ভরা আশ্বিনের রোদে লেগেছে চাঁপা ফুলের রং, সান্ধ্য বাতাসে ইতস্তত ভেসে আসে শিউলির সুবাস। আকাশে এখনও কালো মেঘের ঘনঘটা। আশ্বিনের আঙিনায় মাঝে মাঝে কয়েক পশলা ভারী বৃষ্টি সব কিছুকেই যেন ঝাপসা করে দেয়। ঠিক যেমন করোনা আবহে অজানা আশঙ্কায় ঝাপসা এ বছরের উৎসবের আমেজটাই। মন চাইছে প্রতিবারের মতো পুজোর আনন্দে মেতে উঠতে। কিন্তু হাজারো সতর্কতা আর বিধিনিষেধের মধ্যে মন যেন তাতে সায় দিচ্ছে না।
এ বছর অভিজাত, কর্পোরেট পুজোর মণ্ডপের কাজ অনেকটাই দেরিতে শুরু হয়েছে। তার উপর সরকারি বিধি নিষেধ মেনে মণ্ডপের উচ্চতাও কমানো হচ্ছে। আটপৌরে মধ্যবিত্ত পাড়ায় কোথাও মণ্ডপ তৈরির কাজ সবে শুরু হয়েছে, কোথাও বা মণ্ডপের কাজই শুরু হয়নি এখনও। কুমোরটুলি আর পটুয়াপাড়ায় অন্য বারের তুলনায় প্রতিমার বায়নাও এখনও কম। তার উপর দেরিতে বায়না আসায় প্রতিমা তৈরির কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে। তাই এখন দম ফেলার জো নেই। তবে বাড়ির পুজো হোক বা বারোয়ারি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিমার উচ্চতা কমানো হয়েছে।
এরই মাঝে নীরবে চলছে বনেদি বাড়ির পুজোর প্রস্তুতি। সে পুজোয় জাঁকজমক না থাকলেও তার আকর্ষণ ঐতিহ্য আর আভিজাত্য। এ বছর বেশির ভাগ বনেদি বাড়িতেই সাবেক রীতি ও প্রথা মেনে পুজো হলেও তা সীমাবদ্ধ থাকছে কেবলমাত্র পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। বহিরাগতদের প্রবেশাধিকার থাকছে না সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার নিয়ম মেনে। তাই ইতিমধ্যেই যাঁরা বনেদি বাড়ির পুজো দেখার কিংবা ঠাকুরদালানে বসে পরপর সেলফি তোলার কথা ভাবছেন, তাঁদের এ বছর বেশ হতাশ হতে হবে। এ ছাড়া, বেশ কিছু পরিবার এ বার পুজো সারছেন ঘটে-পটে। সমস্যা যাই থাক না কেন, পুজোয় যাতে কোনও ত্রুটি না থাকে, সে বিষয়েও সতর্ক সব পরিবারই।
আরও পড়ুন: ঐতিহ্য আর আভিজাত্যে ইতিহাস বয়ে চলছে শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো পদ্ধতি
শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় ও ছোট তরফের পুজোতেও থাকছে বিশেষ কিছু পরিবর্তন। সামাজিক দূরত্ব মানতে কেবলমাত্র পরিবারের সদস্যদের থাকছে প্রবেশাধিকার। পুজোয় ঢাক বাজবে সাউন্ড সিস্টেমে। পুজোর ভোগে মিষ্টির পরিমাণ কমানো হবে। এ ছাড়া, বিসর্জনের সুবিধার্থে প্রতিমার ওজন হালকা করারও চেষ্টা চলেছে।
চুনের প্রলেপে সেজে উঠছে কাশিমবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালান।
দর্জিপাড়ার রাজকৃষ্ণ মিত্রের বাড়িতে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় সরস্বতী পুজোর সময় থেকে। তৈরি হয় বিভিন্ন রকম আচার। পুজোর অর্ঘ্য বাছারও বিশেষ নিয়ম রয়েছে এ বাড়িতে। ধানের খোসা ছাড়িয়ে বেছে নেওয়া হয় অক্ষত চালের দানা। প্রতিটি অর্ঘ্যে ব্যবহৃত হয় ১০৮টি করে অক্ষত চালের দানা ও দূর্বা। এই পরিবারের মেয়ে অনসূয়া বিশ্বাস জানালেন, সামাজিক দূরত্ববিধি মেনেই পুজোর জোগাড় করা হচ্ছে। তবে এ বছর পুজোটি সীমাবদ্ধ থাকবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যেই। তেমনই পাথুরিয়াঘাটা খেলাতচন্দ্র ঘোষের বাড়ির পুজোতেও প্রবেশাধিকার থাকবে শুধু পরিবারেরই।
শহরের পাশাপাশি মফসসলেও রথযাত্রা কিংবা জন্মাষ্টমীতে কাঠামোপুজো দিয়ে শুরু হয় পুজোর প্রস্তুতি। শাস্ত্রসম্মত পুজো করতে দেবীর মহাস্নানের জন্য বৃষ্টির জল, শিশির, বিভিন্ন নদীর জল সংগ্রহ করা ছাড়াও মহাস্নানের দশ রকম মাটি (দশমৃত্তিকা) জোগাড় করাটাও সহজসাধ্য নয়। তাই এ বছর ভরসা দশকর্মা ভাণ্ডারের প্যাকেট করা দশমৃত্তিকা কিংবা মহাস্নানের জল। গ্রামগঞ্জের কিছু মানুষ বাড়তি দু’পয়সা উপার্জনের আশায় বনেদিবাড়িতে পৌঁছে দিতেন নীলকণ্ঠ পাখি। এই প্রথাও ক্রমেই লুপ্ত হয়েছে।
আরও পড়ুন: ব্রিটিশদের নেকনজরে সিদ্ধিলাভ, দুর্গা পুজো শুরু হল শোভাবাজার রাজবাড়িতে
তেমনই শহুরে পুজোয় ফুলওয়ালার ‘রেডিমেড’ নবপত্রিকা ভরসা হলেও গ্রামাঞ্চলের পুজোয় আজও বিভিন্ন বাগান ঘুরে কলা, বেল, ধান, হলুদ, ডালিম, অশোক, জয়ন্তী, মানকচু ও কচু গাছ জোগাড় করার রীতি চালু আছে। কয়েকটি বনেদি পুজোবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ বছর কেনা ফুলের ব্যবহারের ক্ষেত্রেও থাকছে সতর্কতা। ব্যবহারের আগে ফুল ও মালা স্যানিটাইজ করা হবে। কেউ বা নিজের বাগানের ফুলেই পুজো সারতে চাইছেন।
নরসিংহচন্দ্র দাঁ-র বাড়িতে কাঠামোপুজো শুরু।
অন্য বার বিশ্বকর্মা পুজোর আগেই শুরু হয়ে যায় ঠাকুরদালানের মেরামতি, চুনকাম। এ বার করোনা পরিস্থিতিতে অনেকেই বাড়িতে মিস্ত্রি ডেকে মেরামতি, চুনকামের কাজ করাতে চাইছেন না। তাই বাইরের কাউকে দিয়ে নয়, ঠাকুরদালান পরিষ্কার করতে বাড়ির পরিচারকের সঙ্গে হাত লাগাচ্ছেন বাড়ির সদস্যরাই।
অন্য বার কুমোরবাড়িতে রথযাত্রা থেকেই ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। দেবীঘট, কুণ্ডুহাঁড়ি, সহস্রধারা, ধুনুচি, সরা, অষ্টকলস এবং মাটির প্রদীপ তৈরিতে সময় কেটে যায়। খামখেয়ালি বর্ষার চোখরাঙানি এড়িয়ে মাটির জিনিসগুলি রোদে শুকিয়ে, ভাটায় পুড়িয়ে, রং করে বাড়ি বাড়ি কিংবা দোকানে জোগান দিতে হয় প্রতিবছর। তবে এ বছর বেশ কিছু পুজো না হওয়ায় চাহিদা কম। তার উপর বেড়েছে সব কিছুরই দাম। তাই দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে কুমোরদের।
আরও পড়ুন: বর্গী হামলায় বন্ধ হয়নি কালনার চট্টোপাধ্যায় পরিবারের পুজো
কুমোরটুলির পাশাপাশি প্রতিমার সাজ তৈরি হয় বর্ধমানের বনকাপাশি, নদিয়ার কৃষ্ণনগর, নবদ্বীপ, বহরমপুর, এবং হাওড়ার বিভিন্ন জায়গায়। কৃষ্ণনগরের সাজশিল্পীরা আক্ষেপ করে বলছিলেন, “এ বার বায়না কম এসেছে। তার উপরে মার্চের শেষ থেকে লোকাল ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় একদিকে কাঁচা মালের জোগান কম। আবার কলকাতা ও অন্যান্য শহরে সাজ পৌঁছে দিতেও সমস্যা হচ্ছে।”
পুজো আসে প্রতি বার। তবে এ বারের পুজোটা একটা চ্যালেঞ্জ! ‘করোনাসুর’কে পৃথিবী থেকে নির্মূল করে আবারও স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার চ্যালেঞ্জ!
ছবি: পরিবার সূত্রে পাওয়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy