Advertisement

Associate Partner

Style Partner

Associate Partner

Weddings Partner

Food Partner

Durga Puja 2019

বদলে গেছে পুজোর রং, আমার বুকে আজ আর তোলপাড় নেই: অর্পিতা

প্যান্ডেলে পা রাখলেই একটার জায়গায় তিনটে চেয়ার জুটে যেত বরাতে।

অর্পিতা চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১৭:০২
Share: Save:

পুজো আসে, পুজো যায়। আর আমার পুজো বদলে ফেলে তার রং। এই যে কুমোরটুলি থেকে গড়িয়াহাটের ফুটপাত, সর্বত্র পুজোর সাজ সাজ রব, তাতে আমার বুকে আজ আর কোনও তোলপাড় নেই। অথচ সেই অনেক দিন আগে আমার টেপফ্রক বয়সে পুজো আসতো বুকে ঝড় তুলে।

পাড়ার পুজোটা হত আমার বাড়ির ঠিক সামনেই। ঠেলায় করে বাঁশ, নারকেল দড়ি, রঙিন কাপড় আসতো। বাঁশের সঙ্গে বাঁশ জুড়ে আমার চোখের সামনে একটু একটু করে তৈরি হত পূজামণ্ডপ। আমার ছটফটানি বাড়তো, মন পড়ে থাকত বাঁশে পেরেক ঠোকা শব্দের কাছে। আর আমার অঙ্ক ভুল হত। পুজোর প্রায় এক মাস আগে থেকেই দুটো একটা করে নতুন জামা কেনা হত। কী আশ্চর্য, নতুন জামায় নাক ডোবালেই পুজোর গন্ধ! ষষ্ঠীর দিন সারা দুপুর ধরে নারকেল কোরা হত। বিকেলে থালা ভর্তি নারকেল ছাপা, নারকেল নাড়ু। পুজোর দিনগুলো কেটে যেত প্যান্ডেলে বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করে। চেয়ারের দখল নিয়ে আড়ি হত, ভাব হত। খেলতে খেলতে পড়ে গিয়ে হাঁটু কাটত। এই সব তুচ্ছতার ভেতরই খুঁজে পেতাম কত রং। কী মজা, পুজোর ক’দিন লেখাপড়ার বালাই নেই, ক্লাস নেই, গানের রেওয়াজ নেই, নাচের তালিম নেই। শুধু দুটো ছোট ছোট পায়ে আকাশ বাতাস এফোঁড় ওফোঁড় করে ছুটে বেড়ানোর স্বাধীনতা।

তখন পুজোয় সব থেকে আনন্দের বিষয় ছিল, অষ্টমীর দিন কাকিমা ছোট চুমকি বসানো ব্যাগে দশ টাকা ভরে আমার হাতে দিত। সেই ব্যাগে ঠাকুমা কিছু দিত। কাকু কিছু দিত। সেই টাকার মালিক শুধু আমি। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরন নামত পায়ের পাতায়। সেই টাকা দিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আইসক্রিম, ফুচকা, চটপটি খেয়ে যখন বাড়ি ফিরতাম, হলুদের দাগে, বরফ জলের দাগে, তেঁতুল জলের দাগে দামি জামার দফারফা। তখনও যে মুল্যবানের মুল্য দিতে শিখিনি আমি। তখনও যে মাথার ভেতর জ্ঞান ঢোকেনি। মনের ভেতর হিসেব ঢোকেনি।

পুজো আসে, পুজো যায়। আমি তখন ষোলো। আমি তখনও মাঝেমধ্যে শাড়ি। পুরুষের দিকে আড়চোখে তাকাতে শিখেছি। আই-ব্রো প্লাক করেছি। চুটিয়ে কাজ করছি বিজ্ঞাপন জগতে। সদ্য সানন্দা মিস তিলোত্তমা হয়েছি। রাত জেগে আধুনিক গানের ফাংশন করছি। তার সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছি পড়াশোনাও। বাবার কঠিন কঠোর শাসনের ভেতর আমার জীবনের গল্পটা যখন এই রকম তখন আমার কাছে পুজো এল অন্য রং নিয়ে। তখন প্যান্ডেলে বসার চেয়ার নিয়ে আর কাড়াকাড়ি করতে হত না। প্যান্ডেলে পা রাখলেই একটার জায়গায় তিনটে চেয়ার জুটে যেত বরাতে। যারা ঠাকুর দেখতে আসত কৌতূহলী চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত আমাকে। ওদের সেই দেখাটুকু দারুণ উপভোগ করতাম আমি। পাড়ার ক্যাবলা ছেলেগুলো ঘুরঘুর করত আমার চারপাশে। একটু একান্তে কথা বলার জন্য উৎসুক হয়ে থাকত। ওদের এই হ্যাংলামি দেখলেই আমার অহঙ্কারী গ্রীবায় বিশেষ একটা ছন্দ আসত বুঝতে পারতাম। বুঝতে পারতাম, প্রিয় বন্ধুরাও আড়ষ্ট হয়ে আছে আমার কাছে। চোরা চাহনিতে মেপে নিচ্ছে আমার জুতোর হিল, শাড়ির রং, চুলের স্টাইল। হাতে হাত রেখে পাশাপাশি বসেও সে দিন অনুভব করেছি এক হাতের উষ্ণতা আর এক হাতে আর গড়িয়ে পড়ছে না। দুটো হাতের মধ্যে বিস্তর দূরত্ব মেনে নিয়েছি। এ ভাবেই মেনে নিতে হয়।

এ ভাবেই পুজো আসে, পুজো যায়। সিনেমায় অফার পেলাম আমি। কয়েকটা সিনেমায় কাজ করলাম। আরও কয়েকটা সিনেমায় কাজের কথা চলছে। তখন রোজ কল টাইমে ছুটে যাচ্ছি স্টুডিও পাড়ায়। আউটডোর শুটিংয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি দার্জিলিং, শিলং, চেন্নাই। আমি রীতিমতো নায়িকা হয়ে উঠেছি। পুজো পত্রিকার কভার পেজে আমার মুখ। মনে পড়ে খুব সেজেগুজে সপ্তমীতে অথবা নবমীতে বিভিন্ন ক্লাবের প্রতিমা জাজমেন্ট করতে যেতাম। গাড়ি থেকে নেমে দু-ধারে সরে থাকা ভিড়ের মাঝখান দিয়ে পুজোমণ্ডপের দিকে চলেছি আমি। দু’ ধারে মানুষজনের উদগ্রীব চোখ, আমার সঙ্গে ছবি তোলার বায়না, আমাকে ছুঁয়ে দেখার জন্য বাড়িয়ে রাখা হাত মনে মনে দিব্বি উপভোগ করতাম। এই সময়ে পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্নই হয়ে গেল। শুটিংয়ের চাপে বন্ধ হয়ে গেল গানের জলসা। জীবন এক হাতে যেমন দেয়, অন্য হাতে তেমন কেড়েও নেয়।

তবুও পুজো আসে, পুজো যায়। আমার পুজো বদলে ফেলে তার রং। আমার বিয়ে হল। সে বছরই আমার প্রথম সিঁদুর খেলা। সিঁদুর খেলার চোরা ইচ্ছেটা বহু দিন ধরে মনের মধ্যে লুকিয়েই ছিল। দশমীর বিকেলে বরণের থালা হাতে নিয়ে পুজোমণ্ডপে যেতে যেতে বেশ বুঝতে পারি, আমার চলার ছন্দে ঘোর লেগেছে। রিমঝিম বৃষ্টি পড়ছে মনের ভেতর। তারপর মনের আশ মিটিয়ে সিঁদুর খেললাম। মাথায় একশো হাতের সিঁদুর নিয়ে গরবিনী হয়ে উঠল আমার সিঁথি। পুজোর আসা যাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে গেল আমার বিবাহিত জীবন নানা ছন্দে, নানা বর্ণে, নানা গতিপথের মধ্যে দিয়ে।

পুজো আসে, পুজো যায়। আমার কোলে মিশুক এল। মিশুক একটু একটু করে বড় হল। তখন পুজোর সবটুকু ব্যস্ততা ওই মিশুককে ঘিরে। মিশুকের জামাপ্যান্ট, মিশুকের সাজ, মিশুকের ঠাকুর দেখা, মিশুকের দুষ্টুমি, মিশুককে ঘিরেই আমার জীবন আবর্তিত হত। পুজোর ভিড়ে বেরতে আর ভাল লাগত না। সন্ধ্যেবেলা বাড়িতেই বন্ধুদের ডেকে নিয়ে খাওয়াদাওয়া, গানবাজনা, হইহুল্লোড় করে পুজোর দিনগুলো ফুরিয়ে দিতাম। আমি গান গাইতাম। বুম্বা তবলা টেনে নিত। এই ভাবে কেবলই বদলে যায় আমার পুজোর রং।

এখন যেতে যেতে গাড়ির জানলা দিয়ে দেখি শহরের ধুলো ধোঁয়ার পাশে দারুণ সেজে উঠেছে পুজো। তবু আমার বুকে কোনও তোলপাড় নেই। এখন মিশুক হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করছে। পুজোয় ওর ছুটি নেই, বাড়ি আসতে পারে না। মিশুকের শূন্যতাটুকু বুকে রেখে পুজো ওপেনিং-এ ফিতে কাটি। মুম্বইয়ে শ্বশুরের পুজোয় ঘুরতে যাই। ফিরে এসে কল-শো করতে গ্রামেগঞ্জেও ছুটি। আর ধু ধু প্রান্তরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে দেখি পুজো কী ভাবে বদলে ফেলে তার রং।

এর পর আমি, বুম্বা বুড়ো হব। মিশুক বড় হবে। বউ আনবে। নাতি-নাতনি ছুটে বেড়াবে ঘরময়। তখন আমার পুজো কী রং বয়ে নিয়ে আসে, মোটা পুরু চশমার ভেতর দিয়ে অবশ্যই তা দেখব, কথা দিলাম!

অলঙ্করণ: তিয়াসা দাস

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy