Advertisement

Associate Partner

Style Partner

Associate Partner

Weddings Partner

Food Partner

Inspirational Story

এ বারেরও পুজোতেও টোটো চালাবেন, বাড়ি বাড়ি জল দিয়ে বেড়াবেন, বাঙালি বিশ্বকাপার!

তিনি প্রসেনজিৎ বৈদ্য। ২০১১ সালে প্যারিসে গৃহহীনদের বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় সোনাজয়ী ভারতীয় দলের অধিনায়ক ছিলেন। এখন সংসার চালাতে টোটো চালান, বাড়ি বাড়ি জল দেন।

প্রসেনজিৎ বৈদ্য

প্রসেনজিৎ বৈদ্য

আনন্দ উৎসব ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ অক্টোবর ২০২৩ ১৭:৩৯
Share: Save:

তাঁর জীবনে হয়তো ঠিকঠাক সব চললে ক'দিন পরে কোনও না কোনও দুর্গাপুজোর মণ্ডপের ফিতে কাটতেন তিনি। কোথাও হতেন প্রধান অতিথি। তিনি যে বিশ্বকাপার ফুটবলার! অথচ দুর্গাপুজোতেও তাঁকে রাতবিরেত পর্যন্ত টোটো চালাতে হয়। হবেও। আর ভোরবেলায় লোকের বাড়ি বাড়ি দিতে হবে জল!

মেসির থেকে বয়েসে তিন বছরের ছোট তিনি। রোনাল্ডোর চেয়ে পাঁচ বছরের। লিও মেসি বা ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো এখনও বলে লাথি মেরে কোটি কোটি ডলার কামাচ্ছেন। তিনি, প্রসেনজিৎ বৈদ্য বুট, জার্সি, ফুটবল— সব কার্যত দশ বছরেরও বেশি তুলে রেখেছেন!

ভুল লিখলাম! তুলে রাখতে বাধ্য হয়েছেন! শুধু তাই-ই নয়। সংসার চালাতে, বছর দেড়েকের এক মাত্র সন্তানের বেবিফুড কেনার টাকা জোগাড় করতে রাত দেড়টা অবধি দমদমের রাস্তায় রাস্তায় টোটো চালাচ্ছেন। তার পর বাড়ি ফিরে রোজ ওই অসময়ে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে ফের ভোরেই উঠে আশপাশের পনেরো-বিশটা বাড়িতে জল দিচ্ছেন। কুড়ি লিটারের ভারী ভারী জলের ক্যান ঘাড়ে করে বয়ে!

না না, ভাববেন না, এ কোথাকার কোনও এক প্রসেনজিৎ বৈদ্য! মেসির ঘরে যা আছে, রোনাল্ডোর আলমারিতেও যা নেই, সেই বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়নের মেডেল আছে নিখাদ বাঙালি ফুটবলার প্রসেনজিৎ বৈদ্যর দমদমের এক তলার সাত বাই আট ফুটের ঘুপচি ঘরে!

আজ্ঞে হ্যাঁ, বিশ্বকাপে খেলেছেন এই বঙ্গ ফুটবলার। হোমলেস অর্থাৎ গৃহহীনদের বিশ্বকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টে। ২০১১ সালে। প্যারিসে। ভারতীয় দলের অধিনায়ক হিসেবে। তার পরেও তিন প্রধানে খেলার ডাক পাওয়া তো দূরের কথা, ময়দানের কোনও দলেই খেলার সে অর্থে সুযোগই জোটেনি। ইস্টার্ন রেলের খুচখাচ দু-একটা প্রদর্শনী ম্যাচে খেলেছেন, বা ভবানীপুর ক্লাবের ট্রায়ালে নেমেছেন। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ- আইএএফের কোনও ডিভিশনেই নিয়মিত খেলার সুযোগ হয়নি। সম্প্রতি দ্বারস্থ অবধি হয়েছিলেন ময়দানের এক বড়সড় কর্তাব্যক্তির সঙ্গে।

প্রসেনজিৎ বললেন, ‘‘মিথ্যে বলব না, উনি একটা সাত হাজার টাকার চাকরি জোগাড় করে দেবেন বলেছিলেন কলকাতায়। কিন্তু রোজ দমদম থেকে আসা-যাওয়া আর টিফিন মিলিয়ে তো মাসে দেড়-দু'হাজার টাকা বেরিয়ে যাবে। আবার সাত হাজার টাকার চাকরিটা করলে আমার টোটো চালানো, লোকের বাড়িতে জল দেওয়া হবে না। স্যারকে তাই বিনীতভাবে জানিয়ে ছিলাম, ওই টাকা আমার টোটো চালিয়ে, লোকের বাড়ি জল বয়ে দিয়েও রোজগার হয় মোটামুটি। তা হলে আর এই চাকরিতে আমার কী লাভ? " ক্ষোভ, হতাশা, যন্ত্রণা, দুশ্চিন্তা মিলেমিশে একটা অদ্ভুতুড়ে গলায় ফোনে এক টানা আনন্দবাজার অনলাইন-কে বলে থামেন তিনি।

কিন্তু বলতে পারছেন না, তাঁর ভবিষ্যৎ কী? কী’ই বা তাঁর সংসারের ভবিতব্য! প্রেম করে বিয়ে করেছেন। ছেলের জন্মদিন আর মেসির জন্মদিন একই তারিখে- ২৪ জুন। আদর করে, তার চেয়েও বেশি নিজের অপূর্ণ স্বপ্ন ছেলের মধ্য দিয়ে পূরণের নতুন স্বপ্নকে বুকে আঁকড়ে সন্তানের নাম রেখেছেন লিও। লিও বৈদ্য!

প্রসেনজিৎ 'পার্টি পলিটিক্স' পছন্দ করেন না, আর সে কারণে কোনও নেতা-মন্ত্রীকে নিজের জন্য বলবেন না বলেই কারও দ্বারস্থ হননি। বললেন, ‘‘কিন্তু দিদি আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, সবার অভিভাবক। ওঁর কাছে সব কিছু বলা যায়, আমি ওঁকে আমার অবস্থা জানাতে চাই,’’ ব্যাখ্যা দিলেন প্রসেনজিৎ।

ফুটবলই তাঁর প্রথম প্রেম, আশৈশব পরম ভালবাসার ধন, তাই প্রসেনজিৎ জানেন পেলে-মারাদোনার বস্তিতে হতদরিদ্র অবস্থা থেকে ফুটবলসম্রাট ও ফুটবল রাজপুত্র হয়ে ওঠার রূপকথা! এও জানেন, প্রবীণ আমরে টেস্ট অভিষেকেই বিদেশের মাঠে সেঞ্চুরি করার আগে জাতীয় ক্রিকেটার হয়ে উঠেছিলেন মুম্বইয়ের ঝুপড়িতে বাস করেছেন। হতদরিদ্র অবস্থার মাঝে বড় হয়েছিলেন টেস্টে 'ব্যাক টু ব্যাক' ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকানো একমাত্র ভারতীয় ব্যাটসম্যান বিনোদ কাম্বলি! ‘‘ফুটবল খেলতে গিয়ে আমার ক্লাস টেনের বেশি পড়াশোনা না হলেও আমি এ গুলো জানি। খবরের কাগজ, খেলার ম্যাগাজিন হাতের কাছে পেলেই পড়া আমার বরাবরের অভ্যেস," বলছেন তিনি।

সঙ্গে প্রসেনজিতের এও অভিযোগ যে, মারাদোনা-কাম্বলির মতো তিনি কোনও বিলার্ডো বা আচরেকরকে দীক্ষাগুরু পাননি। বললেন, "আমার পিঠে যতটুকু যা হাত রাখার রেখেছিলেন ছোটবেলায় পাড়ার কোচ বাপ্পাদা। সেটা ২০০৪ সাল। তখন আমার বয়েস চোদ্দ বছর। রাস্তায় আমার খালি পায়ে স্ট্রাইকার খেলা দেখে বাপ্পাদাই আমাকে প্রথম এক জোড়া কেডস কিনে দেন। এয়ারপোর্ট কোচিং সেন্টারে ওঁর কাছে প্র্যাকটিস করার সুযোগ দিয়েছিলেন। বাপ্পাদার চেষ্টায় আমি সল্টলেক স্টেডিয়াম টিমে সুব্রত দত্তের কোচিংয়ে খেলি। সাইয়ের সুকান্তনগর স্কুলের হয়ে দিল্লিতে সুব্রত কাপ অল ইন্ডিয়া স্কুল ফুটবলে খেলি। সেখানে আমার খেলা দেখে নেপালি কোচ অশোক ছেত্রী আমাকে নাগপুরে টুর্নামেন্ট খেলাতে নিয়ে যেতে চান। তত দিনে আমি নার্সারি লিগে ভাস্কর (গঙ্গোপাধ্যায়) স্যারের ইস্টবেঙ্গল নার্সারি টিমে সুযোগ পেয়ে গিয়েছি। ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে নাগপুরে খেলতে যাব না বলে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিলাম। শেষমেশ ভাস্কর স্যার বলায় গিয়েছিলাম। ওখানে আমাদের কলকাতা টিম চ্যাম্পিয়ন হয়। নেপাল, বাংলাদেশ, জম্মু-কাশ্মীর, ভুটান, সিকিম থেকেও অনেক দল খেলতে এসেছিল নাগপুরে। ওখানে টুর্নামেন্টের পরের দিন অশোক ছেত্রী আমার আর আমার ভাইয়ের কাছে একজনকে এনে পরিচয় করালেন। সেই ভদ্রলোক বললেন, তোমরা ইউরোপে গিয়ে বিশ্বকাপ খেলতে চাও? আমরা দু'ভাই তো শুনে অবাক! কী বলছেন উনি? বিশ্বকাপ খেলব? তখন তিনি জানালেন, এটা ফুটবলের আরেকটা বিশ্বকাপ। হোমলেস ওয়ার্ল্ড কাপ ফুটবল।’’

প্রসেনজিৎ আর তার ভাই, দু'জনই ২০১১ সালের গৃহহীনদের বিশ্বকাপে বাংলা থেকে একমাত্র সুযোগ পান। প্রসেনজিৎ অধিনায়কও ছিলেন। পিঠে 'ইন্ডিয়া' লেখা জার্সি পরে ভারতীয় দলের হয়ে খেলেছিলেন প্যারিসের মাঠে। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইংল্যান্ড, পর্তুগাল, ফ্রান্স, মেক্সিকো সহ ৩৫টা দেশের টিম অংশ নিয়েছিল সারা দুনিয়া থেকে। প্রসেনজিতের ভারতীয় দল চ্যাম্পিয়ন্স কাপে প্রথম পাঁচটা ম্যাচ হেরে বসলেও পরের চারটে ম্যাচ টানা জিতে কমিউনিটি কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়।

বললেন, ‘‘প্রথমে বিদেশের অজানা পরিবেশ, অত বড় টুর্নামেন্টের চাপে পর পর হেরে যাই। তার পর ছ'নম্বর ম্যাচে নামার আগে নিজেদের মধ্যে বলি যে, এখন থেকে আমরা টুর্নামেন্টটা উপভোগ করব। কোনও চাপ নেব না। তাতেই কাজ দিয়েছিল। কমিউনিটি কাপের ফাইনালে বেলজিয়ামকে হারিয়েছিলাম।’’

জীবনের সেরা প্রাপ্তিতেও অবশ্য প্রসেনজিতের সুখস্মৃতি নেই। বললেন, ‘‘প্যারিস থেকে এ দেশে, সবেতে আমি প্রতারিত হয়েছি। একটা সমাজসেবী সংস্থা ওই বিশ্বকাপে ভারতের খেলার বন্দোবস্ত করেছিল। কিন্তু তার জন্য আমাদের টাকা দিতে হয়েছে। যেমন, আমার থেকে দেড় লাখ টাকা চায়। আমার নিজের দাদা সে সময় ওর মোটরবাইক বিক্রি করে দেয়। ৭০-৭৫ হাজার টাকা দিতে পেরেছিলাম ওই সংস্থাকে। কিন্তু ওরা আমার মেডেলটা ছাড়া ইন্ডিয়া খেলার জার্সি-বুট সব নিয়ে নিয়েছিল। আজও পাইনি। আমার সার্টিফিকেট পর্যন্ত দেয়নি।’’ সেই আন্তর্জাতিক শংসাপত্র তিন বছর পর এখানে হাতে পায় প্রসেনজিৎ।

সঙ্গে শুরু হয় বিশ্বকাপার হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে ময়দানের বঞ্চনা। কোনও ক্লাব না পেয়ে ক্রমশ ‘খেপ’ খেলায় মনোযোগী হয়ে পড়ে প্রসেনজিৎ। বলছিলেন, ‘‘খেপ খেলা একজন ফুটবলারের স্কিলের সর্বনাশ জেনেও রোজগারের জন্য আমাকে বাধ্য হয়ে ওই পথে যেতে হয়েছে। আজও একটা চাকরি পাইনি। এখনও মধ্যমগ্রাম, বারাসত, কৃষ্ণনগরে খেপ খেলে বেড়াই। মাসে ছ-সাতটা। রোজ রাতদুপুর পর্যন্ত টোটো চালিয়ে আর ভোর থেকে লোকের বাড়ি বাড়ি জল দিয়ে শরীরে আর দেয় না বেশি খেপ খেলার ধকল। বয়েসও হয়ে গেল। তেত্রিশ চলছে। জানি না ভগবান আমার আর বৌ-বাচ্চার কপালে কী লিখে রেখেছেন? আমার এখন একটা চাকরির খুব দরকার।"

শেষের কথাটায় মনে হল, বিশ্বকাপে মেডেলজয়ী ভারত অধিনায়ক বলছেন না! বলছেন জীবনের জন্য ম্যাচ খেলতে নামা এক হতভাগ্য ফুটবলার! একজন অসহায় স্বামী! একজন আশঙ্কিত পিতা! যিনি হয়তো জগজ্জননী মায়ের কাছেই এ বার একটা চাকরি চাইবেন!

এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।

অন্য বিষয়গুলি:

Celeb Puja Indian Footballer Olympic Medalist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE