মোবাইল থাকলেও আজকাল ক্যামেরা না হলে চলে না।
আমাদের স্মৃতির একটা বড়ো অংশ জুড়ে থাকে শুধুই বেড়ানো। নিত্য দিনের হাজারটা হাঙ্গামা থেকে খুঁটে তোলা সযত্ন সঞ্চিত ছুটির দিনগুলোর বিনিময়ে, তাই তো বারে বারে ছুটে যাওয়া আমাদের পরিচিত পরিধির বাইরে, অদেখা অচিনের সন্ধানে। ছোট ছোট খণ্ডদৃশ্যে ভাগ হয়ে সেই স্মৃতিগুলোই চিরজীবনের মতো জমা থাকে আমাদের মনের কোঠায়। সেই টুকরো সুখস্মৃতিকে সময় সময় উস্কে দিতেই আমাদের ক্যামেরা ঘাড়ে ঘোরাফেরা। শুধু কি তাই! যে জায়গাটা দেখে এলাম, যে অচেনাকে চিনে এলাম, তাকে বন্ধুবান্ধব পরিজনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতেও তো সেই ফটোগ্রাফিই বড়ো ভরসা। বেড়াতে গেলে পরিবারপিছু অন্তত একটা ক্যামেরা না হলে হয় নাকি!
ছবি মোবাইলেও ওঠে। যাত্রাপথে তা সঙ্গেও থাকে। আজকাল একটা ভাল মোবাইল ফোনে যে কোয়ালিটির ছবি ওঠে, কুড়ি বছর আগের একটা মাঝারি ভাল ক্যামেরাতেও সে ছবি তোলা শক্ত ছিল। তবু, মোবাইলের সীমাবদ্ধতা অনেক। তা ছাড়া ক্যামেরা, ক্যামেরাই। শুধু ছবি তোলার জন্যেই ক্যামেরা তৈরি হয়। দামের আর ধরনের তারতম্যে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকলেও, এর একটা আলাদা আভিজাত্য আছে। তাই বেড়াতে গেলে সঙ্গে একটা ক্যামেরা থাকবে না, এ যেন ভাবাই যায় না।
এখন প্রশ্ন হল, বেড়ানোর বিভিন্ন দৃশ্যপটে কোথায় কোন ধরনের ক্যামেরা আর তার কী কী অ্যাকসেসরিজ বা অনুষঙ্গ উপযোগী। যেমন পাহাড়ের পটভূমিতে অন্তত ২৫০ বা ৩০০ মিমি ফোকাল লেংথের একটা টেলিফটো লেন্স না হলেই নয়। উঁচু উঁচু বরফে ঢাকা দূরের পাহাড়চুড়োগুলোয় তো সব সময়ে ওঠা যাচ্ছে না, তা হলে সেই বরফে ঢাকা হিমবাহগুলোকে পাথরগুলোর খাঁজ-ভাঁজ-নকশা সমেত হাতের মুঠোয় এনে দেবে কে? আবার সেটাই যদি জঙ্গলে দাঁড়িয়ে পাখির কী পশুর ছবি হয়, তবে তো এই টেলিফটোটাই হওয়া উচিত কম করে ৪০০ মিমি ফোকাল লেংথের। বনের পাখিরা শকুন্তলার আশ্রমের আদুরে বিহঙ্গটি নয়, যে গায়ে পড়ে লুটোপুটি খাবে। আবার সব পশুরাও জিতেন্দ্রিয় যোগী নয় যে আমি-আপনি ঘাড়ের কাছে এসে তাক করে ছবি তুলছি দেখলেও দাঁত খিঁচিয়ে তাড়া করবে না বা ল্যাজ তুলে ভাগবে না। পাহাড়ে বা জঙ্গলে টেলিফটো যেমন অপরিহার্য, ঠিক তেমনই বেড়াতে গেলে ল্যান্ডস্কেপ, স্থাপত্য বা সৌধের ছবি তুলতে নর্মাল লেন্স এবং ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল লেন্স লাগবেই লাগবে। সীমিত জায়গায় ঘরের ভিতরে মানুষজনের ছবি তুলতে গিয়ে, স্থাপত্যের শৈলী তুলতে বা মিউজিয়ামের গ্যালারিতে ক্যামেরা ব্যবহার করতে গিয়ে ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল লেন্সের প্রয়োজনীয়তা বোধ করেননি, এমন মানুষ একটাও নেই। কাজেই বাইরে কোথাও ঘুরতে গেলে, টেলিফটো, ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল এবং নর্মাল এই তিন ধরনের লেন্সই দরকার।
আরও পড়ুন: পুজোয় আপনার বোকা বাক্সকে এই ভাবে করে তুলুন স্মার্ট
বিশেষ গন্তব্য অনুসারে এই চাহিদার সামান্য তারতম্য হতেও পারে। যে দিন থেকে জুম-লেন্সের ব্যবহার বেড়েছে, সামান্য ছবির কোয়ালিটির সঙ্গে আপোস করে ছবি তোলার সুবিধা হয়েছে বিস্তর। কারণ জুম-লেন্স টেলিফটো, ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল এবং নর্মাল লেন্সের মতো নির্দিষ্ট ফোকাল লেংথের ‘প্রাইম’ লেন্স নয়। জুম-লেন্সে ফোকাল লেংথের একটা রেঞ্জ থাকে। ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল-জুম হলে যেমন হয়তো ১৬-৩৫ মিমি বা ১০-২২ মিমি, আবার টেলি-জুম হলে সেটাই হয়তো ৭০-৩০০ মিমি বা ২০০-৫০০ মিমি। প্রাইম লেন্সে তোলা ছবির ফলাফল ক্ষেত্রবিশেষে জুম-লেন্সের থেকে অপেক্ষাকৃত ভাল হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও, জুম-লেন্সের সব থেকে বড়ো সুবিধা নিজে না এগিয়ে-পিছিয়ে ফ্রেম ছোটবড় করা যায়। মানে যে পটভূমির ছবি তোলা হচ্ছে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাকে এগোনো বা পিছোনো যায়।
প্রাইম লেন্সে সেটা করতে হলে নিজেকে এগোতে বা পিছোতে হবে, যে পরিসর না-ও থাকতে পারে। বেড়াতে যাওয়ার ক্ষেত্রে বেশি সংখ্যক আলাদা আলাদা প্রাইম লেন্স নেওয়ার বদলে একটা বা দুটো জুম লেন্স নেওয়া সব সময়েই সুবিধাজনক। যাঁরা বেড়াতে যাচ্ছেন যদি জুম-লেন্স নিয়ে যান নিশ্চয় চেষ্টা করবেন এমন দুটো বা তিনটে জুম-লেন্স নিতে যাতে ওয়াইড-অ্যাঙ্গেল থেকে টেলির দিকে অনেকটা ফোকাল লেংথ বিরতিহীন ভাবে ব্যবহার করা যায়। যেমন ১৮-৫৫ মিমি আর ৫৫-২৫০ মিমি সঙ্গে নিলে যিনি ছবি তুলছেন তিনি ১৮ থেকে ২৫০ মিমি পর্যন্ত ফোকাল লেংথ অবাধে ব্যবহার করতে পারবেন।
সাধারণ ভাবে যারা কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন তাঁদের দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যারা বেড়ানোর জন্যেই বেড়াতে যাচ্ছেন, যাঁদের কাছে ছবি তোলাটা মুখ্য নয় কিন্তু ভ্রমণের একটা অপরিহার্য অনুষঙ্গ। আর অন্য দলে তাঁরা যাঁরা মূলত ছবি তোলার জন্যেই বেড়াতে যাচ্ছেন। বেশির ভাগ পর্যটক প্রথম দলেই পড়েন। এঁদের পক্ষে সব থেকে সুবিধে হবে ব্রিজ ক্যামেরা ব্যবহার করা। ব্রিজ ক্যামেরা বলতে আমরা কী বুঝব? যে ক্যামেরা উচ্চবংশীয় ডিএসএলআর নয় আবার বালখিল্য এইম-অ্যান্ড-শুট ক্যামেরাও নয়। এই দু’ধরনের ক্যামেরার দুস্তর ফারাকের মাঝখানে সেতু বন্ধন করছে ‘ব্রিজ’ ক্যামেরা। ব্রিজ ক্যামেরা, লেন্স-বডি-ফ্ল্যাশ মিলিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। ক্যামেরা থেকে লেন্স কখনওই আলাদা করা যায় না। কিন্তু ব্রিজ ক্যামেরার জুম রেঞ্জ খুব বেশি। হয়তো ২৫ মিমি থেকে ৪০০ মিমি বা ২৪ মিমি থেকে ৬০০ মিমি। এই ধরনের সুপার জুম লাগানো থাকার জন্যে গিরি-মরু-পারাবার সর্বত্র মোটামুটি সব ধরনের ছবি অবলীলায় তোলা সম্ভব।
আরও পড়ুন: আপনার মোবাইলের বিমা করানো আছে তো?
এর উপরে আবার লেন্স ফিল্টারের প্যাঁচে অতিরিক্ত ওয়াইড বা টেলি কনভার্টার, প্রয়োজনে সুপার ম্যাক্রো অ্যাডাপ্টরও লাগিয়ে নেওয়া যায়। ক্যামেরা হালকা, একটা যন্ত্রই সব রকম ছবির জন্যে যথেষ্ট। দামও সাধারণের ধরাছোঁয়ার মধ্যেই। ব্রিজ ক্যামেরার মধ্যে যেমন ক্যানন-এর পাওয়ার শট, সোনি-র সাইবার শট, নিকন-এর কুলপিক্স, প্যানাসোনিক-এর লুমিক্স ইত্যাদি সিরিজের খুবই ভাল কাজ চলে গোছের ক্যামেরা (হাই-ডেফিনিশন ভিডিয়ো তোলার ক্ষমতা সমেত) ১৭/১৮ হাজার থেকে ৩৫ হাজার টাকার মধ্যে। আজকাল কিছু বেশি দামি ব্রিজ ক্যামেরা বেরিয়েছে। ৫০ হাজার থেকে সওয়া লাখ টাকার মধ্যে যেমন সোনি-র RX10 III বা প্যানাসনিক-এর FZ 1000/2000 ইত্যাদি যা আনকোরা শিক্ষানবিশ থেকে কুশলী ফোটোগ্রাফার সবাই ব্যবহার করতে পারেন, এবং সামান্য কিছু বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এই ক্যামেরাগুলোয় তোলা স্টিল বা ভিডিয়ো গুণমানের দিক দিয়ে অবশ্যই একটা মাঝারি দামের লেন্স সমেত ডিএসএলআর ক্যামেরার সমকক্ষ।
এ বার আসি দ্বিতীয় দলের ক্ষেত্রে, যাদের বেড়ানোর মুখ্য কারণটাই ছবি তোলা। তাঁরা অনেকেই হয়তো পছন্দ করবেন লেন্স সমেত ডিএসএলআর ক্যামেরা অথবা আরও আধুনিক মিরর-লেস কমপ্যাক্ট ক্যামেরা। আমাদের দেশে নিকন, ক্যানন, সোনি এই ধরনের ক্যামেরা বা লেন্সের জন্যে জনপ্রিয়। এই দু’ধরনের ক্যামেরারই দাম লেন্স আর ক্যামেরার রকমফেরে সাধারণত ৩৫-৪০ হাজার থেকে দেড়-দু’লাখের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। একটা ভাল ডিএসএলআর ক্যামেরার বডি, টেলি, ওয়াইড ও অন্যান্য বিশেষ লেন্স সমেত পুরো কিট ৩ থেকে ৪ লাখে গিয়েও দাঁড়াতে পারে। ব্রিজ ক্যামেরার তুলনায় এই ধরনের ক্যামেরাগুলোর সেন্সর আকারে বড়ো, শাটার ল্যাগ কম, ফোকাসিং দ্রুততর ইত্যাদি। বেশি দামি লেন্স ব্যবহার করলে আরও ভাল চোখ ধাঁধানো ছবি হতে পারে যা ব্রিজ ক্যামেরার সীমাবদ্ধতায় হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু এই সব ক্যামেরার ক্ষেত্রে প্রাথমিক শিক্ষাটা খুব জরুরি। কাজেই ডিএসএলআর বা মিররলেস ক্যামেরা তাঁরাই পছন্দ করবেন যাঁরা ভাল মতো ছবি তোলেন আর নিয়মিত অভ্যাস রাখেন।
ক্যামেরা আর লেন্স ছাড়াও যে দুটো অনুষঙ্গের কথা ভ্রমণকালীন প্রয়োজনীয়তার জন্যে ভাবা যেতে পারে, তারা হল ক্যামেরাস্ট্যান্ড আর ফ্ল্যাশ। ফ্ল্যাশ দরকারের সময়ে আমাদের অতিরিক্ত আলোটুকু জোগায়। ব্রিজ ক্যামেরার মাথার কাছে ধরে নেওয়া যায় কয়লাখনির হেলমেটের মতো বিল্ট-ইন ফ্ল্যাশ একটা থাকবে। অনেক ডিএসএলআর-এও তাই। এই ধরনের ফ্ল্যাশ আলোর অভাব মোটামুটি কাজ চালানোর মতো মিটিয়ে দেবে। এর উপরেও যাঁরা ফ্ল্যাশ নেওয়ার কথা ভাববেন, তাঁরা আধুনিক পরিবর্ত হিসেবে এলইডি ভিডিয়ো-লাইট নেওয়ার কথা ভাবতে পারেন। এই ধরনের আলো ফ্ল্যাশের মতো ঝলকানি নয়, স্থির হয়ে জ্বলা আলো যা প্রয়োজনে ক্যামেরা থেকে খুলেও দৃশ্যপটের যেখানে খুশি বসিয়ে দেখা যায় ছবিটা কেমন আসছে। ভ্রমণসঙ্গী ধরেও থাকতে পারেন সুবিধেমতো দৃশ্যকোণে। ফ্ল্যাশও খুলে নিয়ে ব্যবহার করা যায় নেওয়া যায়, তবে তার হ্যাপা অনেক। এলইডি আলো রিচার্জেবল, অথবা সাধারণত পেনসিল-ব্যাটারিতেও চলে। ওই একই আলো প্রয়োজনে এমার্জেন্সি লাইট হিসেবেও কাজে দেবে। আর ভিডিয়ো তুলতে গেলে তো এই আলোই ভরসা, সেখানে ফ্ল্যাশগানের কোনও ভূমিকাই নেই। ক্যামেরার সঙ্গে ডেডিকেটেড বড়ো উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন ফ্ল্যাশগান তোলা থাক পেশাদার ফটোগ্রাফারদের জন্যে।
বেড়াতে যাওয়ার সময়ে একটা ক্যামেরা-স্ট্যান্ড নেওয়া অত্যন্ত জরুরী, যার পোশাকি নাম ট্র্যাভেল-ট্রাইপড। ব্রিজ ক্যামেরার জন্যে ছোট পকেট ট্রাইপডও পাওয়া যায়। ক্যামেরার আর তার লেন্সের মাপ, ওজন, আকৃতি ইত্যাদি বুঝে নিয়ে যত দূর সম্ভব হালকা, গুটিয়ে যাওয়া (ফোল্ডেবল) অথচ নিজের পায়ে থিতু থাকবে এমন স্ট্যান্ডই বেছে নিতে হবে। আজকাল গোরিলা ট্রাইপড বেরিয়েছে যায়। এর পাগুলো বেঁকে নিজের জায়গা করে নিয়ে ভাল মতো বসে যায়। এই ধরনের ট্রাইপড ভ্রমণের জন্যে খুব সুবিধাজনক। আলোর অভাবে অপেক্ষাকৃত অপ্রভ প্রকৃতির পটভূমিকায়, সেলফ টাইমারে নিজেকে শুদ্ধ দলের ছবি তুলতে, ভিডিয়ো তুলতে বা এরকম অনেক ক্ষেত্রে ট্রাইপড একটা বড়ো সহায়ক।
ক্যামেরা, লেন্স, বা তার অনুষঙ্গ যাই নেবেন, বিরক্তিহীন ভাবে পুরো যাত্রাপথটা বইতে পারা চাই। আর সবার উপরে যেটা সত্যি, ক্যামেরা, লেন্স, অতিরিক্ত আলো সব কিছুরই পূর্ণ ব্যবহার আমাদের অধিগত থাকা একান্ত দরকার। একালের যে কোনও ডিজিটাল ক্যামেরা একেকটা শক্তিশালী বহুমুখী যন্ত্র। বাইরে যাওয়ার আগে একবার ভাল মতো বুঝে নেওয়া উচিত তার প্রতিটি আলাদা সেটিং ঠিক কখন প্রয়োজন আর তাকে কী ভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যুধিষ্ঠিরের হাতে গাণ্ডীব ধরিয়ে দিলে তিনি ‘যুদ্ধে স্থির’ হয়েই থাকতেন, একটা অস্ত্রও চালাতে হত না। গাণ্ডীব যখন হাতে তুলেছেন, তখন আপনি অর্জুনই হোন।
মেঘ কেটে আসছে, কাশ-আকাশ আর অবকাশের সময় ঘনিয়ে এল। চলুন বেরিয়ে পড়ি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy