আমার জীবনের প্রথম আঠাশটি বছর কেটেছে ভারতে। সেই সময়ের দুর্গাপুজোর স্মৃতি ছড়িয়ে আছে আমার শহর দুর্গাপুরে। পুজোর আগে প্রকৃতির সাধ-আহ্লাদ উপলব্ধি করতে পারতাম দুর্গাপুরের সবুজ পরিবেশে। বর্ষা শেষের চোরকাঁটা ভরা মাঠের রাস্তা ধরে স্কুলে যেতে যেতে শরতের সাদা মেঘের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম কবে দুর্গাপুজো আসবে!
রাস্তার ধারে কাশফুল ফুটে উঠত। আমাদের শোওয়ার ঘরের জানালার পাশে শিউলি গাছটা ভরে উঠত ফুলে। ভোররাতে কান পেতে শুনতাম শিউলি ফুল ঝরে পরার টুপটাপ শব্দ। ভেসে আসত শিউলি ফুলের সুবাস। তার পর সেই রকম এক ভোররাতে আনন্দময়ীর আগমনের উচ্ছ্বাস নিয়ে চলে আসত মহালয়া।
একটু বড় হলে, নকশাল আন্দোলনের অস্থির দিনগুলোর সময়, আমার স্কুল পাল্টানো হলো। পৌঁছে গেলাম পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্রাবাসে। পুরুলিয়াতে আমাদের দিন শুরু হত সমবেত আধ্যাত্মিক সঙ্গীতচর্চা এবং উপাসনা দিয়ে। সেখানেই প্রথম পরিচিত হলাম ‘আগমনী’ গানের সঙ্গে। মা দুর্গাকে ঘরের মেয়ের আদরে ভরিয়ে দিয়ে তার বাপের বাড়িতে ফেরার আনন্দ এবং চলে যাওয়ার বিষণ্ণতা নিয়ে গ্রাম বাংলার লোকগান। উপাসনার সময় আমাদের শিক্ষক তুলসীদা এক সময় গেয়ে উঠতেন— ‘এবার আমার উমা এলে আর উমাকে পাঠাবো না/ লোকে বলে বলুক মন্দ কারো কথা শুনবনা’। সুরের অপ্রতুলতাকে ছাপিয়ে শীর্ণকায় পরিণত বয়সী তুলসীদার আবেগের মূর্ছনায় ভরে যেত আমাদের পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশনের ভজনঘর। আর সেই আবেগের মূর্চ্ছনাটাকে আঁকড়ে ধরে আমি দিন গুনতাম কবে ফিরে যাব দুর্গাপুরের নিজের বাড়িতে মা বাবার কাছে, পুজোর ছুটিতে।
স্কুল পেরিয়ে এক দিন পৌঁছে গেলাম যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে। সুশৃঙ্খল নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ থেকে বেরিয়ে এসে অবাধ স্বাধীনতার এক স্বপ্নের জগতে। যাদবপুরের দিনগুলো ছিল নিয়ম ভাঙার দিন। জীবনে তখন বাঙালি অস্তিত্বের মূলধারায় বাস করার নিরাপত্তা আর সে কারণে ছিল সেই অস্তিত্বকে অবজ্ঞা করার প্রগলভতা। পুজোর সময় নতুন জামাকাপড় পরার রীতিকে তখন মনে হত ভীষণ সাবেকি— পুজোয় অঞ্জলি! তাও আবার উপোস করে! এ সব মনে হত ভীষণ প্রাচীনপন্থী ভাবনা! সে দিন বুঝতেও পারতাম না যে, নিয়ম ভাঙার অছিলায় আমি আরও গভীরে চলে যাচ্ছি আমার বাঙালি অস্তিত্বের অন্দরমহলে যেখানে আমার বাঙালি মন জানতে চাইছে জীবনকে— খুঁজে বেড়াচ্ছে বাঙালি হয়ে বেঁচে থাকার নতুন নির্যাস। অবশ্য সেই নিয়ম ভাঙার দিনগুলোতেও ভাল লাগত দুর্গাপুজোর আবেশ। দূর থেকে ভেসে আসা পুজো প্যান্ডেলের গান, দিনের বেলায় বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর সন্ধেবেলায় গাড়ি করে দুর্গাপুরের নামকরা পুজোগুলো দেখতে যাওয়া বাবা-মা আর বোনেদের সঙ্গে।
তার পর জীবনে-আবর্তে ভাসতে ভাসতে এক দিন পৌঁছে গেলাম আমেরিকায়। সে-ও তিরিশ বছরেরও আগেকার কথা। প্লেনে ওঠার সেই প্রত্যুষে ভাবতেও পারিনি বেঁচে থাকার উপলব্ধি কেমন ভাবে পাল্টে যাবে সারাটা জীবনের জন্য। সেই সব দিনে ইন্টারনেট ছিল না— ছিল না স্মার্ট ফোন। ব্ল্যাক্সবার্গ শহরে ভার্জিনিয়া টেক বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা তখন জনা তিরিশ বাঙালি ছাত্রছাত্রী। পুজোর প্রশ্ন অবান্তর সেখানে। লোকের মুখে জেনেছিলাম আজ অষ্টমী। দশমীর দিন অবশ্য আর বেঁধে রাখতে পারিনি অতীত-আর্ত্ততাকে। সবাইকে ফোন করা হল— সাজসজ্জাবিহীন ছোট্ট আপার্টমেন্টের কার্পেটের মেঝেতে বসে আমরা সবাই মিলে সে দিন গান করেছিলাম— সঙ্গে ছিল নিজেদের অপটু হাতের তৈরি খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা। শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, অনুভূতি, লোকজন নিয়ে`তৈরি হয়েছিল উৎসবের আবেশ। আধপোড়া খিচুড়ি আর ফেলে আসা দেশের এক সমুদ্র স্মৃতি নিয়ে খুঁজে বেরিয়েছিলাম দুর্গাপুজোর আনন্দকে।
ব্ল্যাক্সবার্গ থেকে পাশ করে চাকরি জুটল ওয়াশিংটন শহরের গা ঘেঁষে মেরিল্যান্ড প্রদেশে। পৌঁছে গেলাম ম্যারিল্যান্ডের বাঙালি এসোসিয়েশন ‘সংস্কৃতির’ দুর্গাপুজোয়। সপ্তাহান্তের পুজো স্কুলবাড়ি ভাড়া করে সাত-আটশো বাঙালির দূর্গাপুজো। মহিলারা প্যান্ট-শার্ট ছেড়ে শাড়ি পরে এসেছেন বাঙালি সেজে। ষাটের দশকে এ দেশে চলে আসা কনকচাঁপাদির পড়নে লালপেড়ে বেনারসী। ফুলকো হাতা ব্লাউজ। খোঁপায় লাগানো লম্বা সোনার কাঁটা। ষাটের দশকের বাঙালি মহিলার সাজ থমকে গিয়েছে কনকদির কাছে। পরে বুঝেছি এদেশের বাঙালি অভিবাসীর অস্তিত্বে একটা বিচ্ছিন্নতা-সূচক কাজ করে । যিনি যেই দশকে বাংলা ছেড়ে এই দেশে এসেছেন তিনি আঁকড়ে ধরে আছেন সেই যুগের বাঙালির সাজ পোশাক, রান্নাবান্নার ঐতিহ্যকে। আমিও হয়তো তাই। খুঁজে বেড়াই আমার দেশ ছেড়ে বেড়িয়ে পরার আগে, আমার আশির দশককের বাঙালি অস্তিত্বকে।
সংস্কৃতির দুর্গাপুজোতে এসে প্রাণে যেন সোনার জিয়ন কাঠির ছোঁয়া এল। স্কুলের বড় ডাইনিং হলে আটশো লোকের দূর্গাপুজো। সত্যিকারের দুর্গা প্রতিমা— তার পেছনে চালচিত্র সাজিয়েছেন স্থানীয় বাঙালি কমবয়সি লোকজনেরা। ঢাকের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ধূপের গন্ধ, পুরোহিতের মন্ত্র। লাগোয়া রান্নাঘরে চলছে আটশো লোকের জন্য দুই দিনের দুই বেলার রান্না। আর সেই রান্নার মশলাবাটা থেকে খুন্তি নাড়ানোর সব কাজ করছেন স্থানীয় বাঙালি হর্তাকর্তারা। শিশুবিশেষজ্ঞ ডাক্তার সাহু, সিনিয়র সাইন্টিস্ট ডাক্তার চট্টরাজ, পূর্ণিমাদি, ইভাদি এবং আরও অনেকে। শুক্রবার রাতে রান্নার সরঞ্জাম তৈরি। ভোর থেকে শুরু হয়ে যেত রান্না। রান্নাঘরও ছিল আধুনিক ধরনের। মাঝারি আয়তনের কারখানার মতো দেখতে। চাকা লাগানো বড় বড় ডেকচি। জলের বাষ্পের নলের সঙ্গে লাগিয়ে দাও সেই বড় বড় ডেকচিগুলোকে। ব্যস! ঝটপট করে রান্না করে নেওয়া যেত ভাত, ডাল, পাঁচমিশালি তরকারি, পাঁঠার মাংস। মনে আছে একবার বেগুনও ভাজা হয়েছিল ওই বাষ্প-গরমের ডেকচিতে। সৃজনশীলতা তো আমাদের রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য। সন্ধ্যেবেলায় অডিটোরিয়ামে দু’দিন ধরেই পরিবেশিত হত অনেক বাংলা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— নাটক-নৃত্যনাট্য।
দেশ থেকে বহু দূরে থেকে সংস্কৃতির দুর্গাপুজোয় এসে, কোথায় যেন আবার নিজেকে ফিরে পেয়েছিলাম। আত্মবিশ্বাসের ঠিকানা খুঁজে পেয়েছিলাম দূরদেশে এসে। যাদবপুরের সেই এঁচোড়ে পক্ক ছেলেটা, যে বাঙালি অস্তিত্বের মূলধারার নিরাপত্তায় বাস করে— তার প্রতিবাদী সত্ত্বা নিয়ে একদিন প্রশ্ন করত পুজোয় নুতন পোশাক পরার রীতিকে। উদাসীনতা নিয়ে আড়াল আবডাল থেকে অনুভব করতে চাইত দুর্গাপুজোর উৎসবের আমেজকে। সেই এঁচোড়ে পক্ক বাঙালি ছেলেটা— বাঙালি অস্তিত্বের মূলধারা থেকে অনেক দূরে এসে— মেরিল্যান্ডের সপ্তাহান্তের দুর্গাপুজোর শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, অনুভূতি, লোকজনের মধ্যে থেকে উপলব্ধি করতে চাইল সেই সনাতন বাঙালির সত্ত্বাকে— যা মিলে মিশে এক হয়ে আছে দুর্গাপুজোর উৎসবের সঙ্গে।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy