Advertisement

Associate Partner

Style Partner

Associate Partner

Weddings Partner

Food Partner

Durga Puja 2019

আমার ছোটবেলার পুজো: নেসারন দাদি বা আনুরা ফুপুদের কথা

ষষ্ঠীর দিন বামুনঠাকুর শিলাবতী নদীতে কলাবউ স্নান করাতে যেতেন।

রোশেনারা খান
শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৯ ১৭:২৮
Share: Save:

হ্যাঁ লো মর্জিনা, বোড়ো পুজোকে আর কদিন বাকি আছে? শুনচি নাকি এ বার তাতালপুরের গানের দল (যাত্রাদল) এসবে? এদের দলে নাকি অনেক ছুকরি মেয়ে আছে! দাড়িচাঁছা ব্যাটাছেলেরা মেয়েছেলে সাজলে দেখতে মন যায়নি... এই হল আমাদের পাড়ার নেসারন দাদি। স্বামী গরুর গাড়ি চালাতেন, বহু দিন মারা গেছেন, ছেলেকে নিয়ে দাদি একাই থাকে। খুব হুজুগে মানুষ। ফুটবল খেলা হোক বা যাত্রাপালা, দাদির সমান উৎসাহ। গ্রামে ফুটবল খেলা হলে বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে জোয়ান ছেলে-বুড়ো, কাতারে কাতারে লোক যায়। দাদিও পাড়ার অল্পবয়সী মেয়েদের নিয়ে মাঠের ধারে হাজির। বৃষ্টি-বাদলকেও গ্রাহ্য করে না। রাজবাড়ির মহিলারাও খেলা দেখতে আসেন, মাঠ থেকে সামান্য দূরে একটি দালান বাড়ির দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে জাফরির ফাঁক দিয়ে খেলা দেখেন।

তখন, মানে ছয়ের দশকে গ্রামাঞ্চলে তেমন কিছু তো বিনোদনের ব্যবস্থা ছিল না। জাতিধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছেই বড় উৎসব বলতে দুর্গাপুজো। যে পুজোকে নেসারন দাদির মত অনেকেই বোড়ো পুজো বলতেন। কেউ কেউ আবার আশ্বিন মাসে হয় বলে আশ্বিন পুজোও বলতেন। এই পুজো হল মঙ্গলাপোতা গ্রামের রাজ পরিবারের, মানে স্বাধীনতা সংগ্রামী অচল সিংহের বংশের দুর্গাপুজো। সেই সময়কার রাজা ছিলেন শ্রী বিক্রমকেশরী রাঘবেন্দ্র সিংহ দেব।

বহু যুগ পূর্বে, আজকের পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার গড়বেতা থানা এলাকায় ছিল বগড়ি রাজ্য। ‘বকডিহি’ থেকেই নাকি ‘বগড়ি’ নাম হয়েছে । জনশ্রুতি, মহাভারতের বক রাক্ষসের রাজ্য ছিল ‘বকডিহি’। ১৭২০ সালে সামশের সিংহ বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাকে পরাজিত করে বগড়ি অধিকার করেন এবং গড়বেতা থেকে মঙ্গলাপোতা গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। সম্ভবত সেই সময়ই এই গ্রামে দুর্গাপুজোর সূচনা হয়েছিল।

আরও পড়ুন: দেশ ছেড়ে এসে আমার পুজো যেন স্মৃতির কোলাজ​

সেই সময় গ্রামাঞ্চলে বারোয়ারি পুজোর চল ছিল না। গড়বেতা সতীর একান্ন পীঠের একটি হিসেবে পরিচিত। এখানে সতীর পায়ের আঙ্গুল পড়েছিল। সেটির জন্যই গড়ে উঠেছিল সর্বমঙ্গলা মন্দির। সতীর দেহাংশ রয়েছে বলেই সেই সময় পর্যন্ত গড়বেতায় দুর্গাপুজো হতো না। এই থানার অনেকগুলি গ্রামের মধ্যে মঙ্গলাপোতা গ্রামেই দুর্গাপুজো হত। স্বাভাবিক ভাবেই, সিংহ বাড়ির এই পুজোর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। পুজো ঘিরে চার দিন মেলা বসত, কাঠিনাচ, শাঁওতালি নাচ হতো। এ ছাড়াও পুজোর বিশেষ আকর্ষণ ছিল যাত্রাপালা। নেসারন দাদির মত মানুষেরা যাত্রাদলকে গানের দল বলত।

ষষ্ঠীর দিন বামুনঠাকুর শিলাবতী নদীতে কলাবউ স্নান করাতে যেতেন। আশপাশের সব বাচ্চারা ঢাকির পিছন পিছন দৌড়তাম। সপ্তমীর দিন মেলা চত্বরে কচিকাঁচারাই নতুন জামা পরে ভিড় জমাত। অষ্টমী ও নবমীর দিন একটুখানি বেলার দিকে আলতা, সিন্দুর পরা সালঙ্কারা ঘোমটা মাথায় মহিলারা কাঁসার রেকাবিতে পুজোর উপাচার নিয়ে অঞ্জলি দিতে যেতেন। বেলা গড়ালে দূর গ্রামের অভিজাত পরিবারের মহিলারা গরুরগাড়িতে চড়ে দেবীদর্শনে আসতেন। সন্ধ্যাবেলা ভিড়ের ঠেলায় রাস্তায় হাঁটা দায় হয়ে উঠত। ভিড়ের কারণ ছিল যাত্রাপালা।

শোনা যায়, রাজা সামশের সিংহ যখন গড়বেতা থেকে এই গ্রামে তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন, সেই সময় সর্বমঙ্গলা মন্দির থেকে একটি ঘট এনে এখানে পুঁতেছিলেন। সেই থেকেই এই গ্রামের নাম হয় ‘মঙ্গলাপোতা’। ঠাকুরদালানটিকে বলা হয় মঙ্গলামাড়া। যাত্রাপালা অভিনীত হত মঙ্গলামাড়ার সামনের আটচালায়। আসরের দু’ধারে মিউজিসিয়ানরা বসতেন। আমরা ছোটরা বসতাম তাঁদের পিছনে। সামনের সারিতে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বসতেন। কাকারা পুজোর ছুটিতে সপরিবারে গ্রামে এলে— কাকা, বাবা ও আরও যাঁরা আসরে বসে পালা দেখতেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পাশের গ্রামের ইব্রাহিম মণ্ডল। জমিদারের মতো দশাসই চেহারা। হলে কি হবে, পালায় যখন কোনও করুণ দৃশ্যের অবতারণা হত, তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরত। পাঞ্জাবির পকেট থেকে রুমাল বের করে বার বার চোখ মুছতেন। এতবড় মানুষকে কাঁদতে দেখে অবাক হতাম। মেলায় এক ধরনের জুয়াখেলা হত। ভাড়া করে আনা যাত্রাদলকে এরই টাকা দিতে হত। তাই সেই পরিমাণ টাকা না ওঠা পর্যন্ত যাত্রা শুরু হত না। আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে করতে একসময় ঢুলতে শুরু করতাম। পর পর চার দিন রাত জাগা, ঘুম ত পাবেই। এই যাত্রা শুনতে এসে নেসারন দাদি এক দিন এক মজার কাণ্ড ঘটিয়েছিল। ঠাকুর দালানের ভিতরে দুর্গাপুজো হত। বাইরের দাওয়াতে রাজপরিবারের মহিলারাও যেমন বসে পালা দেখতেন, তেমন সাধারণ হিন্দু-মুসলিম পরিবারের মহিলারা ছাড়াও তথাকথিত নিচু জাতের, মানে মাঝি-ডোম-হাড়িদের বউরাও একপাশে বসে পালা দেখতেন। নেসারন দাদি বিকেলেই খেজুরপাতার তালাই (চাটাই) বগলে করে চলে যেত ঠাকুরদালানে জায়গা ঘিরে রাখতে।

সন্ধ্যাবেলা লণ্ঠন জ্বেলে মা-বেটা ভাত খেয়ে চলে যেত পালা শুনতে, সন্ধিপুজোর দিন দেরি করে পালা শুরু হত। আগের দিনের রাত জাগার কারণে সে দিন পালা শুরুর আগেই দাদি ঘুমিয়ে পড়ে। পালা শেষ হতে সবাই যখন হইচই করছে, দাদি ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে— চল লো, চল ,আবাগির বেটারা আজ আর গান করবেনি। তাই শুনে দাদির সঙ্গী মর্জিনা, সুফিয়া, সাইদার সে কী হাসি!

একা নেসারন দাদি নয়, এই পালা শোনার নেশা আরও অনেকের ছিল। আনুরাফুপুর এই গ্রামেই বাপেরবাড়ি এবং শ্বশুরবারি। সংসারে খুব অভাব, স্বামী কোনও কাজ করে না। দশ ছেলে-মেয়ের খাওয়া পরার ব্যবস্থা তাঁকেই করতে হয়। সব বেলা হাঁড়িও চড়ত না। কতদিন দেখেছি চিড়ে কুটুনিদের থেকে চিড়ের কোনগুলো (ধানের ভিতরে চালের আরও একটি ক্ষুদ্র অংশ থাকে, যা কুঁড়োর সঙ্গে চলে যায়) কম পয়সায় কিনে এনে জলে ভিজিয়ে নুন মিশিয়ে বাটিতে করে ছেলে-মেয়েদের খেতে দিতেন। এই আনুরাফুপুও খুব হুজুগে মানুষ। পালাগান, সিনেমা, এ সব দেখার খুব নেশা। রাজাদের বাড়ি ছাড়াও সিংপাড়ার প্রতিটি বাড়িতে তাঁর অবাধ যাতায়াত ছিল। ঘরে খাবার থাক না থাক, আনুরাফুপু সন্ধ্যা থেকেই ঠাকুর দালানে তালাই পেতে বসে থাকতেন।

তখন ভাদ্রমাস মানে খুবই অভাবের সময়। দিনমজুরদের তেমন কাজ থাকত না। অনেক চাষির ঘরেও ভাত থাকত না। কিন্তু পুজোর কদিনের খাবারের ব্যবস্থা ত করতেই হবে। এই সময় একটা ধান উঠত, তার ভাত হত মোরামের মত লাল আর গোল গোল। স্বাদ মিষ্টি হলেও খাওয়া খুব কষ্টকর ছিল। ছেলে-মেয়েদের সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বড় করতে, বাবাকে কঠোর জীবনযুদ্ধ চালাতে হলেও আমাদের বাড়িতে এই চাল রান্না হত না। ধান কাটা হয়ে খামারে এলেই বিজয়কাকা, বিপিনকাকা, হরেকাকা, মকবুলচাচা, ইউনুসচাচারা ধান নিতে আসত। দাম দিতে হতো না, দেওয়ার ক্ষমতাও ওদের ছিল না। যে পরিমাণ ধান নিত, অঘ্রাণ-পৌষ মাসে নদীধারের জমির ধান উঠলে, সমপরিমাণ ধান দিয়ে যেতে হতো। এই ধান থেকে সরুচাল হত।

আরও পড়ুন: আমার পাঁচমেশালি পুজো পরিক্রমায় কত মায়াময় মন্তাজ​

এই সব পরিবারের ছোট ছেলেমেয়েদের বছরে এক বারই নতুন জামা হত, দুর্গাপুজোর সময়। বন্ধুদের ও পাড়ার অনেকের নতুন জামা দেখে একেবারেই যে মন খারাপ হত না, তা কিন্তু নয়। বাবার পক্ষে যখন তখন কিনে দেওয়া সম্ভব নয় জানতাম বলেই, নতুন জামার আবদার করতাম না। পুরনো জামা দাদা ইস্ত্রি করে দিত, তাই পরেই বন্ধুদের সঙ্গে মেলায় ঘুরতাম, যাত্রা দেখতাম। এই চারটে দিনই পড়াশোনা নেই, মায়ের শাসন নেই। কী আনন্দ! সেই আনন্দ মনখারাপ করে কাটাই কেউ?

বহুকাল পূর্বে কামান দেগে বিজয়া দশমীর সূচনা হতো। এক সময় নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে বিজয়া হতো। তখন হতো বন্দুক দেগে। এই দিন প্রতিমার বিসর্জন হত না, প্রতিমার পা ধরে নাড়িয়ে দিয়ে ঘট বিসর্জন দেওয়া হত। পোস্টকার্ডে লিখে বাড়ি বাড়ি সবাইকে বিজয়ার আমন্ত্রণ জানানো হতো। সবাই আসতেনও বিজয়া আমন্ত্রণ রক্ষা করতে। ওই দিন সব থেকে ভাল যাত্রাপালাটি মঞ্চস্থ হতো। প্রতিমা বিসর্জন হতো পরদিন ভোরে। বিসর্জনে আমরাও হাজির থাকতাম।

তার পর শিলাবতী দিয়ে বহু জল বয়ে গেছে।আজও দুর্গাপুজো হয় ঠিকই। কিন্তু সেই রাজাও নেই, রাজপ্রাসাদও নেই। কালের স্রোতে হারিয়ে গেছে নেসারন দাদি ,আনুরাফুপু, ইব্রাহিম মণ্ডল, বাবা, কাকারা। অকালে হারিয়েছি শৈশবের বন্ধু প্রীতি, সুচিত্রাকে। বাতাসে মিশে গেছে আমার অর্ধেক হৃদস্পন্দন। তাই আজ আর খুঁজে পাই না শিউলিফুলের গন্ধমাখা অনাবিল পুজোর আনন্দ। চারিদিক ঘিরে থাকে বিজয়ার বিষণ্ণতা।

অলঙ্করণ: শৌভিক দেবনাথ

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy