স্মৃতির পুজো বিষয়ে কিছু বলতে গেলে আমার মনে পড়ে ইস্কুলজীবনের কথা। সাতের দশকে আমি স্কুলে পড়তাম। কোনও দিনই ভাল ছাত্র ছিলাম না। ভুল বললাম। বলা উচিত ছিল, খুব খারাপ ছাত্রই ছিলাম। ইস্কুলের পড়াশোনার বই একেবারেই পড়তাম না। তবে স্কুলে যে লাইব্রেরি ছিল, সেখান থেকে বই এনে পড়তাম। তখন যে ছোট্ট টাউনে থাকতাম, কলকাতা থেকে তা ৬০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সেখানে একটি পাবলিক লাইব্রেরি ছিল। দোতলা বাড়ি। ঠাসা বই। তা ছাড়া রিডিং রুম। আমার মা সেই লাইব্রেরির মেম্বার। মায়ের কার্ড নিয়েই যত খুশি বই আনতাম। চাঁদের পাহাড়, পথের পাঁচালি, অ্যাডভেঞ্চার অফ মার্কো পোলো কিংবা অলিভার টুইস্টের বাংলা অনুবাদ। আর পড়তাম ক্রিকেটের বই। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর লেখা নট আউট, লাল বল লাল বুট, ইডেনের শীতের দুপুর- এই সব বই প্রায় মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। এই নিয়েই যদি সারা ক্ষণ ব্যস্ত থাকি তা হলে ইস্কুলের পড়া পড়ব কখন? ফলে খারাপ ছাত্র হওয়া কেউ আটকাতে পারত না। তবে ক্লাসে বেঞ্চির উপর যাতে দাঁড়াতে না হয়, সেই আশঙ্কায় ক্লাসের পড়াটুকু তৈরি করে নিয়ে যেতাম ঠিকই। মাস্টারমশাইরা যদি পড়া ধরেন তখন যেন ঠিক-ঠিক বলতে পারি, তাই এই সাবধানতা অবলম্বন।
ক্লাসে বসে এক দিন জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখলাম আকাশ ঘন নীল হয়ে উঠেছে। এক রকম তীব্রতা আছে সেই নীল রঙের ভিতরে। আর সেই তীব্রতর নীল আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে দুধসাদা মেঘের স্তূপ।
সঙ্গে সঙ্গে মনে হত পুজো আসছে। আর দেরি নেই মা দুর্গার আগমনের। মন এক রকম আনন্দে নেচে উঠল। তবু সেই আনন্দের সঙ্গে, অন্তত আমার মনে, জেগে উঠত একপ্রকার ভয় পাওয়ার অনুভূতি।
আরও পড়ুন: পুজোর হাওয়া আর পোড়-খাওয়া চিরকুটের গল্প
সন্ধেবেলা মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে আমরা দু’ভাই রতন দর্জির দোকানে জামা-প্যান্টের মাপ দিতে যেতাম।
কেন ভয়? কারণ, সেই ষাটের দশকে, পুজোয় একটা লম্বা ছুটির ঠিক পরেই শুরু হত ইস্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষা। সেই পরীক্ষার জন্য অগ্রিম একটা আতঙ্ক মনে জন্ম নিত পুজোর আগেই। এ দিকে আমার তিন মামা, যাঁরা কলকাতায় থাকতেন, তাঁরা প্রতি বছর পুজোর কিছু দিন আগে পার্সেল করে আমাদের দুই ভাইয়ের জন্য শার্ট আর প্যান্টের কাপড় পাঠাতেন। মধ্যপ্রদেশের ভিলাই শহরে আমার যে মাসতুতো দিদি-জামাইবাবু থাকতেন, তাঁরাও পার্সেলে জামা-প্যান্টের কাপড় পাঠাতেন। আমাদের স্থানীয় ডাকঘরের পোস্টম্যান নিতাইদা দরজায় এসে হাঁক দিতেন- পার্সেল আছে, সই করে নিতে হবে। সে কথা শুনে আমাদের দুই ভাইয়ের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে যেত। শৈশবেই পিতৃহীন আমরা দু’ভাই কোনও কারণে খুশি হয়েছি দেখলে আমাদের মায়ের আর অন্য কিছু চাওয়ার ছিল না।
সন্ধেবেলা মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে আমরা দু’ভাই রতন দর্জির দোকানে জামা-প্যান্টের মাপ দিতে যেতাম। রতন দর্জির দোকান থেকে বেরিয়ে আমরা তিন জন চলে আসতাম স্টেশনবাজারের কাছে বাটা-র দোকানে। নতুন জুতোর বাক্স বালিশের পাশে নিয়ে ঘুমোতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা যেমন আরও অনেক বালকের আছে, তেমন আমাদেরও ছিল। বাক্স খুলে চকচকে জুতোয় নাক ঠেকিয়ে গন্ধ নিতাম। সেই সব আনন্দের মধ্যেই কিন্তু আমার মনে মিশে থাকত সেই একটা ভয়। ইস্কুল খুললেই পরীক্ষা। কী করব তখন? পড়াশোনা তো সারা বছর কিছুই করিনি, তা হলে?
শরৎকালে তখন দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রতি বছর একটি খুব মোটা পূজাবার্ষিকী বেরোত। শুধু ছোটদের জন্য অজস্র লেখা আর ছবিতে গল্প দিয়ে ভরা সেই বার্ষিকী। আমাদের বাড়িতে যে হকার কাগজ দিতেন, মায়ের কথায় তিনি সেই বই এক খণ্ড দিয়ে যেতেন প্রতি বছর। পুজোর ছুটির পর অ্যানুয়াল পরীক্ষাকে সামনে নিয়েও আমি সেই বইয়ে ডুবে যেতাম।
পুজোর তিন দিন ঠাকুর দেখতাম আমাদের ছোট টাউনে ঘুরে ঘুরে। ভাই বেরোত ভাইয়ের বন্ধুদের সঙ্গে। আমি বেরোতাম একা। দু’ভাইয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত। আমি বললাম, বারোটা ঠাকুর, দেখলাম আট। ভাই আমাকে নস্যাৎ করে বলল, আমি পনেরোটা দেখেছি। অত ঠাকুর আমরা পেতাম কোথায়? ওইটুকু শহরে? বারোয়ারি পুজো ছিল গোনাগুনতি। কিন্তু বাড়ির পুজো ছিল অনেক। গৃহস্থের ঠাকুরদালানে দাঁড়িয়ে থাকতেন মা দুর্গা, তাঁর ছেলেমেয়েদের নিয়ে। সেখানে সকলের অবারিত দ্বার। যে কেউ এসে ঠাকুর দেখতে পারে, অঞ্জলি দিতে পারে, আরতি দেখতে পারে। আমাদের দাদাস্থানীয় যুবকেরা মণ্ডপে দাঁড়িয়ে আলাপ জমাত কিশোরী বা তরুণীদের সঙ্গে। সে সব দিনে তো ওই দূর মফসসলে ছেলেমেয়েদের অবাধ মেলামেশার প্রচলন হয়নি। দুর্গাপূজা একটা সুযোগ এনে দিত আলাপ করার। মেয়েরাও খুব সেজে আসত মণ্ডপের আঙিনায়। ধুনুচি নিয়ে নাচ হত। এক একটি বারোয়ারি পুজো প্যান্ডেলে সদ্য তরুণ আর সদ্য কিশোরীদের যৎসামান্য ঘনিষ্ঠতা হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তত পুজোর তিন দিন অভিভাবকদের দিক থেকে কোনও বাধা থাকত না।
মাসতুতো দিদি-জামাইবাবু পার্সেলে জামা-প্যান্টের কাপড় পাঠাতেন।
স্মৃতির পুজো বলতে ইস্কুল জীবনের দিনগুলিই মনে পড়ে কেবল। যখন ঠাকুর দেখতাম পায়ে নতুন জুতোর ফোস্কা নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে— অথচ তার মধ্যে মিশে থাকত আসন্ন পরীক্ষার ভয়। পরীক্ষা হল নভেম্বরে। রেজাল্ট আউট হত ডিসেম্বরের ২৪ তারিখে। কোনও রকমে টেনেটুনে পাশ করে যেতাম। পাশ করতে পারলাম না, এমন বছরও গেছে। তাই স্মৃতির পুজো আমার মনে কেবল অবিমিশ্র আনন্দের আবহাওয়া বহন করার কথাই বলে না। বলে এক রকম আতঙ্কের কথাও।
আরও পড়ুন: মিষ্টি হেসে বলল... হ্যাপি পুজা!
তবে তখন কী করে জানব আমার সারা জীবন বয়ে চলবে কেবল নানা রকম পরীক্ষার মধ্য দিয়ে। এখন জানি জীবন মানেই পরীক্ষা। তাই এক ধরনের ভয়কে সঙ্গে নিয়েই আমাকে জীবনের পথে চলতে হল। বাল্যকালের সেই ভয়-ভয় ভাব আমাকে সম্পূর্ণ ছেড়ে গিয়েছে, সে কথা বলতে পারি না।
এখন আর ঠাকুর দেখতে বেরোই না বহু বছর হয়ে গেল। মেয়ে বুকুন ওর বন্ধুদের সঙ্গে ঠাকুর দেখতে হইহই করে বেরিয়ে যায়। কলকাতার প্রায় সব পুজো সারা রাত ধরে দেখে বেড়ায় তারা। বুকুনের মা কাবেরীও তার ইস্কুলের সহপাঠীদের সঙ্গে ঠাকুর দেখার অভিযানে যোগ দেয়। আমি বাড়িতে একা থাকি। বই পড়ি কিংবা গান শুনি। কাবেরী-বুকুন রেডিয়োতে মহালায়াও শোনে ভোররাতে উঠে। আমি যে কত দিন ভোরবেলা মহালয়াও শুনি না, তা বলতে পারব না। তবে এখন তো মহিষাসুরমর্দিনী-র সিডি বেরিয়ে গেছে। সেই সিডি চালিয়ে দিই বছরের যে কোনও সময়। তখন যে-ঋতুই হোক না কেন, মহিষাসুরমর্দিনীর সিডি যখন বাজে তখন আকাশে অদৃশ্য ভাবে শরৎকালের ঊষার উদয় অনুভব করি।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy