ভার্সের রাস্তায় ছবি সৌজন্যে: সুচরিতা সেন চৌধুরী
তখন বেশ বৃষ্টি কলকাতায়। শীত উধাও হলেও হালকা একটা আমেজ রয়েছে। মার্চ মাসের শুরু। আমার আবার বৃষ্টি দেখলেই মনটা পাহাড়-পাহাড় করে ওঠে। বেরিয়েও পড়ি। পরিকল্পনা বিশেষ করার প্রয়োজন হয় না। একটা ডেস্টিনেশন ঠিক করে পৌঁছে গেলেই হল। তার পরে বাকিটা ঠিক হয়ে যায়।
সে বারও তেমনটাই হয়েছিল। ও ভাবেই খুঁজে পেয়েছিলাম ভার্সে। কেউ কেউ যদিও বার্সেও বলেন। পশ্চিম সিকিমের এক ছোট্ট ট্রেকিং রুট। পেলিংয়ে এক রাত কাটিয়ে ভার্সে ট্রেকিংয়ের উদ্দেশে পৌঁছে গেলাম সোমবারিয়া। নয়াবাজার, লেগশিপ, জোরথাং-সহ পশ্চিম সিকিমের একটার পর একটা জনপদ পেরিয়ে যাওয়া। ভার্সে ট্রেকিং শুরু হয় হিলে থেকে। থাকা যায় হিলেতে। এ ছাড়া অনেকে থাকেন ওখড়েতেও। কিন্তু সোমবারিয়ার অসাধারণ সুন্দর কাঠের বাংলোর টান উপেক্ষা করতে পারিনি আমরা। সেখানে পৌঁছনোর পর যে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তা কখন থেমেছিল জানি না।
সকালে উঠে দেখি আকাশ পরিষ্কার না হলেও বৃষ্টি কমেছে। তাই ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়ে পড়লাম। যেতে হবে হিলে। সেখান থেকেই শুরু ট্রেক। অল্প সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। ভার্সে রডোডেনড্রন স্যাংচুয়ারিতে ঢুকতে হলে অনুমতি নিয়ে টিকিট কেটে ঢুকতে হয়। রাতে থাকতে হলে এক রকম। আর দিনের দিন গিয়ে ফিরতে হলে আর এক রকম। সব সেরে হাঁটা শুরু হল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পায়ে হাঁটা পথ।
সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কে ঘেরা এই জঙ্গলে রয়েছে হেমলক, সিলভার ফার, ম্যাগনোলিয়া এবং রডোডেনড্রন গাছের আধিক্য। আগের রাতে প্রবল বৃষ্টির কারণে তখনও ভেজা পাহাড়। গাইড জানালেন, ভোর-রাত পর্যন্ত টানা বৃষ্টি হয়েছে। যে কারণে পিচ্ছিল হয়ে রয়েছে রাস্তা। খুব সাবধানে পা ফেলতে হচ্ছে। মাঝে মধ্যেই পা ‘স্কিড’ করছে। আমাদের গাইড সমস্যার কথা বুঝতে পেরে গাছ থেকে ডাল ভেঙে সকলের হাতে ধরিয়ে দিয়েছে। তাতে কিছুটা সুবিধে হচ্ছে বটে! বৃষ্টির জন্য পাহাড়ের গা দিয়ে তৈরি হয়েছে ছোট ছোট ঝরনা। গাছ থেকে টুপটাপ জল পড়ছে গায়ে মাথায়।
স্যাঁতসেঁতে পরিবেশের মধ্যে দিয়ে যতই এগোচ্ছি ঠান্ডা বাড়ছে।কিন্তু চমক যে কয়েক পা দূরেই অপেক্ষা করছিল তা কে জানত! চার কিলোমিটার রাস্তা বলে ছবি তুলতে তুলতে হেলতে দুলতেই চলেছি। আগেই বলেছি গাছ থেকে বৃষ্টির জল পড়ছিল। হঠাৎই মাথায় ভারী মতো কী একটা যেন পড়ল! পথ চলার সময় কে আর আকাশের দিকে তাকিয়ে চলে। তার উপর এই জঙ্গলে আকাশ দেখার উপায় নেই, পুরো গাছে ঢাকা। কিন্তু এ বার তাকাতেই হল। অবাক হওয়ার শুরু এখান থেকেই। তাকিয়ে বুঝলাম গাছ থেকে মাথায় এসে পড়েছে বরফ। পুরো গাছটা বরফে সাদা হয়ে রয়েছে।
সামনে যত দূর চোখ গেল গাছের গায়ে লেগে রয়েছে বরফ। মার্চ মাসে বরফ! তা-ও আবার একদম টাটকা। বোঝা যাচ্ছে কিছু ক্ষণ আগেই তুষারপাত হয়েছে। গাইড বললেন, ‘‘বরফ দেখে মনে হচ্ছে আজ সকালেই হয়েছে। কাল সারারাত বৃষ্টি হয়েছে বলেই এই অসময়ের তুষারপাত।’’ সমতলের লোকেদের বরফ আদিখ্যেতার কথা তো সকলেরই জানা। তবে ভাল লাগার সঙ্গে বাড়ল সমস্যা। কয়েক পা এগোতেই দেখা গেল পুরো রাস্তা বরফে ঢাকা। সেই বরফ পেরিয়েই যেতে হবে। কিন্তু কারও পায়ে বরফে হাঁটার মতো জুতো নেই। মার্চ মাসে কে জানত, বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে হবে! গাইডও বললেন, ‘‘মার্চ মাসে তুষারপাত অস্বাভাবিক ঘটনা।’’
বিপদ আরও বাড়ল। এমনিতেই রাস্তা পিচ্ছিল থাকার কারণে পা ‘স্কিড’ করছিল। বরফে সেটা কয়েক গুণ বেড়ে গেল। কোনও রকমে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে চলা। তবে বরফের উপর দিয়ে হাঁটার মজাটা লিখে বোঝানো যাবে না। ‘পা পিছলে আলুরদম’ও হল কেউ কেউ। চার কিলোমিটার রাস্তা পৌঁছতে লেগে গেল ৪ ঘণ্টারও বেশি। কিন্তু যখন প্রথম বরফের দেখা পেয়েছিলাম, তার পর থেকে আর পরিষ্কার রাস্তা পাইনি। পুরোটাই ছিল বরফে ঢাকা। আনন্দ, শঙ্কা সব সঙ্গে করেই পৌঁছে গেলাম ভার্সে। খানিকটা ‘প্লেন ল্যান্ড’-এর উপর তৈরি হয়েছে একমাত্র থাকার জায়গা গুরাস কুঞ্জ। কাঠের ছোট্ট একটা বাড়ি। কিন্তু অসাধারণ সুন্দর।
গুরাস কুঞ্জের চার দিকেও ছড়িয়ে রয়েছে বরফ। তার মধ্যেই আমাদের আড্ডা জমে গেল গরম গরম চা আর মুড়ি-চানাচুর মাখা দিয়ে। সেই সময় বৃষ্টি আর তুষারপাতের জন্য ওই চত্বরে তাপমাত্রাও নিম্নমুখী ছিল। আর বেলা যত বাড়ছিল ততই তার পতন হচ্ছিল। যত ক্ষণ হাঁটছিলাম, অত বুঝতে পারিনি। হাঁটা শেষ হতেই টের পেলাম ঠান্ডার বহর। তবে আফসোস হচ্ছিল গুরাস কুঞ্জে থাকার পরিকল্পনা না থাকায়। ও এখানে বলে রাখি, আমরা এতটাই ‘লাকি’ ছিলাম যে বরফ এবং রডোডেনড্রন দুটো একসঙ্গে পেয়েছিলাম।
স্থানীয় ভাষায় রডোডেনড্রনকে গুরাস বলা হয়। আর সেই নামেই এই থাকার জায়গা। সেখানেই অনেক গাছে ফুটে রয়েছে থোকা থোকা রডোডেনড্রন। বেশির ভাগই লাল রঙের। হলুদ, সাদা, বেগুনি রডোডেনড্রনও দেখেছি, তবে সেটা ইয়ুমথাংয়ে। এখানে সবই ছিল টকটকে লাল। মার্চ-এপ্রিল রডোডেনড্রনের মরসুম। তখন সবে ফোটা শুরু হয়েছে। অকাল তুষারপাতে খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা।দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পা রাখতেই গাইড তাড়া দিলেন। এ বার ফিরতে হবে। অন্ধকার নেমে গেলে এই পথে বিপদে পড়তে হবে।
সত্যিই তাই। জঙ্গল ঢাকা পথে অন্ধকার সব সময় আগেই নামে। এখানে সূর্যের আলো পৌঁছয় না। গুরাস কুঞ্জ আর ভার্সের মায়া ত্যাগ করে ফেরার পথ ধরতেই হল। পথের বরফ অনেকটাই গলে গিয়েছে। কোথাও কোথাও তখনও রয়েছে। বিশেষ করে গাছের গায়ে। কিন্তু বরফ গলে যাওয়ায় রাস্তা আরও পিচ্ছিল হয়েছে। সেই পথেই ফিরতে হল। ফেরার পথে অনেক কম সময় লাগল। তত ক্ষণে সূর্য অস্ত গিয়েছে। আকাশের রং তখনও লাল। জঙ্গলে অন্ধকার আগেই নেমেছিল। তখন মোবাইল ফোন না থাকলেও টর্চ থাকত সঙ্গে। তা জ্বালিয়েই ফেরা শেষ কিছুটা রাস্তা।
হোটেলের ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করলাম, বরফে হাঁটার জুতো না থাকায় সকলেরই পা কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ‘ফ্রস্টবাইট’-এর প্রাথমিক পর্যায়। গরম জলে পা ডুবিয়ে রেখে, তেল, ক্রিম মালিশ করে কিছুটা স্বস্তি পাওয়া গেল। সঙ্গে একাধিক মোজা পরে কম্বলের তলায় পা ঢুকিয়ে বসে থাকার পরামর্শ দিলেন হোটেলের লোকেরা। সেই রাত সোমবারিয়া কাটিয়ে পর দিন নেমে গেলাম সমতলে।কী ভাবে যাবেন— নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সরাসরি ভার্সের দূরত্ব ১৪৬ কিলোমিটার। পৌঁছতে সাধারণত সময় লাগার কথা তিন ঘণ্টা। কিন্তু রাস্তার পরিস্থিতির উপর সময়টা নির্ভর করে পাহাড়ে। সরাসরি গাড়ি রিজার্ভ করে বা পেলিং অথবা পশ্চিম সিকিমের যে কোনও জায়গা থেকে সহজে পৌঁছনো যায় সোমবারিয়া, ওখড়ে বা হিলেতে। সেখানে থাকার ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের জায়গা রয়েছে।
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy