দুর্গা প্রতিমা
জায়গাটা একদম অন্য রকম ছিল তখন। বিরাট সদর দরজার সামনে মাইলের পর মাইল সবুজ মাঠ আর ধানজমি। পাশেই দুটো বড় পুকুর। বাড়ির লাগোয়া জোড়া শিবমন্দির। মাঠের মাঝখান দিয়ে চলে গিয়েছে সরু হাঁটা রাস্তা। পাকা বাড়ি আশপাশে নেই বললেই চলে। কিছু মাটির বাড়ি রয়েছে। উদোম গায়ে খেলা করে বেড়ানো ছেলের দল হইহই করে ছুটত বড় রাস্তায়। সাহেব-সুবোদের গাড়ি খটাখট করে চলে যেত রাস্তা দিয়ে। পিছনে হাততালি দিতে দিতে ছড়া কাটত শিশুরা। খানিকটা দূরে একটি কালীমন্দির। সবাই বলেন, মা বড় জাগ্রত। আশপাশের গ্রাম থেকে প্রতি দিন পুজো দিতে ভিড় করে মেয়ে-বউরা। আষাঢ়ের এক সকাল ভিজে যাচ্ছে প্রবল বৃষ্টিতে, ধানের খেতে ঢেউ খেলে যাচ্ছে হাওয়া।
এমন এক দিনে চন্দ্রদের গাড়ি এসে থামল বাড়িটার সামনে। জায়গাটা বেশ মনে ধরল শ্রীনাথচন্দ্রের। এই বাড়িটা কিনে এখানেই পারিবারিক পুজো ফের শুরু করবেন বলে মনঃস্থ করলেন তিনি। এর আগে ব্রজদুলাল স্ট্রিটে চন্দ্রদের বাড়ির পুজো হত। তারও আগে পুজো হত সপ্তগ্রামের আদি বাড়িতে। কলকাতায় আসার পর রামপ্রসাদ চন্দ্র, সনাতন চন্দ্র এবং উদয়চাঁদ চন্দ্র সেই পুজো করতেন। কিন্তু বাড়ি ভেঙে সেখানে রাস্তা হওয়ার পর চন্দ্র পরিবারের একটি শাখা চলে গেল বেচু চ্যাটার্জি স্ট্রিটে। একটি চলে এল ঠনঠনিয়ার কাছে বিধানসরণিতে। এই বাড়িটাই চোরবাগানের মিত্রদের কাছ থেকে কিনলেন উদয়চাঁদ চন্দ্রের দত্তক পুত্র অ্যাটর্নি জেনারেল শ্রীনাথচন্দ্র। পৈতৃক ব্যবসা ছিল সোনার। কাজেই অর্থের কোনও দিনই কোনও অভাব ছিল না। শ্রীনাথচন্দ্রের আমলে আরও শ্রীবৃদ্ধি হল পরিবারের। সিপাহী বিদ্রোহের বছর সাতেক আগে ১৮৫০ সালে মহাসমারোহে বাড়িতে দুর্গাপুজো শুরু করলেন তিনি। শুভ কাজের সূচনায় দেবীর হাতে সেই বছরের একটি মোহর দেন তিনি। ১৮৫০ সালের সেই মোহরটি এখনও প্রতি বছর পুজোয় দেবীর হাতে দেওয়া হয়।
জায়গাটা পাল্টে গিয়েছে একদম। সরু গলি, ঘিঞ্জি রাস্তা। লোহালক্কড়ের কারবার গলি জুড়ে। বাড়ির সদর দরজাই ঢেকে দিয়েছে দোকান আর গাড়ির ভিড়। এই সব পেরিয়ে বাড়ির চৌহদ্দির মধ্যে পা দিলেই কোথা থেকে হঠাৎ সামনে চলে আসে হারিয়ে যাওয়া কলকাতা। জন্মাষ্টমীর দিন সিদ্ধি-সিদুঁর কেনা হয়। উল্টো রথের দিন হয় কাঠামো পুজো। তার পর শুরু হয় ঠাকুর তৈরি। এখানে পুজো হয় হরপার্বতী রূপে। ঠাকুরের ডাকের সাজ হয়। মহাদেবের কোলে আসীন থাকেন দেবী। দুই পাশে থাকেন লক্ষ্মী-গণেশ-সরস্বতী-গণেশ। সিংহাসনে থাকেন জয়া-বিজয়া। চালচিত্রে থাকে দশমহাবিদ্যা আর দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী ছবি। গণেশের খড়ম, শিবের খড়ম, দেবীর মুকুট-শঙ্খ-চক্র-গদা সবই এই বাড়িতে সোনা বা রুপোর। মহালয়ার পরের দিন অর্থাৎ প্রতিপদে দেবীর ঘট বসানো হয়। সেই দিন থেকে চণ্ডীপাঠ শুরু হয়। বোধন হয় ষষ্ঠীর দিন।
আরও পড়ুন :এ বছর প্রতিমার সাজে পুরনো ঘরানা ফিরিয়ে আনছে শোভাবাজার রাজবাড়ি
সেই দিন থেকে পুজো শুরু হয় ঠাকুরদালানে। চন্দ্রদের কূলদেবতা শ্রী সীতানাথ জিউ। এর সঙ্গেই থাকেন ধান্যলক্ষ্মী। সপ্তমীর সীতানাথ জিউ এবং ধান্যলক্ষ্মীকে নীচে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। পুজো হয়ে গেলে পরে কূলদেবতাকে উপরে তুলে দেওয়া হয়। আবার পরের দিন পুজো শুরুর আগে নীচে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়। শ্রী সীতানাথ জিউ এবং ধান্যলক্ষ্মী চন্দ্র পরিবারের কূলদেবতা বলে তিন বছর এই বাড়িতে থাকেন। পরের বছর ঝামাপুকুরে যান। যে বছর কূলদেবতা ঝামাপুকুরে থাকেন সেই বছর এই বাড়িতে তাঁদের খড়ম পুজো করা হয়। সপ্তমীর দিন কলাবউ স্নানের পর বাড়িতে নিয়ে এসে তাঁকে সপ্ততীর্থের জল দিয়ে স্নান করানো হয়। এর পর দেবীর চক্ষুদান করা হয়। চন্দ্রবাড়িতে সপ্তমীর দিন হোম শুরু হয়। গরান কাঠের সেই হোমকুণ্ডের আগুন প্রজ্জ্বলিত থাকে পুজোর শেষ দিন পর্যন্ত। নবমীর দিন আরতির পর হোমকুণ্ডের আগুন নেভানো হয়। পুজো চলাকালীন সেই আগুন কখনও নেভানো হয় না। দেবীর পায়ের কাছে বিরাট একটি সিঁদুরের বাক্স রাখা হয় চন্দ্র পরিবারের তরফ থেকে। ১৮৫০ সাল থেকে এই বাড়িতে যত মেয়ের বিয়ে হয়েছে এবং যত জন পুত্রবধূ হয়ে এসেছেন, তাঁদের সবার একটি করে সিঁদুরের কৌটো এই বাক্সটিতে রাখা হয়। অষ্টমীর দিন সন্ধি পুজোর পর ধুনো পোড়ান বাড়ির বউয়েরা। বৈষ্ণব মতে পুজো হয় বলে এই বাড়িতে বলি হয় না। ১০৮ টি প্রদীপ সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়া হয় ঠাকুর দালানে। বলির বদলে মাসকড়াই সিঁদুরে মাখিয়ে দেবীকে অর্পণ করা হয়।
পুজোর দিন মেয়েদের নাকে নথ এবং পায়ে মল পড়া বাধ্যতামূলক। পুজোর সময়ে বাড়িতে ভিয়েন বসে। লুচি, আলুভাজা নারকেল নাড়ু, নানা রকম মিষ্টি, রসবড়া, চন্দ্রপুলি, চালের নৈবেদ্য, সব রকম ফল দেবীকে ভোগে দেওয়া হয়। প্রতি দিন ১৭ টি থালায় চাল, কলা আর মিষ্টি দিয়ে ঠাকুরকে নৈবেদ্য দেওয়া হয়। সন্ধ্যেবেলা আরতির পর ঠাকুরকে ভোগে দেওয়া হয় দুধ ও মিষ্টি। চন্দ্রবাড়িতে পুজো শেষে প্রথমে পুরোহিতকে দক্ষিণা দেওয়া হয় ১৭৪৯ সালের একটি রুপোর কয়েন দিয়ে। ঠাকুরকে সাক্ষী রেখে এই প্রতীকী দক্ষিণা দেওয়ার পর মুদ্রাটি ফেরত নিয়ে বর্তমান মূল্যে পুরোহিতকে দক্ষিণা দেওয়া হয়। দশমীর বরণের পর চাল, মিষ্টি ও রুপো দিয়ে কনকাঞ্জলি হয়। এর পর ঠাকুর যত ক্ষণ বাড়িতে থাকছেন, আর তাঁর মুখ দেখতে পারেন না বাড়ির মহিলারা। মহালয়ার দিন থেকে এই বাড়িতে মাছ খাওয়া নিষেধ। দশমীতে দেবী বিসর্জনের পর সেই দিন মাছ কিনে খেতে হয়।
আরও পড়ুন :দত্তবাড়ির পুজোর সুরে মিশে থাকে দেশাত্মবোধের আবেগ
এক সময় পুজোর দিনগুলিতে যাত্রা হত। চিৎপুরে গিয়ে পালার বায়না করে আসতেন বাড়ির কর্তারা। বসত কীর্তনের আসরও। শোনা যায়, নীলদর্পণ নাটকের দ্বিতীয় শো হয়েছিল এই বাড়িতেই। তবে আজকাল আর সে সব কিছু হয় না। কিছু আড়ম্বর কমলেও এখনও পুজোয় নিষ্ঠা কম নেই এই বাড়িতে। তাই বাদ নেই আবেগও। পুজোর ক’টা দিন হর্ষের পর দেবী বিদায়ের পর বিষাদে নিঝুম হয়ে থাকে চন্দ্রবাড়ি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy