বছরে একবারই মেয়ে আসেন বাপের বাড়িতে। তাই তাঁর মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা না করলে হয়! ঘরের মেয়ের বিনোদনে কবির লড়াই, খেমটা, তরজা, টপ্পা, এমনকি, বাইনাচেরও থাকত এলাহি আয়োজন। সাবেক কলকাতায় বলা হত, মা দুর্গা এ বাড়িতে আমোদে ডুবে থাকেন। তাই তিনি এখানে আমোদিনী। যে ঠাকুরদালানে এই উপচে পড়া আমোদের আয়োজন হত, সেই বাড়ি পরবর্তী কালে হয়ে ওঠে প্রাসাদনগরীর ‘রাজবাড়ি’। আমোদিনীর পুজোকে বলা হত ‘কোম্পানির পুজো’। কারণ ফিরিঙ্গিরা ছিল সেই বনেদি দুর্গোৎসবের অন্যতম মূল অংশ।
সাধারণ বাড়ি থেকে তিলে তিলে রাজবাড়িতে উত্তরণের নেপথ্যে আছে উর্দু, আরবি ও ফারসি ভাষার অবদান। শৈশবে পিতৃহীন নবকৃষ্ণ এই ভাষাগুলি শিখেছিলেন তাঁর মায়ের উদ্যোগে।পরে শিখে নিয়েছিলেন ইংরেজিও। একসঙ্গে এতগুলো বিদেশি ভাষায় দখল পরবর্তী কালে হয়ে দাঁড়ায় তাঁর উন্নতির তুরূপের তাস। যুবক নবকৃষ্ণ কাজ পেয়েছিলেন ব্রিটিশদের কুঠিতে। পরে তিনি হয়ে ওঠেন ওয়ারেন হেস্টিংসের ফারসি শিক্ষক।
পলাশি যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ে ব্রিটিশদের অকুণ্ঠ সাহায্য করেছিলেন তিনি। ফলে দু’পক্ষের সম্পর্ক দৃঢ় হতে সময় লাগেনি। পলাশির যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের জয় উদযাপন করতে নবকৃষ্ণ দেবের বাড়িতে বসল দুর্গাপুজোর আসর। সেই বাড়িতে, যা তিনি ব্যবসায়ী শোভারাম বসাকের আউটহাউজ কিনে তৈরি করেছিলেন। বণিকের মানদণ্ড যত তাড়াতাড়ি শাসকের রাজদণ্ডে পরিণত হল, তত দ্রুত পরিবর্তন এল নবকৃষ্ণের জীবনেও। তাঁর নামের আগে ‘রাজা’ এবং পরে ‘বাহাদুর’ উপাধি বসল। শোভারাম বসাকের নামের বাজারে রাজা নবকৃষ্ণ দেবের বাড়ির পরিচয় হল ‘শোভাবাজার রাজবাড়ি’ হিসেবে।
ফানুসে চিত্রিত শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতীক
চকমেলানো সেই বাড়িতে ১৭৫৭ সালের আশ্বিনে প্রথম বসেছিল দুর্গাপুজোর আসর। প্রধান অতিথিদের মধ্যে ছিলেন রবার্ট ক্লাইভ ও তাঁর সঙ্গীরা। তাঁদের জয়কে উদযাপন করতেই শুরু হয়েছিল রাজবাড়ির দুর্গোৎসব। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা সাহেবদের মন জয় করতে বিনোদনের কোনও অভাব ছিল না। কথিত, শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো বা কোম্পানির পুজোই কলকাতায় আয়োজিত প্রথম শারদোৎসব।
কিন্তু এত আনন্দের মধ্যেও বিষাদের সুর। কারণ একাধিক স্ত্রী সত্ত্বেও নবকৃষ্ণ অপুত্রক। শেষ অবধি তিনি দত্তক নেন ভাইয়ের ছেলে গোপীমোহনকে। অবশেষে নবকৃষ্ণের চতুর্থ স্ত্রী জন্ম দেন এক পুত্রসন্তানের। তাঁর নামকরণ হয় রাজকৃষ্ণ। দুই সন্তানের মধ্যে সম্পত্তি ভাগ করে রাজা নবৃকষ্ণ আরও একটি প্রাসাদতুল্য বাড়ি নির্মাণ করান পুত্র রাজকৃষ্ণের জন্য। সেই বাড়িতে পুজো শুরু হয় ১৭৯০ খ্রিস্টাব্দে।শোভাবাজার রাজবাড়ির দুই শাখার দুর্গাপুজো পরিচিত বড় তরফ ও ছোট তরফের পুজো নামে। বড় তরফের কাঠামো পুজো হয় সোজা রথযাত্রার দিন। ছোট তরফের পুজোর কাঠামো পুজোর তিথি উল্টোরথ।
এ বার হাতে আঁকা চালচিত্রে সাজছে প্রতিমা
আমোদিনী হলেও এই বনেদি বাড়িতে মা দুর্গা থাকেন চিকের আড়ালে। ঘরের মেয়ের আব্রু রক্ষা করতেই এই চিক। প্রতিমার সামনে ঝোলে ছোট ছোট অভ্র টুকরোর আবরণ। এর ফলে দেবীর মুখ পুরোপুরি ঢাকা পড়ে না। আবার আড়ালও থাকে। অতীতে আমোদিনীর সঙ্গে বাড়ির মেয়ে বৌরাও থাকতেন চিকের অন্তরালে। চিকের আড়াল থেকেই তাঁদের চোখে ধরা পড়ত বিনোদনের চাকচিক্য।
সেই সময় রাজবাড়ির প্রতিমার জাঁকজমকের সাজ ডাকযোগে বিদেশ থেকে আসত। পুরাতনী ডাকের সাজ আসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে বহু দশক। প্রতিমাকে সাজানোর দায়িত্ব এরপর বর্তায় কৃষ্ণনগরের শিল্পীদের উপর। তাঁরাই যত্ন করে প্রতি বছর সাজাতেন মা দুর্গা ও তাঁর সন্তানসন্ততিদের। অন্যান্য সাবেক বাড়ির প্রতিমার সাজের তুলনায় শোভাবাজার রাজবাড়ির প্রতিমার সাজে পার্থক্য অনেক। বাঙালি ঘরানা নয়, বরং মা দুর্গা এবং তাঁর সন্তানসন্ততি এখানে সেজে ওঠেনডাকের সাজের পশ্চিমী শৈলির ঘরানায়। দূর থেকে তো বটেই, কাছে গেলেও চট করে ধরা পড়ে না সূক্ষ্ম পার্থক্য। সাদা চোখে বোঝা যায় না দুর্গতিনাশিনী এবং তাঁর দুই কন্যার পরনে আছে রাংতার পোশাক। দেখলে মনে হয় যেন বেনারসীর আবরণ। কার্তিক, গণেশের রণসাজ কাপড়ের তৈরি হলেও রাংতার প্রাধান্য লক্ষণীয়। বাড়ির প্রবীণ সদস্য অলককৃষ্ণ দেব বললেন, আগে সিংহের আবরণ ছিল খাঁটি রুপো। বিদেশ থেকে আসা সেই রুপোর পাতে আবৃত হতেন মা দুর্গার বাহন। বিসর্জনের সময় রুপোর আবরণ-সহই গঙ্গায় ফেলা হত সিংহকে। এখন অবশ্য ভরসা রুপোলি রং।
স্থাপিত ‘চণ্ডীমণ্ডপ’, এক মাস ধরে পুজো করা হয় দুর্গাপুজোর ঘটের
অতীতে বিশেষত্ব ছিল প্রতিমার অলঙ্কারেও। ধুনো থেকে তৈরি হত আঠা। সেই আঠায় একটি একটি করে গাঁথা হত রুপোলি পুঁথি। একে বলা হত ‘বুলনের কাজ’। সেই কাজের গয়না পরানো হত দুর্গা, লক্ষ্মী ও সরস্বতীকে।এরপর গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আজ সেই শিল্পী নেই। সাজ-ও সরে এসেছে অনেকটাই। গত আড়াই দশকে সাবেক সাজে প্রভাব ফেলেছে আধুনিকতা। আক্ষেপ করছিলেন দেবাশিসকৃষ্ণ দেব। শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোট তরফের উত্তর প্রজন্ম।
কিন্তু এ বছর প্রতিমার সাজে পুরনো ঘরানা ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর দেব পরিবার। পুরনো ছবি ঘেঁটে, বাড়ির প্রবীণ প্রজন্মের স্মৃতি উস্কে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে সিকি দশক আগের সাজ। কৃষ্ণনগরে গিয়ে রাজবাড়ির সদস্যরা শিল্পীদের বুঝিয়েছেন,ঠিক কেমন হবে বুলনের কারুকাজ।
আরও পড়ুন: দত্তবাড়ির পুজোর সুরে মিশে থাকে দেশাত্মবোধের আবেগ
প্রতিমার সাজসজ্জার পাশাপাশি এই বনেদি রাজ পরিবারের দুর্গোৎসবের বিশেষত্ব কলাবউ স্নানে। সপ্তমীর সকালে শোভাবাজার রাজবাড়ির কলাবউ বা নবপত্রিকা যায় স্নানে। তাঁর মাথায় থাকে ভেলভেটের ছাতা। বহু ব্যবহারে সে ছাতা আজ জীর্ণ ও দীর্ণ। কিন্তু আভিজাত্য চুঁইয়ে পড়ে প্রতি নিক্তিতে। অতীতে কলাবউ থাকত সালঙ্কারা। রাজপথের দু’ধারে সবাই হাঁ করে দেখত রাজবাড়ির নবপত্রিকার স্নানযাত্রা। আজ,সপ্তমীর আমন্ত্রণ-অধিবাসের পরে একবার দেখা দিয়েই মিলিয়ে যায় মখমলি সেই ছাতা। ছোট তরফের সদস্য তীর্থঙ্কর দেব জানালেন, আগে সপ্তমীর দিন ভোরবেলা পরিবারের সদস্যরা কলাবউ স্নান করাতে যেতেন মন্ত্রোচ্চারণ আর স্তোত্রের মধ্য দিয়ে। একে বলা হত দেবীবন্দনা। চারিদিক থেকে শোনা যেত সেই পবিত্র গান। আশপাশের লোকেরা তখন যাকে বলত ‘নয়া রাস্তা’, এক দিকে সেই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এবং অন্য দিকে ‘রাজা রাস্তা’, অর্থাৎ রাজা নবকৃষ্ণ দেব লেন মুখরিত হয়ে থাকত গানে। পরবর্তী কালে বড় বড় মাইক লাগিয়ে দেওয়া হত রাস্তার চারিদিকে। কিন্তু ১৯৬৮-তে কোনও কারণে এই প্রথা বন্ধ হয়ে যায়। পরে আবার সেই রীতি ফিরে আসে কয়েক বছর আগে।
দর্পণে দশভুজা
কালের স্রোতে ছাতার ভূমিকা হ্রস্ব হয়েছে। মিলিয়ে গিয়েছে কামানের নির্ঘোষ। সন্ধিপুজোয় কামানের পরিবর্তে, ধ্বনিত হয় ডাবল ব্যারেল শট গান-এর হুঙ্কার। গোপীনাথ জিউ পরিবারের কুলদেবতা হলেও ছোট তরফের দুর্গাপুজোয় এখনও পাঁঠাবলি হয় | কিন্তু মায়ের ভোগ হয় সম্পূর্ণ নিরামিষ। অব্রাহ্মণ হওয়ার জন্য দেব পরিবার অন্ন ভোগ দিতে পারে না | তাই সাজিয়ে দেওয়া হয় কাঁচা চাল। এই চালের উপর কলা, চিনি আর ক্ষীরের মণ্ড সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয়। একে বলে ‘আগা’।সঙ্গে থাকে বড় লাড্ডু,মিষ্টি,খাজা,গজা আর নিমকি।
অতীতে ঠাকুরদালানে সাজিয়ে দেওয়া হত বাহান্ন রকমের ভোগ নৈবেদ্য। এখন মেদিনীপুর থেকে আসা পাচক ব্রাহ্মণরা বানিয়ে থাকেন আঠেরো-উনিশ রকমের ভোগ। অব্রাহ্মণ বলে দেওয়া হয় না অন্নভোগ। তবে চৌকৌ গজা, জিবেগজা, রাধাবল্লভী, জিলিপি দিয়ে সাজানো হয় নৈবেদ্য।
আরও পড়ুন: আন্দুল দত্তচৌধুরী বাড়ির পুজোয় কুমারীকেও হাতে পরতে হয় শাঁখা
আগে দশমীতে ঘোড়াকে পুজো করা হত। এখন তা আর হয় না। তবে ঘোড়ার জন্য উৎসর্গ করা হয় ছোলা। ঐতিহ্য মেনে এখনও হয় কনকাঞ্জলি। আগে প্রতিমার সামনে সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোনা রুপোর মোহরে ভরা চাল ফেলতেন পুরোহিত। কাঠামোর পিছনে দাঁড়িয়ে তা গ্রহণ করতেন বাড়ির গৃহিণীরা। এখন সে প্রথার রূপ পাল্টেছে। পুরোহিত সিঁড়ি বেয়ে উঠতে রাজি হন না। নীচে দাঁড়িয়েই তিনি পিছন ফিরে ছুড়ে দেন চাল। তা গ্রহণ করেন বাড়ির ছেলেমেয়েরা। কাপড়বন্দি কনকাঞ্জলি তুলে রাখা হয় সিন্দুকে। আবার এক বছরের অপেক্ষা। পরের বছর সিন্দুক খুলে বার করে আনা হয় কনকাঞ্জলির অর্ঘ্য।
নীলকণ্ঠ পাখির ছবি নিয়ে ফানুস উড়ে যাবে
তার আগে নীলকণ্ঠ পাখি ডানা মেলে মনের আকাশে। নীল আকাশে তার ওড়া এখন নিষেধ। তাই সে জায়গা পেয়েছে ফানুসের গায়ে। গত বছর থেকে এই ফানুস পর্ব শুরু হয়েছে শোভাবাজার রাজবাড়ির ছোট তরফের পুজোয়। এ বছরও বাড়ির সদস্য প্রবীরকৃষ্ণ দেবের উদ্যোগে তৈরি হচ্ছে দু’টি ফানুস। একটির গায়ে আঁকা হবে নীলকণ্ঠ পাখি। অন্যটিতে শোভাবাজার রাজবাড়ির ইতিহাস। প্রথমটি উড়িয়ে দেওয়া হবে নিরঞ্জনের আগে। অন্যটি ওড়ানো হবে মাঝ গঙ্গায় পৌঁছে।
এরপর…ঠাকুরদালানে জমে থাকে শুকনো বেলপাতা। যার থেকে বেশ কিছু পাতা ঠাঁই পায় রাজবাড়ির গৃহিণীদের আঁচলে। বেলপাতায় আলতা দিয়ে দুর্গানাম লিখে নিজেদের কাছে রাখেন তাঁরা। সিঁদুরখেলার বদলে দশমীতে এটাই রেওয়াজ এই বাড়ির।
শুকনো বেলপাতায় বলিরেখা বাড়ে। ঠাকুরদালানে ঝাড়লণ্ঠনের অপেক্ষাও দীর্ঘ হয়। আবার কবে দশভুজার ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত হবে সে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy