অষ্টমীর ভিড় উপচে পড়েছে ঠাকুরদালানে। কামানের নির্ঘোষের সঙ্গে শুরু হয়েছে সন্ধিপুজো। হঠাৎ চমকে গেলেন গৃহকর্তা রাধাকান্ত দেব। তাঁর পায়ে এসে মুখ গুঁজেছে বলির পাঁঠা। কিছু ক্ষণ পরেই যার ঘাড়ে নেমে পড়বে বলির খাঁড়া! কী ভাবে যেন বেচারি হাঁড়িকাঠ থেকে পালিয়েছে।
নবকৃষ্ণ দেবের নাতি রাধাকান্ত বললেন, যে তাঁর কাছে আশ্রয় চাইতে এসেছে, তার প্রাণ তিনি নিতে পারবেন না। কিন্তু শাক্ত আরাধনা যে রক্ত ছাড়া হয় না! বিধান দিলেন শাস্ত্রকাররা। শুনে রাধাকান্ত বললেন, তাঁরা বৈষ্ণব হলেও মা দুর্গার আরাধনা নিয়ম মেনেই করবেন। প্রয়োজনে রক্ত দেবেন তিনি নিজে। কিন্তু তাঁর উত্তরপুরুষরা যদি নিজেদের রক্ত দিতে রাজি না হন? প্রশ্ন তুললেন পুরোহিত। এ দিকে অষ্টমী নবমীর সন্ধিক্ষণ বয়ে যায় প্রায়। শেষে পুরোহিত ও শাস্ত্রজ্ঞরা বিধান দিলেন, বলি দেওয়া হোক মাগুর মাছ। সেই থেকে প্রতি বছর দুর্গাদালানে সন্ধিপুজোয় বলি দেওয়া হয় মাগুর মাছ। শোভাবাজার রাজবাড়ির বড় তরফের পুজোয়।
১৭৫৭ সালে শুরু হওয়া এই দুর্গোৎসবকে নিছক পলাশি যুদ্ধের উদযাপন বলতে রাজি নন সৌমিত নারায়ণ দেব। রাজবাড়ির বড় তরফের ঊর্ধ্বতন ৩৩তম পুরুষ। তাঁর কথায়, নবাব সিরাজউদ্দৌল্লার শাসনে অখুশি বঙ্গবাসী উদযাপনে সামিল হয়েছিল। তাঁরা তখন ব্রিটিশ শাসনকেই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ আশ্রয় বলে ভেবেছিলেন। তারই বহিঃপ্রকাশ শোভাবাজার রাজবাড়ির ঠাকুরদালানের দুর্গোৎসব। মনে করেন সৌমিত নারায়ণ দেব।
আরও পড়ুন:বউভাতের দিন বসুমল্লিক পরিবারে নববধূকে পরানো হয় মা দুর্গার বেনারসি
পারিবারিক নথি বলছে, দেব পরিবারের শাখা বিস্তৃত সুদূর দাক্ষিণাত্যে। সেখান থেকে যাত্রা শুরু করে দেব পরিবারের উত্তরপুরুষ রামচরণ থিতু হয়েছিলেন যেখানে, সেই জায়গার নাম অষ্টাদশ শতকে ছিল ‘কালিকট’। তার থেকেই উৎপন্ন ‘কলকাতা’ নাম। সে রকমই রয়েছে নাকি এই প্রাচীন পরিবারে রক্ষিত চিঠিপত্র ও নথিতে।
রামচরণের স্ত্রী ছিলেন আজকের ডায়মন্ড হারবারের কাছে ফলতার বসু পরিবারের মেয়ে। তাঁর নাম আজ ইতিহাসবিস্মৃত। কিন্তু এই পরিবারের ‘রাজপরিবার’ হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর ভূমিকাই অনুঘটক। দূরদর্শী এই নারী বুঝেছিলেন, ভবিষ্যতে আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষা না শিখলে এগনো যাবে না। তাই শৈশবে পিতৃহীন সন্তান নবকৃষ্ণকে তিনি জোর করে শিখিয়েছিলেন এই তিনটি ভাষা। যার সাহায্যে পরবর্তী কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি এবং লর্ড ক্লাইভের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠেছিলেন যুবক নবকৃষ্ণ।
ব্রিটিশ-সখ্যে সুপ্রসন্ন হয় নবকৃষ্ণের ভাগ্য। সে কালের বর্ধিষ্ণু ব্যবসায়ী শোভারাম বসাকের কাছ থেকে কিনে নেন কুড়ি বিঘা জমি। সেই জমিতেই গড়ে ওঠে রাজবাড়ি ও ঠাকুরদালান। সেই দালানে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে পূজিত হয়ে আসছেন দশভুজা, ঘরের মেয়ে হয়ে। প্রতিমা এখানে একচালার। এখনও সাজানো হয় ডাকের সাজেই। তাই দুর্গা ও তাঁর সন্তানদের পরনের পোশাক পশ্চিমী ঘরানার। কারণ, অতীতে ডাকের সাজ আসত সুদূর ইউরোপ থেকে।
দীর্ঘদিন অপুত্রক নবকৃষ্ণ দত্তক নেন তাঁর দাদার ছেলে গোপীমোহন দেবকে। এরও বেশ কয়েক বছর পরে জন্ম হয় তাঁর নিজের ছেলে রাজকৃষ্ণের। পরে তাঁর জন্য আলাদা বাড়ি বানিয়ে সম্পত্তি ভাগ করে দেন রাজা নবকৃষ্ণ। গোপীমোহন দেবের ছেলে রাধাকান্ত দেব। তাঁদের শাখার পুজোকে বলা হয় রাজবাড়ির বড় তরফের পুজো। রাজকৃষ্ণের উত্তরধারার পুজো আজ পরিচিত ছোট তরফের পুজো নামে।
অতীতে রাজবাড়ির পুজোয় বড় অংশ জুড়ে ছিল আমোদ-প্রমোদ। ঠাকুরদালানের সরাসরি নাচঘর। সেখানে প্রতি পুজোয় বসত বাঈ-নাচের আসর। লর্ড ক্লাইভ দুর্গোৎসবে এসে সপার্ষদ দেখেছিলেন সে কালের নামজাদা নর্তকী মিকিবাঈয়ের নাচ। তবে এত সব জাঁকজমক থেকে দূরেই থাকতে হত বাড়ির মেয়ে ও বধূদের। তখন তাঁরা কঠোর ভাবে পর্দানসীন। পুজো দেখতেন দেওয়ালের জাফরির আড়াল থেকে। ফলে শোভাবাজার রাজবাড়িতে কোনও দিন দশমীতে তৈরি হয়নি সিঁদুরখেলার রেওয়াজ। কারণ সিঁদুর খেলতে গেলে তো ঠাকুরদালানে আসতে হবে। সেখানে যাওয়া মানেই পরপুরুষের চোখের সামনে পড়ে যাওয়া। কারণ প্রথম থেকেই শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজোর দ্বার সর্বসাধারণের জন্য খোলা।
কালের স্রোতে ম্লান হয়েছে বহু রীতি। এখন রাজবাড়ির বধূ ও বিবাহিত মেয়েরা প্রতিমাবরণের পরে সিঁদুর খেলেন। তবে নারী বা পুরুষ, বাড়ির কোনও সদস্যই পুজোর জিনিস স্পর্শ করতে পারেন না। অব্রাহ্মণ বলে তাঁদের স্পর্শ নিষিদ্ধ। সে অধিকার আছে শুধুমাত্র পূজারী ব্রাহ্মণের। বংশ পরম্পরায় তাঁরা রাজবাড়ির দুর্গাপুজো করে আসছেন। সেইসঙ্গে সেবা করে আসছেন বাড়ির গৃহদেবতা রাধাগোবিন্দ জিউয়ের। দুর্গাপুজোর ক’দিন তিনি উমাকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য স্থানান্তরিত হন দোতলার ঠাকুরঘরে।
আরও পড়ুন:ঐতিহ্য অমলিন দশঘরা বিশ্বাস পরিবারের পুজোয়
ঠাকুরদালানে রাধাগোবিন্দ জিউয়ের নিত্যসেবার ঘরে স্থাপন করা হয় ‘চণ্ডীমণ্ডপ’। মাটির ঢিপিতে পোঁতা হয় পাঁচকলাইয়ের বীজ এবং বেলগাছ। চণ্ডীমণ্ডপের সামনে থাকে দুর্গাপুজোর ঘট। শুক্লা নবমী থেকে বিজয়া দশমী অবধি সেখানে নিত্যপুজো চণ্ডীপাঠ হয়ে থাকে। এমনকি, দুর্গাপুজোর চার দিন ভোগও নিবেদিত হয় আগে চণ্ডীমণ্ডপে, পরে দশভুজার সামনে। অতীতে দেওয়া হত ২১ রকমের মিষ্টান্ন ও ১২ রকমের নোনতা। এখন নিবেদিত হয় ১২ রকমের মিষ্টান্ন ও ৭ রকমের নোনতা। অব্রাহ্মণ বলে অন্নভোগ দেওয়া নিষিদ্ধ এই পরিবারে।
নিষেধের কোপে বন্ধ নীলকণ্ঠ পাখির উড়ানও। পরিবর্তে এখন গ্যাসবেলুনে বসানো শোলার নীলকণ্ঠ পাখিতেই পালিত হয় রীতি। বিজয়া দশমীতে নীলকণ্ঠবার্তার রেশ ধরে কনকাঞ্জলি দিয়ে সপরিবার রওনা দেন মা দুর্গা। ঠাকুরদালানে জ্বলতে থাকে ম্লান প্রদীপ। বিষণ্ণ সন্ধ্যায় নেমে আসে কড়িবরগায় গুটিয়ে রাখা পারস্যের গালিচা। তার উপরে জড়ো হন পরিবারের সদস্যরা। এক দিকে পুরুষরা, অন্য দিকে বাড়ির মেয়েরা। শান্তির জল ছিটিয়ে দেন পুরোহিত। এরপর আবার কড়িবরগায় মুখ গোঁজে দড়িবাঁধা গালিচা। এক বছরের জন্য।
ছবি সৌজন্যে : শোভাবাজার রাজবাড়ি (বড় তরফ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy