স্কুলের ক্লাসঘরে বসে বড় জানলা দিয়ে দেখতে পেতাম বাইরের আকাশ কী ঝকঝকে নীল হয়ে উঠেছে হঠাৎ! সেই তীব্র নীল রঙের ভেতরে ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছে অতি শুভ্র ঘন মেঘের স্তূপ। ক্লাসঘরে বসেই মন চঞ্চল হয়ে উঠত। বুঝতে পারতাম পুজো এসে পড়েছে। আমাদের বাড়ির উঠানে ছিল বড় একটা শিউলিগাছ। ঠিক এই সময়টা থেকেই সেই শিউলিগাছ ঝাঁকে ঝাঁকে ফুল দেওয়া শুরু করত। ঘুম থেকে উঠে খুব সকালে ঘর থেকে বেরিয়ে উঠানের সামনে লম্বা বারান্দায় আসতাম। চোখে পড়ত শিউলিগাছের তলায় শুধু ফুল আর ফুল। একে বারে সাদা হয়ে আছে সকালের শিশিরভেজা ফুলগুলো। তখন থেকেই আর ক্লাসের পড়ায় মন বসত না। স্কুল পালিয়ে লক্ষ্মণ পালের বাড়ি চলে যেতাম। সেখানে প্রতিমা গড়া হচ্ছে। লক্ষ্মণকাকা চোখে ভাল দেখতে পান না বলে লক্ষ্মণকাকার বড় মেয়ে একটা প্রদীপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকত পাশে। প্রতিমা তৈরি করার জায়গাটুকু একটা ত্রিপল দিয়ে আড়াল করা। আমার মতো আরও কিছু স্কুলপালানো ছেলে জড়ো হত লক্ষ্মণকাকার বাড়ি। তারাও ঠাকুর গড়া দেখতে এসেছে। ত্রিপলের ফাঁক দিয়ে আমরা উঁকিঝুঁকি মারতাম। লক্ষ্মণকাকা বলতেন যা যা তোরা, কাজের সময় বিরক্ত করিস না। কিন্তু, সে কথা তাঁর মনের কথা ছিল না। ভেতরে ভেতরে খুশিই হতেন আমরা ঠাকুর গড়া দেখতে এসেছি বলে। আমরা ঠাকুর গড়া দেখতাম। পাশাপাশি লক্ষ্মণকাকার মেয়েকেও দেখতাম। ফর্সা, ছিপছিপে কিশোরীটি সবে শাড়ি পরতে শুরু করেছে। মাঝে মাঝে ফ্রক পরেও প্রদীপ হাতে দাঁড়াত সেই মেয়েটি। কাকে ছেড়ে কাকে দেখব ঠিক করতে পারতাম না।
আমাদের বাড়ির অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না। একটা জামা একটা প্যান্ট কোনও রকমে কিনে দিত মা। আমাদের দুই ভাইয়ের কাছে সেটাই তখন অনেক।
এক বার মহালয়ার ঠিক আগের দিন আমাদের বাড়ির জন্য মা একটা রেডিয়ো কিনে আনল। মারফি রেডিয়ো। পরে শুনেছি, বড় হয়ে, মা ওই রেডিয়ো এনেছিল স্টেশন বাজারের কয়াল রেডিয়ো স্টোর্স থেকে। ধারে। মাসে মাসে কিছু কিছু দিয়ে সেই ধার পরে শোধ করা হয়। ওই রেডিয়ো সেটের দাম তখন ছিল ৩৩০ টাকা। আজকের দিনে বলতে গেলে কিছুই নয়। কিন্তু আমাদের বাড়ির অবস্থা তখন এমন ছিল না যে ৩০০ টাকা দিয়ে একটা রেডিয়ো আনা যেতে পারে। কিন্তু সেই রেডিয়ো পেয়ে আমরা দু’ভাই আনন্দে আকুল। রাত সাড়ে তিনটেয় ঘুম থেকে উঠে বসে আছি কখন ভোর চারটে বাজবে। মহালয়া শুরু হবে।
সেই থেকে প্রতি বছর মহালয়া শোনার জন্য রেডিও-র সামনে বসে থাকতাম দুই ভাই। মা-ও থাকত আমাদের সঙ্গে। বাবার মৃত্যু আমার আট বছর বয়সেই ঘটে গিয়েছে। বাড়িতে আমরা তিন জন। ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পেতাম বাইরে আকাশ কালো থেকে ধূসর নীল হয়ে উঠেছে। বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠের মন্ত্রপাঠ। সেই মন্ত্রপাঠের উচ্চাবচ সুরধ্বনি সব বাড়ির রেডিয়ো থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হচ্ছে এই তো, আজকেই তো পুজো শুরু হয়ে গেল!
সপ্তমী অষ্টমী নবমী এই তিন দিন ঠাকুর দেখতে বেরোতাম। নতুন জুতো হত কোনও কোনও বছর। জুতোর বাক্স খুলে সেই জুতো মাথার বালিশের পাশে নিয়ে ঘুমোতে যেতাম। তার সঙ্গে থাকত সাদা মোজা। তিন দিন ধরে ঘুরে ঠাকুর দেখতাম ঠিক কথা, কিন্তু প্রথম দিনেই পায়ে ফোস্কা পড়ে যেত। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলতাম। আমরা তখন ছোট একটা টাউনে থাকতাম, সেই টাউন কলকাতা থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে। পুরো টাউনে হয়ত কুড়ি বাইশটি বারোয়ারি পুজো হত। তা ছাড়া অবস্থাপন্ন কয়েকটি বাড়িতেও চলত দেবীর আরাধনা। ঢাক বাজিয়ে প্রতিমা আনার সময় আমরা দৌড়ে বড় রাস্তায় চলে আসতাম। কাদের ঠাকুর আসছে এই জিজ্ঞাসা তখন আমার বয়সী সব বালকদের মনে।
দেখতে দেখতে পুজোর তিনটি দিন ফুরিয়ে যেত। চোখের পলকেই যেন এসে পড়ত দশমী। বারোয়ারি মণ্ডপে বিভিন্ন বাড়ির গৃহবধূরা সমবেত হয়ে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠতেন। সন্ধ্যে হতেই আমরা চলে যেতাম চূর্ণী নদীর ধারে বড়বাজার ঘাটে। সেখানে একে একে সব প্রতিমার বিসর্জন হত। প্রত্যেক পাড়ার যুবকরা প্রতিমা কাঁধে নিয়ে নেমে পড়ত চূর্ণী নদীর জলে। এক সময় জলের মধ্যে শুইয়ে দিত দুর্গাপ্রতিমাকে। রাত সাড়ে ন’টা দশটা পর্যন্ত চলত এই বিসর্জন। চূর্ণীর তীরে পুরো সময়টা জুড়ে ঢাকের বাজনা উদ্দাম হয়ে উঠত।
বিসর্জনের পরের দিন এক বার দেখেছিলাম এক ঢাকি পিঠে ঢাক নিয়ে বালক পুত্রের সঙ্গে মাঠের কাশবন সরিয়ে ফিরে যাচ্ছে নিজের গ্রামের দিকে। আমাদের ওই টাউনের মাঝখানে চূর্ণী নদী বয়ে গিয়েছে, সেই নদীর ওপারেই পর পর গ্রাম। সেই সব গ্রাম থেকেই ঢাকিরা আসত। প্রচুর কাশফুল ফুটে থাকত নদীর ধারে। রেললাইনের পাশেও কত কাশফুল। সেই কাশফুলে বন পার হয়ে ঢাকিরা চলে যেত।
পুজো শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও কাশফুলেরা থাকত। আকাশে ভেসে বেড়াত তীব্র নীলের মাঝখানে জেগে ওঠা শ্বেতশুভ্র স্তূপমেঘ। তখন ওদের দেখে মনে পড়ত, না, পুজো আসছে না। পুজো তো চলে গিয়েছে। পুজোর ছুটি চলছে তখন স্কুলে। ছুটির পরেই শুরু হয়ে যাবে পরীক্ষা, ক্লাসে ওঠার পরীক্ষা। পরীক্ষা সম্পর্কে ভয় ছিল খুব। পুজোর আনন্দ তো ছিল তিন-চার দিন মাত্র স্থায়ী। তবু ওই স্বল্পসময়ের আনন্দের কথা মনে বেজে উঠত। দেবসাহিত্য কুটীর থেকে প্রতি বছর ছোটদের জন্য প্রকাশিত হত একটি মোটা পূজাবার্ষিকী। কখনও তার নাম নীহারিকা, কোনও বছর নাম অপরূপা, কোনওটির নাম হয়তো অলকানন্দা। মা প্রতি বছর সেই বছরের পূজাবার্ষিকী কিনে দিত আমাদের। পুজোর পর পরীক্ষার জন্য স্কুলের পড়াশোনা বাদ দিয়ে আমি মন দিয়ে ছোটদের ওই পূজাবার্ষিকী পড়তাম। কী যে আনন্দ ছিল সেই পড়ার! কী যে আনন্দ ছিল সেই দিনগুলির!
অলঙ্করণ- তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy