটেছে। এরকমও হয়েছে, কলেজে নাটক আছে আর আমরা চারজন বন্ধু মিলে যাওয়ার পথে কোনও এক ফাঁকা গলিতে দাঁড়িয়ে মহড়া দিয়ে নিলাম। পরে শুনেছিলাম বাদল সরকারও নাকি মাঝে মাঝে ফুটপাথে নাটক করতেন।
কলকাতায় গিয়ে প্রথম জানলাম শুধু ফুচকা,আলুকাবলি নয় কিংবা আয়না, চিরুনি, ফিতে ইত্যাদি মনোহারি জিনিসের মতো বইও পাওয়া যায় ফুটপাথে। কত দুষ্প্রাপ্য বই কলেজস্ট্রিট ও পার্কস্ট্রিটে পথের ধুলোয় সাজিয়ে রাখতে দেখেছি। কোনও একটি বই হাতে তুলে হয়ত দেখেছি যে আমারই লেখা বই, যাঁকে দিয়েছিলাম তাঁর হাত ঘুরে কী ভাবে যেন এই ফুটপাথে চলে এসেছে।
বইয়ের কথা বলতেই বইপাড়া নিয়ে একদম প্রথম দিককার একটি মজার একটি ঘটনা আমার মনে পড়ে গেল। যতদূর মনে পড়ছে ২০০৩ সাল নাগাদ। এক দিন এই দুপুর দুপুর নাগাদ আমি কফি হাউসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। তখনও আমি ঠিক ততটাও পরিচিত মুখ নই। সবে একটা কি দুটো বই বেরিয়েছে। ফলে জনমানসের আমাকে এক দেখায় চিনে ফেলা অসম্ভব। কিন্তু কলেজের এক দল ছেলেমেয়ে কী ভাবে যেন আমাকে চিনে ফেলল। সদ্য সদ্য তখন আমার একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইয়ের নামটা আমি নিচ্ছি না। সেই দল থেকে একটি ছেলে এগিয়ে এসে আমাকে সেই বইটির নাম উল্লেখ করে জানতে চাইল আমিই লেখক কি না। আমি তো এদিকে মনে মনে তখন উত্তেজনায় ফুটছি। নায়ক তো নই, লেখক অথচ তাও আমাকে এক চান্সে চিনতে পেরেছে ভেবেই আমার কেমন শিহরণ হচ্ছিল। আমি তো মুখিয়ে আছি ছেলেটি কী বলে শোনার জন্য। ছেলেটি আমাকে বলল, ‘‘আপনি এত খারাপ লেখেন কেন? খুব খারাপ লেখেন! হয় লেখার ধরন বদলান নয়তো আপনি লেখা-টেখা ছেড়ে দিন।’’ এটা শুনে খানিক ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেও পরে কিন্তু আমার বেশ মজাই লেগেছিল। কারণ কলেজষ্ট্রিটে দাঁড়িয়ে এর পর আমি অসংখ্য অটোগ্রাফ দিয়েছি। এই কলেজস্ট্রিটেই তরুণ মজুমদার আমাকে বলেছেন আপনার গল্প নিয়ে আমি আরও ছবি বানাতে চাই। ততক্ষণে চাঁদের বাড়ি সিনেমা হলে চলে এসেছে। মিত্র ও ঘোষের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রকাশন থেকে আমার বই করতে চান বলে প্রকাশক আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। সব তো এই বইপাড়াতেই ঘটেছে। সেই দিনের মতো মজার ঘটনা কিন্তু আর কখনও ঘটেনি।
বইপাড়ার আরও একটি সুন্দর জিনিস হল পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন। কোভিডের কারণে গত দু’বছর হচ্ছে না। তবে নববর্ষে মানেই বইপাড়ায় প্রকাশক আর লেখকের মিলনোৎসব। এটা কলকাতার একটা বিশাল ব্যাপার। সেদিন গোটা এলাকা জুড়ে শুধু নামকরা লেখকরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ওই গলি দিয়ে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় হেঁটে যাচ্ছেন, ওইখান দিয়ে শঙ্কর চলেছেন, সেই গলি দিয়ে হেঁটে আসছেন সমরেশ মজুমদার, ওই দিক দিয়ে ঢুকছেন বাণী বসু। এক পয়লা বৈশাখে আনন্দ পাবলিশার্সে গিয়ে দেখলাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় হইহই করে সকলের সঙ্গে বসে আড্ডা দিচ্ছেন। তখন মনে হয় যে এ শুধু কলকাতাতেই সম্ভব হয়।
কলকাতাতেও অনেক অসুবিধে। হাঁটতে গেলে পায়ে হোঁচট খেতে হয়। শহর জুড়ে লোকে লোকারণ্য। রাস্তায় বেরোলেই গাড়ির প্যাঁক প্যাঁক আওয়াজ। কিন্তু আমি হলফ করে বলতে পারি কলকাতার মতো প্রাণ আর মন পৃথিবীর কোনও শহরে নেই।