তখনও বিশ্বকর্মা পুজো কেবলমাত্র রিকশাস্ট্যান্ড আর অটোস্ট্যান্ডেই হত না। ইতিউতি অনেক কারখানার ধোঁয়া বাতাসে মিশতে মিশতে দিব্যি ফুসফুসেও মিশে যেত, আর তার জন্য কোথাও কারও কাশি হয়েছে বলেও শুনিনি। পাড়ার বাচ্চুদা, যে নাকি ভূমিকম্প হলেও, বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ভজার চায়ের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়াবেই, কারণ ঠিক তখন তুলিদি ছাদ থেকে ভিজে কাপড় তুলতে আসবে, তারও রুটিনে ভুলে হয়ে যেত এই ‘পুজো আসছে’, ‘পুজো আসছে’ সময়টায়। এখনও দুপুরে চোখ জড়িয়ে এলে পৃথিবীর দ্রুততম গাড়ি ‘স্মৃতি’-তে ভর দিয়ে দিব্যি আশ্বিনের সেই দিনটায় চলে যাওয়া যায়, যখন বেসুরোদের গলার আগমনীও কোকিলের ডাকের মতো মিষ্টি ঠেকে।
খুব বেশি দিন আগের কথা কিন্তু নয়। তবু মনে হয় যেন সম্পূর্ণ আলাদা একটা পৃথিবী আমাদের জড়িয়ে রেখেছিল এই তিরিশ বছর আগেও যখন কলাবউয়ের স্নান দেখতে যাওয়ার উত্তেজনা, কোনও কিছুর বিনিময়ে ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলাম না আমরা। স্মার্টফোনে গেম খেলবার কিংবা অন্যান্য সব ‘গেম’ দেখবার চিরাগ তখনও জ্বলে ওঠেনি বাচ্চাদের সামনে। ভাগ্যিস ওঠেনি। সেই ‘আনস্মার্ট’ পৃথিবী তার রূপ-রস-গন্ধের কলসি এতখানি উপুড় করে দিতে পারত তাই। আমার চেনা একটি পরিবারে, দিদির নাম ছিল ‘টই’ আর ভাইয়ের নাম, ‘টম্বুর’। দুর্গাপুজোর দিনগুলো যেন আমাদের সবাইকেই ওই দুটো নামের ব্র্যাকেটে ভরে দিত। নিজেদের অজান্তেই কখন যে টইটম্বুর হয়ে উঠতাম আমরা!
কোথাও একবার পড়েছিলাম, দুর্গাপুজোর উৎসব প্রাধান্যের জন্যই পূজাক্ষেত্রে দুর্গা প্রাধান্য লাভ করলেন না, করলেন কালী এবং দশমহাবিদ্যার অন্য দেবীরা। কিন্তু সাধনা কি কেবলমাত্র কোনও সাধকের গুহায় বসে দেবীর ধ্যান করা? এক জন মানুষের অনেক মানুষের অংশ হয়ে ওঠার যে প্রক্রিয়া, সেটাও কি প্রকৃতিতে আঙুল দিয়ে মহাপ্রকৃতিকে অনুভব করারই সাধনা নয়? সেই কারণেই তো সিদ্ধিলাভ করার পরও সন্ন্যাসীরা পাহাড় থেকে নেমে আসেন সমতলে। শিক্ষার পরের ধাপ যে লোকশিক্ষা তাকে অনুভব করার জন্য। আর জীবনের চাইতে বড় লোকশিক্ষা কী হতে পারে? সেই জীবনই যেন তার ঊষা আর গোধূলি নিয়ে উন্মোচিত হত সেই ছোটবেলার দুর্গাপুজোগুলোয়।
আমাদের কৈশোরে দুর্গাপুজো দ্বিতীয়া থেকে দ্বাদশী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল না। ছিল না এত আলো, এত রোশনাই, এত টাকার ঝনঝনানি। ছিল ছিটের জামা, ছিল খেলনা পিস্তল থেকে ক্যাপ ফাটানোর দেদার আনন্দ, ছিল, এমনকি শহরের প্রান্তে ফুটে ওঠা কাশফুল। সবচেয়ে বেশি করে ছিল, একটা পুজো ঘিরে অনেক পরিবারের উৎসাহ। দুর্গাপুজোই যেন সেই সিমেন্ট যা অনেকগুলো ইটকে একটা বাড়ির চেহারা দিত ওই আশ্বিন-কার্তিক মাসে।
আরও পড়ুন: বদলে গেছে পুজোর রং, আমার বুকে আজ আর তোলপাড় নেই: অর্পিতা
তখন কয়েকটা প্যান্ডেল ছাড়া দর্শনার্থীর ঢল নামত না। তাই ওই একডালিয়া এভারগ্রিন, সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার, মহম্মদ আলি পার্ক’কে বাদ দিলে বাকি পুজোগুলোর সঙ্গে জড়িত সবাই প্রতিমাকে ঘরের মানুষ হিসেবে উপলব্ধি করার পাশাপাশি নিজেদের ঘর আর বারান্দাটাকেও আর একটু ভাল করে চিনে নিতে পারতেন, যার রেশ পুজো পেরিয়ে বিজয়া দশমীর দিনগুলোতেও থেকে যেত যখন নাড়ু আর মুড়কির গন্ধে-গন্ধে এই বাড়ি, ওই বাড়ি ঘুরে বেড়াতাম।
মা দুর্গা তখন পঞ্চমীর রাতে মণ্ডপে আসতেন। আর স্কুল চলত পঞ্চমীর বিকেল অবধি। ষষ্ঠীর বোধন যেন রিপ ভ্যান উইঙ্কলের মতো আমাদের সবাইকে একটা শীতঘুম থেকে জাগিয়ে তুলত। আসছে দিনগুলোয় রোজ বই মুখে করে বসতে হবে না, এই আনন্দটাই ছিল পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা। তার সঙ্গে জুড়ে যেত কাছে-দূরে ঠাকুর দেখতে যাওয়ার সম্ভাবনা। সেই সব প্রতিমার নির্মাণে শিল্প ছিল, কিন্তু থিমের আতিশয্য ছিল না। মা দুর্গাকে চেক জিমন্যাস্ট মনে হবে, এ রকম ঠাকুর ছোটবেলায় দেখিনি, হলফ করে বলতে পারি।
যা দেখতাম, যাঁকে দেখতাম, তাঁকে মাটিতে মাথা রেখে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করতে ইচ্ছে হত। প্রণামের শেষে প্রসাদ পেলে, প্রসাদ খেয়ে হাতটা মাথায় মুছে ফেলার ইচ্ছা হত, যাতে স্বাদ ফুরিয়ে যাওয়ার পরেও আশীর্বাদ বেঁচে থাকে।
মিস করি, সেই পুজোটাই খুব মিস করি। যে পুজোর দশমীর সন্ধ্যাতেই ভাসান হয়ে যেত। ভাসানের আগে লরির সামনে যে ছেলেগুলো নাচত, ভাসান থেকে ফেরার পথে তাদের নাচের ভঙ্গি যেত বদলে। কোত্থেকে যেন অনেকখানি বিষণ্ণতা এসে মিশে যেত বাতাসে, ভিড় বাড়াত ফুসফুসে। চালের ভিতর থেকে পাথরকুচি বের করার চাইতেও অনেক বেশি কষ্ট হত সেই বেদনাকে বুক থেকে সরাতে। তারপর একসময় মণ্ডপের খাঁ খাঁ শূন্যতা থেকেই জন্ম নিত প্রতীক্ষা, পাল্টাতে থাকা ঋতু কখন যেন আবারও রোদের গায়ে রাংতার আভাস দিয়ে যেত। আজও যায়।
আরও পড়ুন: ঠাকুর গড়া দেখতাম, দেখতাম সদ্য শাড়ি পরা কিশোরীটিকেও: জয় গোস্বামী
কলকাতার থেকে দূরে, বীরভূম আর সাঁওতাল পরগনার সীমান্তে, দেশের বাড়ির পুজোয় গেলে পরে, ভোরের তারাই সাঁঝের তারা হয়ে ফিরে ফিরে আসে। লালমাটির ভালবাসা সাতরঙা হয়ে ওঠে যখন অভুক্ত মানুষটি নিজে খাবার আগে শালপাতা এগিয়ে দেয় পাশের মানুষটির দিকে। সবার সঙ্গে বসে না খেলে অন্ন যে ভোগ হয়ে ওঠে না, সবার পাশে ফুল হাতে না দাঁড়ালে নিবেদন, অঞ্জলির রূপ নেয় না। একা মানুষ অংশ হয়ে ওঠে না, মহাসময় আর মহাস্রোতের।
সেই অভিজ্ঞতা অনুভব করা যায় শুধু, বলা যায় না। কারণ যা বলা হয়ে যায় তা তো বলাই হয়ে যায়। যা বলা হয় না, তাইই থেকে যায় কালের সঞ্চয়ে। সেই মহাপরিণামী কাল তার দশ দিকে দশ ভাবে ছুটে যায়। আমিও তার সঙ্গে সামনের দিকে যেতে যেতে টের পাই, অতীতের নাগরদোলায় বসেই ভবিষ্যতের মাটিতে নামা যায়। আর দু’জায়গা থেকেই ঢাকের বাদ্যি আর কাঁসরের আওয়াজ একই রকম ভাল লাগে।
অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy