বাড়ির নীচ দিয়ে সুড়ঙ্গ চলে গিয়েছে বাবুঘাট পর্যন্ত। রানির স্বামীর তৈরি করা ঘাট। পরিবারের মেয়েরা এই পথেই গঙ্গাস্নানে যায় প্রতিদিন।রানি তো রোজই যান গঙ্গাস্নান করতে। তার পরে সেদিন আবার ষষ্ঠী!একেবারে কাক-ডাকা ভোর। রাসমণি স্নানের জন্য রওনা হবেন, প্রধান পুরোহিত রীতিমতো ক্ষুব্ধ, উত্তেজিত হয়ে হাজির হলেন তাঁর সামনে। কলাবৌকে গঙ্গাস্নানে নিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁরা। অত সকালে ঢাক-ঢোলের শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙে বিস্তর ঝামেলা করেছেন এক সাহেব।
ঘটনাটা চুপ করে শুনে পুজোর তদারকিতে চলে গেলেন রানি রাসমণি। ষষ্ঠীপুজোর দিন,মেলা কাজও রয়েছে। জানবাজারের বিরাট বাড়িটা আত্মীয়-স্বজন অতিথি-অভ্যাগতে ভর্তি। এমনিতেই বাড়ি ভরা লোক। পুজোর সময়ে তো তিলধারণের জায়গা হয়না। বিষয়টা পাঁচকান হতে দেরি হল না। আলাপ-আলোচনায় মোটামুটি একমতই হলেন সবাই- সাহেবদের সঙ্গে অকারণ বিবাদে যাওয়ার দরকার নেই। হাজার হোক সাদা চামড়া, একটু সমীহ তো তাঁদের প্রাপ্যই! ষষ্ঠীর অজস্র ব্যস্ততার মধ্যেও সেসব কানে এল রাসমণির। পরের দিন কলাবৌ নিয়ে গঙ্গাস্নানে যাওয়ার সময়ে দ্বিগুণ লোক এবং বাদ্যযন্ত্র ঘাটে পাঠিয়ে দিলেন তিনি। জল গড়াল অনেকদূর। শুরু হল মামলা মোকদ্দমা। রানি রাসমণির ৫০ টাকা জরিমানা হল। তবে এতে মোটেও টললেন না তিনি। সাহেবদের শিক্ষা দিতে তৎকালীন বাবুরোড ধরে সরাসরি বাঁশের খুঁটি পুঁতে রাস্তা ঘিরে দিলেন রাসমণি। বিপদে পড়লেন ইংরেজরা। হাঁটারই জায়গা নেই গাড়ি-ঘোড়া যায় কোথা দিয়ে? শেষেরানির সঙ্গে আপসে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিলেন তাঁরা। সেই থেকে মুখে মুখে ছড়া হয়ে গেল-‘অষ্ট ঘোড়ার গাড়ি দৌড়ায় রাণী রাসমণি/ রাস্তা বন্ধ কর্ত্তে পারল না ইংরেজ কোম্পানী।’
আরও পড়ুন: প্রতিমার সামনে নাচগানে মাতে বৈষ্ণবদাস মল্লিক বাড়ি
রাসমণির বাড়ির পুজো নিয়ে এমন নানা গল্প প্রচলিত ছিল সেই সময়ে। এই পুজোর ধরনই যে ছিল আলাদা। জাঁকজমক আর ঐশ্বর্যের প্রদর্শন নয়, দেবীবন্দনার প্রাণ ছিল ভক্তি, নিষ্ঠা আর ঈশ্বরপ্রেম। তবে রাসমণির আমলে কিন্তু এর সূচনা নয়। জানবাজারের এই বাড়িতে পুজো শুরু করেন তাঁর শ্বশুরমশাই প্রীতরাম মাড়। আমতার ঘোষালপুর গ্রামে ছিল তাঁর আদি নিবাস। খুব অল্প বয়সে পিতৃমাতৃহীন হয়ে ছোট দুই ভাইকে নিয়ে জানবাজারে এক জমিদার আত্মীয়ের বাড়ি এসে ওঠেন তিনি। এই জমিদার পরিবারের এক সদস্য ছিলেন ডানকিন নামে এক সাহেবের দেওয়ান। বেলেঘাটায় ছিল তাঁর নুনের কারবার।সেখানেই মুহুরীর কাজ পেলেন প্রীতরাম। ভালই চলছিল। হঠাৎই ভাগ্যবিপর্যয় ঘটল। মারা গেলেন ডানকিন সাহেব। প্রীতরাম অন্য উপায়ে শুরু করলেন রোজগার। প্রথমে বাঁশের ব্যবসা সেখান থেকে জেলাশাসকের সেরেস্তায় চাকরি, নাটোরের স্টেটের দেওয়ানের কাজ।সঙ্গে করলেন আরও অনেক কিছুই। ততদিনে বাংলার সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজিও আয়ত্ত করেছেন মেধাবী প্রীতরাম। ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে নাটোর রাজের অধীনস্থ মকিমপুরে ১৯ হাজার টাকায় কিনে নিলেন। এই সময়েই কলকাতায় শুরু করলেন কিছু ব্যবসা। জানবাজারে বানালেন বিরাট সাতমহলা বাড়ি।তখনকার যুগেপ্রাসাদোপম এই বাড়ি তৈরি করতে নাকি খরচ হয়েছিল ৫ লক্ষ টাকা!সময় লেগেছিল প্রায় দশ বছর। দেখার মতো ঠাকুরদালান ছিল এর শোভা।
এক চালার প্রতিমার পরনে থাকে ডাকের সাজ। ছবি-তৌষিক বসু।
বাড়ি তৈরির আগেই প্রীতরাম ঠিক করেছিলেন, এখানে দুর্গাপুজো করবেন। এরপরই ধুমধাম করে শুরু হল মাতৃআরাধনা। পুত্রবধু রানি রাসমণি যখন এই পুজোর দায়িত্ব নিলেন, তখন পুজোর শ্রী আরও বাড়ল। সেই সময়েই পুজোয় খরচ হত ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। রাসমণি ছোটবেলা থেকেই পরম ভক্তিমতী ছিলেন। প্রতিদিনই দুর্গাদালানে বিভিন্ন শাস্ত্রের আলোচনা, পুরাণ আর চণ্ডীপাঠ হত। রামায়ণ, মহাভারত, গীতাপাঠও হত। পুজোর সময়েও এসব বন্ধ হত না। এই বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণদেব সখীবেশে চামর দুলিয়ে দেবী আরাধনা করেন। সেই সময় পুজোতে যাত্রা,পালাগান,কথকতার অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এ বাড়ির বৈশিষ্ট্য ছিল দশমীর দিন কুস্তি প্রদর্শনী। দেশ বিদেশের কুস্তিগীরেরা আসতেন। শক্তি প্রদর্শনীতে বিজয়ীদের ৫০ থেকে ২০০ টাকা পর্যন্ত পুরস্কারও দেওয়া হত। এরপর কেটে গিয়েছে বহুদিন। রানি রাসমণির চার কন্যা- পদ্মমণি, কুমারী, করুণাময়ী এবং জগদম্বা। মথুরামোহন এবং জগদম্বার পৌত্র ব্রজগোপালের কন্যা লবঙ্গলতার বিয়ে হয় বিজয়কৃষ্ণ হাজরার সঙ্গে। হাজরা পরিবার থাকেন কাছারিবাড়িতে। রানি রাসমণি যে মণ্ডপটিতে পুজো করতেন, সেটি এই পরিবারেরই অংশে।
রাসমণি বাড়িতে কাঠামো পুজো হয় রথের দিন। এক চালার প্রতিমার পরনে থাকে ডাকের সাজ। এখানে ছাঁচে ফেলে ঠাকুরের মুখ গড়া হয় না। প্রতিমার মুখ তৈরি হয় হাতে এঁকে। চিত্রকরদের নিপুণ রেখার টানে অসাধারণ হয়ে ফুটে ওঠে দেবীর তেজস্বিনী মুখ। ২২ ফুটের প্রতিমার গায়ের রং হয় শিউলি ফুলের বোঁটার মতো। সরস্বতীর মুখ হয় সাদা। অসুরের মুখ সবুজ।
প্রতিপদথেকে ঘরে পুজো শুরু হয়। ষষ্ঠীর দিন হয় বোধন এবং বেলবরণ। ওইদিনই দেবীর হাতে অস্ত্র দিয়ে গয়না পরানো হয়। সপ্তমীর দিন বাড়ির সব দেবতা গোপাল, লক্ষ্মী–জনার্দনকে নীচে ঠাকুর দালানে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়। বাড়ির মেয়েরা রানি রাসমণির আমল থেকেই অন্দরমহলের একটি বিশেষ সিঁড়ি দিয়ে যাতায়াত করেন এই ক’দিন। পুজোর চারদিন মূল দরজা দিয়ে ঠাকুর দালানে আসা নিষেধ তাঁদের। সপ্তমী, অষ্টমী এবং নবমী এই তিনদিনই কুমারী পুজো হয়। এ বাড়িতে ভোগে দেবীকে লুচি ও পাঁচরকম ভাজা অর্পণ করা হয়। তবে সবই নুন ছাড়া। মিষ্টির মধ্যে দেওয়া হয় বিশেষ ভাবে তৈরি ‘মাতৃভোগ’, খাজা ,গজা, বোঁদে, নাড়ু। আগে হাজরা বাড়িতে বলি হত। বলির মাংসও অর্পণ করা হত ভোগে। এখন সে প্রথা আর নেই। বলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে বেশ কয়েকবছর।
দশমীর দিন ঘটে দেবীর বিসর্জনের পরে সকালেই সারা হয় বিজয়াপর্ব। প্রতিমার পায়ে আলতা-সিঁদুর দেন মহিলারা। দেবী বিদায়ের আগেই শেষ করে রাখা হয় রান্নার কাজ। বিসর্জনের পর সেদিন অরন্ধন। বাড়ির মেয়ে ফিরে গিয়েছেন পতিগৃহে। বাড়ির লোকেরা বিদায়ের বিষাদে রান্না করেন না দশমীতে।
আরও পড়ুন: প্রতিমার পায়ে বেঁধে দেওয়া হয় গৃহকর্ত্রীর মাথার চুল!
বিসর্জন হয়তো হয়, তবে এই বাড়ির মানুষ বিশ্বাস করেন দেবী এখানেবছরভর অধিষ্ঠিতা। শোনা যায়,রানি রাসমণি পুজোর দিনগুলিতে সারারাত নুপূরের আওয়াজ শুনতে পেতেন। দেবী বিচরণ করছেন বলে সচরাচর রাতে ঘর থেকে বেরনোর অনুমতি ছিল না কারও। সে সব নিয়ম আর নেই। তবু সে নিক্বণ নাকি আজও সারা বাড়ি জুড়ে খেলে বেড়ায়।
এই বাড়িতে বরাবরেই মতোই পুজোয় অবারিত দ্বার থাকবে দর্শনার্থীদের জন্য। তবে সামাজিক নিয়মবিধি মেনে মাস্ক পরে আসতে পারবেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy