তখন সবে শহরটা ধোঁয়া আর ধূলোয় ধূসর হতে শুরু করেছে, বিবর্ণ হচ্ছে একটু একটু করে- তবু পুজোর ছুটির আগে শেষ পিরিয়ডে কাগজের তৈরি উড়োজাহাজের দিকভ্রান্ত ওড়াউড়ি। প্রত্যুষের (এখন বিখ্যাত সরোদিয়া ও সমস্ত খ্যাতিমান গায়ক গায়িকাদের একান্ত প্রিয় ‘সংগীত-আয়োজক’) মাথা লক্ষ করে উড়ে যাওয়া আমার ‘কাগুজে-বিমান’ পথ ভুল করে ঠোক্কর খেল নিপা অগ্রবালের মাথায়! যথারীতি ক্ষিপ্র ভাবে ঘাড় বাঁকিয়ে ওর চোখ চিনে ফেলল বিমান চালককে, বছরের অন্য সময় হলে নির্ঘাত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কাছে নালিশ এবং অংকের শিক্ষিকা মহোদয়া এই সুযোগ পেলে একেবারেই হাতছাড়া করতেন না- কারণ অংকে প্রায়শই ‘শূন্য’ পাওয়া ছাত্রকে তিরস্কার করার এমন মহৎ কাজ নেই বা হাতছাড়া করতে চান...?
মিনিট খানেক আমার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেন শিক্ষিকা- তারপর খুব ঠান্ডা গলায় ঝরে পরত তিরস্কার...
“aren’t you ashamed of yourself Mr. Sen”...? ব্যাস ওইটুকুতেই এত তীব্রতা থাকত, স্কেলের বাড়ির প্রয়োজন পড়ত না। কিন্তু না। এ সব কিছুই ঘটল না। ‘নিপা অগ্রবাল’ মাটি থেকে উড়োজাহাজটা কুড়িয়ে নিয়ে মিষ্টি হেসে আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল-“Happy Puja”... বলে উড়িয়ে দিলো বিমানটা। ব্ল্যাক বোর্ডে ধাক্কা খেয়ে, জানলা দিয়ে আসা শরৎ’এর আলোয় ঝকমক করতে থাকা ক্লাসঘরটা জুড়ে পাক খেতে লাগল আমার কাগজের লড়াকু বিমান।
মহালয়া শোনার সময় কৃষ্ণা দাশগুপ্তর গলায়-‘ অখিল বিমানে তব দয় গানে...’ শুনতে শুনতে দেখতে পাই মা যেদিকটায় শোয়, সেই রাস্তার দিকে জানলা দুটোর ফাঁক দিয়ে ফর্সা হচ্ছে পৃথিবী- আর কী আশ্চর্য সেদিন হরিণঘাটার দুধের ডিপোয় ভিড় করা নিত্যদিনের ক্রেতাদের খিচির মিচির নেই, নেই কোনও তাড়াহুড়ো। কেমন একটা আয়েশী মখমলের জুতোয় পা গলিয়ে বেলা গড়াতে থাকল কলকাতার পথঘাটে।
আরও পড়ুন: পুজোর হাওয়া আর পোড়-খাওয়া চিরকুটের গল্প
মহালয়া শোনার সময় রাস্তার দিকে জানলা দুটোর ফাঁক দিয়ে দেখতে পাই ফর্সা হচ্ছে পৃথিবী।
পাড়ার বন্ধুরা সব সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্যান্ডেলে। ২৩ পল্লি দুর্গামণ্ডপ তখন বারো মাসের মন্দির নয়। অস্থায়ী বাঁশের খাঁচায় কাপড়ে মোড়া সাবেকি মণ্ডপ। সেখানে অধিষ্ঠিতা অসম্পূর্ণা দশভূজা। ‘মৃৎশিল্পী’ জিতেন পালের অসামান্য স্পর্শে যা সম্পূর্ণ হবে পঞ্চমীর দিন প্রায় মাঝরাতে।
তখনও তৃতীয়া থেকে শুরু হত না ভিড়। তখন সেলফি নয়, বায়োস্কোপের নায়ক-নায়িকা বা খেলোয়াড় বা মুখ্যমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনের মাধ্যমে নয়, বাঙালির পুজোর শুভ উদ্বোধন ঘটত মনে। চোখে মুখে প্রকাশ পেত বছরভর। জোয়াল টানা মানুষগুলোর সাময়িক ভাবে ‘ছুটি’ পাওয়ার প্রশান্তি। অবশ্যই ক্ষণ কালের, তবু তো ‘ছুটি’... মাথার উপর নীল আকাশটাও তো তাই বলতো, তুলোর মতো মেঘগুলো তাই গা ভাসিয়ে দিত নিশ্চিন্তে। ওই তো- বুবাই, পিন্টু, টোটোন, রাজু, গৌতম, রাজা , শুভ, মনি দি, বাবলু দা, আবীর, রুনুঝুণু, বুড়ি- সবাই ভিড় করছে মণ্ডপে। এখন রাত ন’টা- সিংহের কেশরটা এখুনি সম্পূর্ণ হবে, ইশ্ ময়ূরটার মাথার ঝুঁটিটা অমন বেঁকে গেল কীভাবে? দেখেছো কাণ্ড- হাঁসটার গলার কাছের একটা অংশ কখন চোট খেয়েছে- অস্ত্রগুলোর রঙ এখনো শুকোয়নি, রঙ আর তার্পিন তেলের গন্ধে তখন ম ম করছে গোটা পাড়া।
আমার পুরনো পাড়ার সেই পুজো এখন আরও বড়ো হয়েছে- স্থায়ী হয়েছে। রঙ-তার্পিন তেল’এর গন্ধ নেই, বাঁশ পড়ার শব্দ নেই। ত্রিপল বা কাপড়ের সেই প্যান্ডেল নেই। প্রতিমা বিসর্জন নেই। অষ্টধাতুর মূর্তি। নিশ্চল। চিরস্থায়ী। রাজু-গৌতমের গলির পাশেই বিখ্যাত তৃণমূল নেতার বাড়ি। পুলিশ আর নিরাপত্তার বলয়ে ঘিরে থাকা পাড়াটাকে মনে হয় যেন উপদ্রুত অঞ্চল।
ওই পাড়াতেই পুজোর সময়ে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি পৌঁছে যেত পুজোর ভোগ। স্লিপ নিয়ে লাইন দিয়ে বিপুল আয়োজন নয়- পুজোর প্রসাদ পাওয়া ছিল স্বাভাবিক ও সহজ একটা ব্যাপার। পুজো কমিটির দাদারা খুঁটিনাটি খবর রাখতেন, কার বাড়ি পৌঁছল বা পৌঁছল না পুজোর ভোগ। ওই ২৩ পল্লির পুজোর পরিধার মধ্যেই হত কমিউনিস্ট পার্টির লাল কাপড়ে মোড়া বইয়ের স্টল।
দায়িত্বে থাকা লোকাল কমিটির গম্ভীর মুখের বয়স্ক কমরেডরা এতটাই নীরস মুখ করে বসে থাকতেন যেন শোকসভা চলছে। তাই একটা সময় কমবয়সীদের দায়িত্ব বর্তালো পরিবেশটা একটু ফুরফুরে করার।
ওই পাড়াতেই পুজোর সময়ে এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি পৌঁছে যেত পুজোর ভোগ।
মার্কস, এঙ্গেলস্, লেনিন, গোর্কি, গোগোল, জুকভ্স্কিন, চেখভ, টলস্টয়রা হয়তো বা একটু খুশিই হয়েছিলেন কমবয়সীদের ভীড় দেখে। ‘কয়ামত সে কয়ামত তক্’ দেখা বাঙালি তরুণ যখন শয়নে স্বপনে ‘আমির খান’ হতে চাইছে, বা ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ দেখে সুন্দরী মেয়েরা ‘ভাগ্যশ্রী’র মতোই খুঁজছে কোনও ‘সলমন খান’ কে, তখনও কোনও সপ্তমী, অষ্টমী অথবা নবমীর মাতাল করা সন্ধ্যায়- কোনও তরুণ বা তরুণী এসে দাঁড়াচ্ছে কমিউনিস্ট পার্টির স্টলে। তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছি হয় তো মায়োকভস্কির কবিতার বই- বা বি. টি. রনদিভের ‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা’। পড়তে পড়তে পুজোর ভিড় আর আলোয় পাল্টে যাচ্ছে তরুণটির মুখ বা সুবেশা তরুণীটির হাসি... বন্ধুদের তাড়া দেওয়ার মধ্যেও ছেলেটি পুজোর জন্য জমানো টাকা থেকে কিনে নিচ্ছে বই- বা তরুণীটি বান্ধবীদের ঠাট্টার ঢেউ সামলেও মেয়েটি শেষমেশ চিনে ফেলেছে মায়োকভস্কির পংক্তিগুলো “… Chests out!
Shoulders Straight!
Stick to the sky redflags adrift!
Whose marching there with
the right?!!
Left!
Left!
Left!”
এরপর ছেলেটি বা মেয়েটি নৌকোর মতো ভেসে চলে গেল উৎসবে, ওদের সঙ্গে হয়তো বা আমার আর দেখা হয়নি। হয়তো বা হয়েছে, নন্দীগ্রামের ঘটনার প্রতিবাদে ধর্মতলায়, কিংবা কামদুনির ধর্ষণকাণ্ডের জমায়েতে, ‘হোক কলরবের’ ভিড়ে অথবা ‘নাগরিক নিয়ন্ত্রণ বিল’-এর প্রতিবাদে উত্তাল শহরের রাস্তায়। পুজো এসেছে, পুজো গেছে। আমার জীবনের একমাত্র আশ্রয় হয়ে উঠেছে থিয়েটার, আমার জীবনের পরম কাঙ্খিত সম্পর্কের মতো এসেছে রেশমী আর ঋদ্ধি। বন্ধুরা এসেছে, শত্রু হয়েছে অনেকে, তবু ঘুরে ফিরে আসা পুরনো-নতুন পুজোর উৎসবে সবাইকেই কাছের মনে হয়।
আরও পড়ুন: পুজোর আনন্দের মধ্যেই ছিল পরীক্ষার ভয়ের কাঁটা
দেশের পেটে ক্ষুধা- দেশের মানুষের চাকরি নেই, নিরাপত্তা নেই। দেশের মানুষ জানতে/মানতে চায় না বলিউডের তারকারা মাদক সেবন করেছেন কি না। যে শ্রমিক বা কৃষকদের মুখের ভাঁজে আমার দেশের নদী-নালা-সাঁকো, সেই দেশে আজ মহামারীর চেয়েও ভয়ানক রাজনৈতিক শক্তি তার ডানা মেলছে। সর্বগ্রাসী এক মতবাদে পুষ্ট, ইতিহাস ছিবড়ে করে ফেলা এক কীটের মতোই তাদের ব্যাপ্তি।
২০২০ পুজো হোক না সেই পুরনো, অগোছালো, আড়ম্বরহীন পুজোগুলোর মতো। থিমের দাপটে, অর্থহীন উন্মাদনায় ভেসে না হয় নাই বা গেলাম এ বার। অনিশ্চয়তার চালচিত্রে এ বার অন্তত একটা পুজো কমিটি সাহস করে প্রতিষ্ঠা করুক মাটি লেপা একটি অসম্পূর্ণ দূর্গামূর্তি। রং নেই, গহনা নেই, অস্ত্র নেই, সাজসজ্জা নেই- খড়ের কাঠামোর উপরে লেগে থাকুক কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীর দশ আঙুলের ছাপ। পুরুতমশাইয়ের প্রয়োজন নেই, অঞ্জলি দেবে সবাই- যে যার মতো চাইবে, যে যার ভাষায়, নিজের জন্য নয়, অন্যের জন্য...
এমন একটা পুজো করে দেখাক বাংলা।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy