মূর্তিপূজার চল যখন ছিল না, তখন তো নবপত্রিকাই ছিল মা দুর্গা।
নিজস্ব প্রতিবেদন
কলকাতাশেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০২০ ০৯:৪৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৬
দুর্গাপুজোয় কলা বউ স্নান অন্যতম একটি শাস্ত্রীয় বিধি। কলা বউ অর্থাৎ নবপত্রিকা। নবপত্রিকার জন্ম হয়েছিল কীভাবে জানেন?
০২১৬
শরৎকালে আমন ধান কাটার সময়বাংলার মানুষ শস্যসমৃদ্ধি চেয়ে এক লৌকিক দেবীর পুজো করত। এর পর আশ্বিন মাসে দুর্গাপুজোর প্রচলন শুরু হয়। সেই সময় সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে দুর্গার পাশেই স্থান পেল নবপত্রিকা।
০৩১৬
মহা সপ্তমীর ভোরে দুর্গার মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে নবপত্রিকার নটি গাছকে শ্বেত অপরাজিতার লতা ও ন গাছা হলুদ সুতোয় বেঁধে স্নান করাতে নিয়ে যেতে হয়।
০৪১৬
নটি মাঙ্গলিক উপাচার রয়েছে এতে। মূর্তিপূজার চল যখন ছিল না, তখন তো নবপত্রিকাই ছিল মা দুর্গা। অনেক জায়গায় এখনও মৃন্ময়ী মূর্তির বদলে নবপত্রিকা পুজো করা হয়ে থাকে।
০৫১৬
নবপত্রিকায় রয়েছে নটি উপাদান, দেবী পুরাণ বলছে এমনই। এগুলি হল কলা গাছ, কচু গাছ, হলুদ গাছ, জয়ন্তী, বেল, ডালিম ও অশোকের ডাল, মান কচু এবং ধান গাছ।
০৬১৬
কলা গাছে কোন দেবী থাকে জানেন? দেবীপুরাণ বলছে, তাঁর নাম ব্রহ্মাণী। কচুতে দেবী কালিকার অধিষ্ঠান।
০৭১৬
পুরাণ বলছে, হলুদে রয়েছেন দেবী দুর্গা। জয়ন্তীতে রয়েছেন দেবী কার্তিকী। বেলে রয়েছেন দেবী শিবা, ডালিমে রক্তদন্তিকা, অশোকে শোকরহিতা, মান কচুর চামুণ্ডা, ধান গাছের লক্ষ্মীর অধিষ্ঠান।
০৮১৬
শারদোৎসবে পুজোর বিধিতে এই নয় অধিষ্ঠাত্রী দেবীই আসলে নবপত্রিকার নয়টি রূপ।নবপত্রিকা স্নানেও রয়েছে নানা রকম বিধি। রাজার অভিষেকে যেমন সমুদ্র ও নদীর জল প্রয়োজন। নবপত্রিকা স্নানেও প্রয়োজন সমুদ্রের জল, তীর্থের জল। কোন কোন নদীর জল পুরাণ অনুযায়ী নবপত্রিকার স্নানে লাগে?
০৯১৬
গঙ্গা , যমুনা, সরস্বতী, আত্রেয়ী, ভারতী, সরযূ, গণ্ডকী, শ্বেত গঙ্গা, কৌশিকা, ভোগবতী ও মন্দাকিনীর জলেই স্নান করাতে হবে নবপত্রিকা, বিধান রয়েছে এমনই। প্রতিটি গাছের অধিষ্ঠাত্রী দেবীকেও পৃথক মন্ত্রপাঠ এবং নানাবিধ বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে আটটি ঘটের জলে স্নান করানোর রীতি রয়েছে।
১০১৬
প্রথম ঘটে থাকে গঙ্গাজল। দেবী পুরাণ বলছে, এ সময় বাজাতে হয় মালব রাগ। পরবর্তীতে বৃষ্টির জল ও ললিত রাগের বাজনা। সরস্বতী নদীর জলে বিভাস রাগের সুরে বাজবে দুন্দুভী। সমুদ্রের জলে ভৈরবী রাগের তান, ভীম বাদ্য বাজানোর রীতি।
১১১৬
পঞ্চম ঘটের ক্ষেত্রে গৌড়মল্লার রাগে মহেন্দ্রাভিষেক বাদ্যের রীতি রয়েছে। ষষ্ঠ ঘটে ঝর্নার জলে শঙ্খ বাদ্য বাজবে, আবহে থাকবে বড়ারি রাগ।
১২১৬
অষ্টম ঘটে তীর্থের জল-ধানসী রাগে ভৈরবী বাদ্য বাজানোর রীতির কথা উল্লেখ রয়েছে পুরাণে। দুর্গার রূপবিশেষ স্নানের রীতিও পৃথক। উগ্রচণ্ডার ক্ষেত্রে চন্দন জল হলে ভগবতীর শিশির জল, এ রকম।
১৩১৬
নবপত্রিকা স্নানের কথা উল্লেখ রয়েছে ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’-য়। নদীতে বা জলাশয়ে স্নান ও মন্ত্রোচ্চারণের পর নবপত্রিকার জাঁকজমকপূর্ণ শোভাযাত্রার কথাও উল্লেখ রয়েছে সেখানে।
১৪১৬
বর্তমানে যদিও এত রকমের জল পাওয়া সম্ভব হয় না বলে মন্ত্রোচ্চারণ ও গঙ্গার জলেই শুদ্ধ করে নেওয়ার প্রক্রিয়া চলে। শাঁখের জলেও স্নান করানো হয়। পরানো হয় লালপেড়ে গরদের শাড়ি, পাতায় দেওয়া হয় সিঁদুরের টিপও।
১৫১৬
অনেকে বলেন কলা বউ নাকি গণেশের স্ত্রী। পূর্ববঙ্গের অনেক জেলাতেই লক্ষ্মী পুজোর দিনেও কলা বউ স্নান করানোর রীতি রয়েছে। চণ্ডী পুরাণেও উল্লেখ করা হয়েছে দু্র্গা ও লক্ষ্মী আসলে অভিন্ন।
১৬১৬
বিজয়া দশমীর দিন নবপত্রিকাকেও প্রতিমার সঙ্গে বিসর্জন দিয়ে মন্ত্রোচ্চারণ করেন পুরোহিত। পৌরাণিক শস্যের দেবীর সঙ্গে মিলিয়ে যান দুর্গাও। শস্যই যে সমৃদ্ধি, অন্নই যে ব্রহ্ম, এই অর্থই বোঝাতে চেয়েছিল পুরাণ। সবার জন্যই অন্ন মাপা থাক এ পৃথিবীতে, পুজোর আসল মন্ত্রোচ্চারণ বোধ হয় এই খানেই। তথ্য-চণ্ডী পুরাণ, মার্কণ্ডেয় পুরাণ।