সে কালের জমজমাট থিয়েটার পাড়ায় এখন গেলে কান্না পায়।
ঢাকা থেকে যখন কলকাতায় আসি, তখন আমার পাঁচ বছর বয়স। সবে তখন একটু একটু করে বুঝতে শিখছি। তখনকার কলকাতার কথা খুব স্পষ্ট মনে নেই। এখন ভাবতে বসলে আবছা স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। একটি নতুন জায়গায় এসে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল। ঢাকায় থাকাকালীন স্কুল থেকে আসা যাওয়ার পথে ছাড়া শহরটিকে আলাদা করে চেনবার খুব বেশি সুযোগ ছিল না।
কলকাতায় এসে প্রথম ট্রাম দেখলাম। বাস, গাড়ি, ট্যাক্সির ভিড়ে মানুষকে হারিয়ে যেতে দেখলাম। তবে এখনকার মতো যানজট তখন ছিল না। প্রায় বছর খানেক মতো বালিগঞ্জে কাকার বাড়িতে ছিলাম। তার পর সেখান থেকে বাবা মায়ের সঙ্গে মধ্যপ্রদেশ পাড়ি দিলাম।
আমার যখন দশ বছর বয়স, তখন মধ্যপ্রদেশ থেকে আবার কলকাতায় এলাম পড়াশোনা করতে। কলকাতায় ফিরে বেলুড়ের একটি স্কুলে ভর্তি হলাম। বাড়ির সামনেই স্কুল। তাই তখনও খুব বেশি এ দিক-ও দিক যাওয়ার সুযোগ ছিল না। তবে ঠাকুমার দু’-একটি ফাইফরমাশ খাটতে এখানে-ওখানে যাওয়ার ছা়ড় পাওয়া যেত। বেলুড় একে বারে কলকাতার মধ্যেকার না হলেও গঙ্গার ও পারে যতদূর দেখা যেত, সেটাই আমার কাছে কলকাতা ছিল।
এই বেলুড় যাপনও আমার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। প্রায় দু’বছর মতো বেলুড়ে থাকার পর হঠাৎ এক দিন আমার টাইফয়ে়ড ধরা পড়ল। মা এসে আমাকে আবার মধ্যপ্রদেশ নিয়ে চলে গেলেন। তবে সেখান থেকে মাঝেমাঝে গরমের ছুটিতে আমি আর আমার ছোটভাই কলকাতায় আসতাম। বরাহনগরে একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। এসে সেখানেই থাকতাম। তখন থেকেই আমার সিনেমা দেখার ঝোঁক চেপেছিল। উত্তম-সুচিত্রার নাম জানতে পারলাম।
তার পর এক দিন পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে এলাম। আমরা তখন থাকতাম উল্টোডাঙার মুরারী পুকুর রোডে। সেখানে থাকার সময়েই আমি থিয়েটার করতে শুরু করলাম। ধীরে ধীরে আমার অভিনয় জীবন শুরু হল।
দূরদর্শনে নাটক করতাম প্রথম দিকে। টালিগঞ্জে রাধা ফিল্ম স্টুডিয়ো, পরে দূরদর্শনের প্রথম অফিস হয়েছিল। চোখের সামনেই সেই পরিবর্তন আমি দেখেছি। আমি রাধা ফিল্ম স্টুডিয়োতে প্রথম গিয়েছিলাম ‘ভানু পেল লটারি’ ছবির শ্যুটিং করতে। এই প্রসঙ্গে আমার একটি কথা মনে পড়ছে। শুরুর দিকে বাবা আমার সঙ্গে যেতেন শ্যুটিংয়ে। সেই রকমই এক দিন স্টুডিয়োতে এসে জানতে পারলাম, প্যাকআপ হতে রাত হবে। বাবা বাসে করে টালিগঞ্জ থেকে উল্টোডাঙা গিয়ে বাড়িতে খবর দিয়ে আবার আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরেও এসেছিলেন। এখন এই ব্যস্ততম শহরে আধ ঘণ্টার বদলে আট ঘণ্টা লাগলেও আমি অবাক হব না।
ধীরে ধীরে আমার তারুণ্যের কলকাতার বদল ঘটতে দেখলাম। তার পর এক দিন আমার বিয়ে হল। স্বামীর হাত ধরে এসে উঠলাম উত্তর কলকাতার বাগবাজারে। আমার শ্বশুরবাড়িতে। সেখান থেকেই একে বারে দক্ষিণে যেতাম শ্যুটিং করতে। ওই সময়টা গাড়িতে যেতে যেতে শহরটাকে দেখতাম।
স্টার থিয়েটার থেকে আমার প্রথম মঞ্চাভিনয়ের শুরু। তবে সেখানে ছবি বিশ্বাস, তুলসী চক্রবর্তী, সুখেন দাস, বসন্ত চৌধুরী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়— সব রথী মহারথীদের মধ্যে গিয়ে পড়েছিলাম। সকলেই খুব সাহায্য করতেন। ওখানে তিন-চার বছর কাজ করার পর ছবির কাজ এত আসতে লাগল যে, ছে়ড়ে দিতে বাধ্য হলাম। কিন্তু নাটকের সঙ্গ আমি ছাড়িনি। ধীরে ধীরে থিয়েটার পাড়া আর স্টুডিয়োই আমার ঘরবাড়ি হয়ে উঠল। রং মহল, বিশ্বরূপা, বিজন থিয়েটার— সব ক’টি হলেই অভিনয় করার সুযোগ হল। তবে সে কালের জমজমাট থিয়েটার পাড়ায় এখন গেলে কান্না পায়। বিশেষ করে এই কোভিডের জন্য একেবারে খাঁ খাঁ করে গোটা এলাকা। অর্ধেক হল তো শপিং মল হয়ে গিয়েছে।
অল্প অল্প করে সিনেমা দেখার নেশা যখন আমাকে পেয়ে বসেছে, সেই সময়ে খুব উত্কম-সুচিত্রা জুটির সিনেমা দেখতে যেতাম। তার পর হঠাৎ এক দিন এঁরাই আমার সহ-অভিনেতা হয়ে গেলেন। ‘বিপাশা’ ছবিতে প্রথম সুচিত্রা সেনের সঙ্গে কাজ করলাম। সেই ছবিতে উত্তমদাও ছিলেন। তবে আমার সঙ্গে কোনও দৃশ্য ছিল না। ‘দেয়া নেয়া’ করার সময় থেকে উত্তমদার সঙ্গে ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
বম্বে থেকেও অনেক বার ডাক এসেছিল। কিন্তু আমি এই কলকাতা ছেড়ে, স্টুডিয়ো পাড়া ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। আগের চেয়ে কাজের ধরন বদলেছে, পরিবেশ বদলেছে। স্টুডিয়ো পাড়াগুলিও আর আগের মতো নেই। তবুও এখন যখন শ্যুটিং করতে সেই জায়গাগুলিতে যাই, আমি কিন্তু সেই পুরানো কলকাতার গন্ধ পাই। কিশোরী বেলাটা খুঁজে পাই। চোখ বুঝলে মনে পড়ে, একটি নতুন মেয়েকে কী ভাবে আপন করে নিয়েছে এই সিনেমা পাড়া, এই কলকাতা। এই কলকাতা শহরের কাছে আমার ঋণের শেষ নেই। এখন বয়স হয়েছে, সেই ভাবে হুটহাট করে আগের মতো আর বেরিয়ে পড়তে পারি না। তবে অন্তত কলকাতার জল, হাওয়া গায়ে মেখে আগামী দিনগুলি কাটাতে পারব ভেবে মনকে সান্ত্বনা দিই।