সঙ্গীত মানুষকে সুন্দর করে। জীবনকে সুরেলা করে দেয়। তখন সূর্যাস্তের মধ্যে, বাতাসের মধ্যে, দুঃখ যন্ত্রণার মধ্যেও সুর খুঁজে পাওয়া যায়। আমি তেমন ভাবে গান গাইতে না জানলেও বাবার সূত্রে দৈনন্দিন জীবন ও কাজের মধ্যে সেই সুর খোঁজার উত্তরাধিকারী। কারণ আমার বাবা ছিলেন গিটারবাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।
যদিও আমার ছোটবেলাটা মূলত কেটেছে মহামায়াতলায়, আমার দাদু দিদার বাড়িতেই। তখন গড়িয়ায় থাকতেন বাবা, মা আর দাদা। বাবার ব্যস্ততার কারণেই আমাকে দাদু-দিদার কাছে থাকতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
মাঝে মধ্যে মামারা সাইকেলে করে আমাকে এনে বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করিয়ে নিয়ে চলে যেতেন। বাবা ছিলেন রাশভারী, মেজাজি মানুষ। সবার সঙ্গেই একটা দূরত্ব বজায় রাখতেন। আবার উল্টো দিক থেকে দেখলে, বাবা নিজের জায়গায় ছিলেন আত্মমগ্ন, সুরমগ্ন এবং একা। তাই তাঁকে বাবা হিসেবে যতটা না দেখেছি, তার চেয়ে বেশি দেখেছি শিল্পী হিসেবে।
রাশভারী হলেও একই সঙ্গে খুব রসিক মানুষও ছিলেন। সেই রসিকতা এবং কৌতুকবোধ আমার বিভিন্ন সিনেমায় এসেছে। কিছুটা বড় হয়ে যাওয়ার পরে বাবাকে খানিকটা কাছ থেকে পেয়েছি। তখন আমি বাবার কাছে গেলে, বাবা আমার সেই সময়কার এক মাত্র বিলাসিতা, ট্যাক্সি করে ঘুরে বেড়ানোর খরচটা দিতেন। কাজেই আমার সে অর্থে ছাত্রজীবনে কোনও হাতখরচের অভাব ছিল না।
এখানে একটা বলি, বাবার নিজের কাকা সন্তোষকুমার গঙ্গোপাধ্যায় না থাকলে শিল্পী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তৈরি হতেন কিনা জানি না। এখানে আরেকজনের কথাও বলা দরকার। তিনি সঙ্গীতশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।
তখন বাবা থাকতেন পার্ক সার্কাসের কড়েয়া রোডের যৌথ পরিবারে। উল্টো দিকে গভর্নমেন্ট কলোনিতে থাকতেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। বাবার বাজনা কী ভাবে যেন পৌঁছে যায় সতীনাথবাবুর কানে। সেখান থেকেই যোগাযোগ হতে হতে বাবাকে অল ইন্ডিয়া রেডিয়ো এবং এইচ এম ভি-তে নিয়ে যাওয়া সবটাই করেছিলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। মাত্র একুশ বছর বয়সে বাবার প্রথম এল পি রেকর্ড বেরোয়।
মিউজিক্যাল ব্যান্ড নিয়ে স্টেজে উঠে বাবা হাজার হাজার মানুষকে সম্মোহিত করে রাখতে পারতেন। বাবার কাছে আমিও চিরকালের জন্য কৃতজ্ঞ, কারণ মানুষকে শিল্প দিয়ে আকৃষ্ট করে রাখার শিক্ষাটা আমি বাবার থেকেই পেয়েছি। শুধু মাধ্যমটা আলাদা। বাবার ক্ষেত্রে যেটা ছিল সুর, আমার ক্ষেত্রে সেটা সিনেমা।
আমার স্কুল নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে যখন ফিরতাম ছুটির পর, সবাই জিজ্ঞেস করত বাবার অনুষ্ঠান কোথায় আছে, কবে রেকর্ডিং ইত্যাদি নানা প্রশ্ন। ফলে সম্পর্কটা হয়ে দাঁড়াল একজন বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে যেমন তাঁর সন্তান যেমন থাকে। ঠিক সেই রকম। গর্ব হত আমার। বুঝতে পারতাম শিল্পীর সামাজিক গুরুত্ব কতটা।
একবার চিত্র পরিচালক গৌতম ঘোষ আমাকে বলেছিলেন, বাবাকে ওঁরা ‘ফ্যাশন আইকন’ মানতেন। বাবার জামাকাপড় পরা, চুলের স্টাইল, সবই নাকি অনুসরণযোগ্য ছিল।
বাবার গায়কি অসাধারণ ছিল। খুব ভাল গান গাইতেন। গান না গাইতে জানলে গিটারের তারে তারে আঙুলগুলি নিখুঁতভাবে সুর গেয়ে যেতে পারত না। বাবা সব থেকে বেশি ভালবাসতেন লতা মঙ্গেশকর আর মেহেদি হাসানের গান। লতা মঙ্গেশকর বাবার বাজনা শুনে নাকি একবার বলেছিলেন, ‘‘এত নিখুঁত করে আমি গানটা গেয়েছি কিনা আমি নিজেই জানি না।’’ পুজোয় এইচ এম ভি-র আর কোনও রেকর্ড বেরোক, আর না বেরোক লতা মঙ্গেশকর আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রেকর্ড বেরোতই।
আমার মা ছিলেন গৃহিণী। কিন্তু মাকে কোনও গান গাওয়া তো দূরের কথা, কোনও ঘুমপাড়ানি ছড়া বলতেও শুনিনি কোনও দিন। বাবা ও মা ছিলেন দু’টি ভিন্ন দ্বীপের, ভিন্ন মেরুর মানুষ। বাবার প্রবল মেধাকে শ্রদ্ধা করতেন মা। আর বাবা মা’কে শ্রদ্ধা করতেন তাঁর সহনশীলতা ও পরিবারকে এক করে ধরে রাখার জন্য।
আমার নিজের খুব স্প্যানিশ গিটার বাজাবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হাওয়াইয়ান গিটারের বাড়িতে স্প্যানিশ গিটার শিখব বলায় একটা অনীহা ছিল! সেটা কেন হয়েছিল, আজও জানি না! হয়তো গিটারের উত্তরাধিকারের আশায়! তাই গিটার বাবার হয়েই থেকে গেল।
বাবা ছাড়া আর কারও হাওয়াইয়ান গিটার আমার তেমন ভাল লাগেনি। হয়তো পক্ষপাত আমার। তবে যত বয়স বাড়ছে, তত বুঝতে পারছি বাবা কী নিখুঁত শিল্পী ছিলেন! যদিও বাবা একজন ক্ল্যাসিক্যাল যন্ত্রশিল্পী ছিলেন, তবু তাঁকে হিন্দি গান বা বাংলা আধুনিক গান বাজাতে হত। বড় বয়সে বাবার সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, এটাই ছিল তাঁর প্রফেশনাল জীবনে একটা বড় দুঃখের কারণ।
আমি যখন সিরিয়ালের কাজ আরম্ভ করতে চলেছি, তখনই বাবা চলে গেলেন! আজ যদি উনি থাকতেন, তা হলে কত খুশিই না হতেন! বাবাকে যদি বলা হত ‘কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের বাবা’, তা হলে খুব গর্ব করতেন বলে আমি নিশ্চিত। বাবা অসম্ভব সাফল্য পছন্দ করতেন। ব্যর্থতা আর আলস্য একদম পছন্দ করতেন না।
বাবা চলে গেলেন মাত্র একষট্টি বছর বয়সে। একদম অকাল প্রয়াণ। পিতৃতর্পণের কথা উঠলই যখন তখন এটা বলা যেতেই পারে যে আমার সঙ্গে বাবার সম্পর্কটা এক কোথায়-
‘দেবতা জেনে দূরে রই দাঁড়ায়ে/আপন জেনে আদর করি নে।/পিতা বলে প্রণাম করি পায়ে,/ বন্ধু বলে দু-হাত ধরি নে।’
সত্যিই তাই, জড়িয়ে ধরে বাবাকে আজীবন ভালবাসার সুযোগ পাই নি। একটা আড়াল ছিলই। তাই আজকে আমি যখন বাবা, আমি আমার ছেলে উজানের সঙ্গে চেষ্টা করি একদম বন্ধুর মতো মিশতে। পৃথিবীর সব কথা যেন সে আমার সঙ্গে আদানপ্রদান করতে পারে। বাবা খুব তাড়াতাড়ি চলে গেলেও আমার এইটুকু সৌভাগ্য হয়েছে, চূর্ণীর (গঙ্গোপাধ্যায়) সঙ্গে আমার বিয়ে, উজানের অন্নপ্রাশন সবই দেখে গিয়েছেন বাবা।
চূর্ণীকে অসম্ভব ভালবাসতেন বাবা। আসলে ওর ব্যক্তিত্বকে পছন্দ করতেন। বাবা ছিলেন অভিজাত্য ও সৌন্দর্যের পূজারি। কোনও সস্তা কথা, পরনিন্দা পরচর্চা, কূটকচালি এই সব সামাজিক ব্যাধি থেকে খুব দূরে থাকতেন। আমি যখন নবম শ্রেণিতে পড়ি, বাবার ক্যানসার হয়েছিল। লড়াই করে সেটা থেকে একদম সেরেও উঠেছিলেন। তারপর বহু বছর বেঁচে ছিলেন গানবাজনা নিয়ে। সম্ভবত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ফলেই জীবনের শেষ দিনগুলিতে আধ্যাত্মিক হয়ে গিয়েছিলেন। রোজ সকালে নিজে পুজো করতেন, মূলত রাম ঠাকুরের।
তথাকথিতভাবে গঙ্গার ঘাটে কোনও দিন পিতৃতর্পণ করার কথা ভাবিনি। বাবার ছবি ঘরের দেওয়ালে কোথাও টাঙানো নেই। অ্যালবাম খুলে প্রায়শই বাবাকে দেখছি এমনটাও নয়। কিন্তু রোজ ভাবি, রোজ দেখতে পাই। যদি তর্পণ করতেই হয় তা হলে বাবার সঙ্গে পিতৃতুল্য আরও অনেক মানুষের জন্যই তা করা উচিত। যাঁরা ছাড়া আমি তৈরিই হতাম না। আমার তো আসলে দাদু দিদার জন্যেও তর্পণ করা উচিত।
বড় পাওয়া এটাই যে, মোবাইলে আই টিউনস-এ বাবার প্রায় সমস্ত অ্যালবাম আছে, সেই একই মোবাইল ফোনেই নানা অ্যাপে আমার অনেক সিনেমাও দেখা যায়। এটাও তো বাবা ছেলের বন্ধন। এটাও তো তর্পণ।
প্রত্যেকটা কাজের মাধ্যমে আমি প্রতি দিন পিতা এবং পিতৃতুল্যদের তর্পণ করে চলেছি। এর জন্য এক দিন শুধু অনুষ্ঠান করাতে বিশ্বাসী নই আমি।
অনুলিখন: সংযুক্তা বসু
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy