বড়ামাঙ্গওয়া বাংলো
পাহাড়ি পাকদণ্ডিটা যেখানে থমকে যায় সেখান থেকে নীচে দেখা যায় খরোস্রোতা তিস্তা। ব্রিজের উপর দাঁড়িয়ে পরের গাড়ির অপেক্ষা করতে করতে দিদির দোকান থেকে কোল্ড ড্রিঙ্কসে চুমুক দিই। তখনও বেজায় গরম লাগাটা লেগে রয়েছে গায়ে। তবে মনের দরজায় তত ক্ষণে পৌঁছে গিয়েছে শীতল পাহাড়ি পরশ। আর মাত্র কিছু ক্ষণের অপেক্ষা। পৌঁছে যাব আমার সেই বারান্দায়। যেখানে থমকে গিয়েছে আকাশ। আমার একলা আকাশ। সঙ্গে একরাশ ভাললাগা, ভালবাসা লেপ্টে থাকে গায়ে গায়ে।
একা যাব শুনে বাড়ির সকলেই ভ্রু কুঁচকেছিলেন। কিন্তু আমি যখন স্থির করে নিয়েছি, তখন কে আটকায়? কোভিডের প্রথম ঢেউ তখন বেশ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে। ঠিক করলাম এ বারের বছর শেষ আর শুরুটা পাহাড়েই কাটাব। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। দার্জিলিং মেল সকাল সকালই পৌঁছে দিল নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। নেমেই টের পেলাম পর্যটকদের ঢল নেমেছে। তার আগে থেকেই খবরে দেখেছিলাম অবশ্য। তবে আমার ভালবাসার বারান্দায় ভিড় হওয়ার অবকাশ নেই। সাকুল্যে চারটে ঘর সেখানে। ও আসল কথাটাই তো বলা হয়নি, যাচ্ছি বড়ামাঙ্গওয়া।
তিস্তা বাজারে পৌঁছেছিলাম কালিম্পং যাওয়ার শেয়ার গাড়িতে। গ্যাংটকের শেয়ার গাড়িতেও যাওয়া যায় তবে তাতে ভাড়া বেশি পড়ে। তিস্তা বাজার থেকে ফার্ম হাউসের গাড়ি আমাকে পৌঁছে দিল বড়ামাঙ্গওয়া। মিনিট ৪৫-এর রাস্তা। যেখানে নামলাম সেখান থেকে হেঁটে বেশ খানিকটা উঠতে হবে ফার্ম হাউস পৌঁছতে হলে। আগে থেকেই আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এক জন। আমার ব্যাগটিও তিনিই নিলেন আর আমি চললাম তাঁর পিছু পিছু।
ধান জমি, স্থানীয় লোকেদের বাড়ি পেরিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে পৌঁছে গেলাম ফার্ম হাউসে। ঘরে ব্যাগপত্তর রেখে সেই চিরচেনা প্রিয় বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। যা মুহূর্তে আমাকে সব কোলাহল, শহুরে টানাপড়েন, পেশার চিন্তা থেকে এক ধাক্কায় দূরে সরিয়ে দেয় সব সময়। সঙ্গে সঙ্গে এসে গেল কাচের কাপে দার্জিলিং চা। এক চুমুকেই সব ক্লান্তি উধাও। বাকি ক’টা দিন কাটবে এখানেই। শুয়ে, বসে, গ্রামের রাস্তায় হেঁটে, স্থানীয়দের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে।
বড়ামাঙ্গওয়া ফার্ম হাউসে প্রকৃতির সঙ্গে মিলবে সুস্বাদু খাবার। সবজি থেকে ভাত, দুধ থেকে ফল— সবই ফার্মের নিজস্ব। তাই ভেজালের কোনও জায়গাই নেই। সঙ্গে অসাধারণ রান্না। উচ্ছেভাজা থেকে কোয়াশের সবজি, শাক ভাজা থেকে চিকেন কারি— একদম বাড়ির রান্না। শেষ পাতে মিলবে পায়েস বা দই। পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে লাঞ্চ জমে যাবে। সারা রাতের ট্রেন জার্নির পর একটু গড়িয়ে নিলাম। হাতে এখনও অনেকগুলো দিন নিজের মতো পাহাড়ের সঙ্গে সময় কাটানোর, তাই প্রিয় ঘুমের সঙ্গে অন্যায় করা যাবে না।
প্রথম দিন গড়িয়ে, বারান্দায় বসেই কেটে গেল। বিকেলে চা আর পকোড়া নিয়ে বারান্দায় বসলাম। সূর্য অস্ত গেল তিস্তার জলের রং বদলে। অন্ধকার নামতেই উল্টো দিকের পাহাড়ের সব আলো জ্বলে উঠল এক এক করে। জানতে পারলাম ওই পাহাড়টা কালিম্পং। একরাতে ওই পাহাড়ে চন্দ্রোদয়ও দেখলাম অবাক হয়ে। একরাতে দেখলাম আকাশ চিরে বজ্রপাত। যার পর পুরো কালিম্পং শহর অন্ধকারে ডুবে গেল। সে রাতে আর আলো ফেরেনি।
ডিসেম্বরের শেষ বলে বড়মাঙ্গওয়ার কমলালেবু বাগান ফলে ভরে উঠেছিল। পর দিন বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম সেখানে। এত লেবু যে গাছের পাতাই দেখা যাচ্ছে না। সেখানেই রয়েছে ফলের নানান জিনিস তৈরির কারখানা। সেখানকার কমলালেবুর জুস খেলে সারা জীবন মুখে লেগে থাকবে। খেলাম সঙ্গেও নিলাম। রাস্তায় দেখা হল স্থানীয়দের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে গ্রামের রাস্তায় হেঁটে বেড়ালাম। শুনলাম ওদের জীবনযুদ্ধের কথা। ফার্ম হাউস থেকে সঙ্গ দিচ্ছিল যে কুকুরের দল অন্ধকার নামতে ওরাই পথ দেখিয়ে ফিরিয়ে আনল ঘরে। রাতের পাহাড়ে আলোর রোশনাই যেন অকাল দীপাবলির আয়োজন করেছে। ব্যালকনিতে বসে সেই আলো-আঁধারিতেই ভাসিয়ে নিয়ে গেল মেঘের দল। তত ক্ষণে ব্যালকনির দখল নিয়েছে তারা। ঠান্ডার কামড়ে ফিরতেই হল ঘরে। ঘুম এল এক স্বপ্ন রাজ্যে।
কীভাবে যাবেন:
শিয়ালদহ অথবা হাওড়া থেকে ট্রেনে নিউজলপাইগুড়ি এবং বিমানে বাগডোগরা—এই দু’ভাবে শিলিগুড়ি পৌঁছনো যায়। সরাসরি যেতে চাইলে ফার্ম হাউস থেকে গাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। না হলে গ্যাংটক বা কালিম্পংগামী গাড়িতে তিস্তাবাজার পৌঁছলে সেখান থেকে ফার্ম হাউসের গাড়ি গন্তব্যে পৌঁছে দেবে।
খরচ:
ফার্ম হাউসে থাকার জন্য দু'টি চার বেডের ও দু'টি তিন বেডের ঘর আছে। ভাড়া কম-বেশি ১৬০০ থেকে ২০০০-র মধ্যে ঘোরা-ফেরা করে।
খাওয়ার প্যাকেজে সকালের চা, ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চ, বিকেলের চা ও ডিনার এক একজনের ৬০০ টাকা করে। বিকেলে স্ন্যাক্স নিলে আলাদা।
এখান থেকে দার্জিলিং, কালিম্পং, কার্শিয়াং, লামাহাটা, ত্রিবেণী দিনে দিনেই ঘুরে আসা যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy