পুজোর সানাই বাজছে দূরে। এই তো পরশু দিন পর্যন্ত আকাশের মুখ ভার ছিল, ঝমঝমে বৃষ্টি, প্যাচপ্যাচে কাদা। যখন এস বি (সৌরীন ভট্টাচার্য) মার্ক্স পড়াচ্ছেন পিছন থেকে ফিসফিসে গলা ভেসে এল—
-বাইরে আকাশটা দ্যাখ। ঘাড় ঘুরিয়ে ভগ্নদূতকে দেখবার প্রয়োজন নেই।
পড়াশোনা লাটে তুলে দিয়ে আকাশ দেখবার সদ্দারটি তো ঋতু ছাড়া আর কেউ হতে পারে না। শত হলেও মার্ক্স এবং এস বি! অন্য কোথাও মন দেওয়া এক রকম পাপই বলা যায়। তাই বহু কষ্টে মন দিয়েছি । ঠিক তখুনি একদল মেঘকে হুটোপাটি করে নীল আকাশটাতে ছুটে বেড়াতে হবে ! বেয়াক্কেলে মরশুম সব।
- চল তো, বেরিয়ে পড়ি । এলোমেলো হাঁটা, আবোলতাবোল কথা শেষ হত যে যার বাড়ির পথ ধরার পর।
- জানিস তো এই যে পুজো আসছে এটাই ভাল। এলেই তো শেষ।
তখন ঋতুর অমন দার্শনিক কথা মোটে মনঃপূত হত না।
- শেষ ভাববার এখুনি দরকার কি তোর?
- না ভাবলেও শেষ হবে।
মনে মনে ভাবি, তা বটে।
চিন্তাভাবনায় সে বয়সে ও কিছুটা এগিয়েই ছিল। তা বলে ফূর্তির অভাব ছিল না। ইউনিভার্সিটির দিনগুলি আমাদের সপ্তমীর রাত্তিরে ম্যাডক্স স্কোয়ারে কাটত। চারদিকে স্টল, তার মধ্যে নতুন শাড়ি, চুড়ি, লিপ্সটিকের ভারে লটপটে হয়ে আমরা হাজির হতাম। ছেলেদের মধ্যে যাদের সাজবার ইচ্ছে, তারা নতুন শার্ট বা টিশার্টের সঙ্গে বড় জোর পারফিউম শোভিত হয়ে উপস্থিত হত। যাকে রকের ভাষায় বলে ‘মাঞ্জা’ দেওয়া সেটা ঋতুরই থাকত। ছেলেদের লম্বা ঝুলের পাঞ্জাবি পরার প্রবর্তক আমার যেন মনে হয় ও-ই। হাতে বেশ কয়েকটা আংটি পরে ঝলমল করতে করতে হাজির হত। সে স্বপ্নদিন হুশ করে শেষ হয়ে গেল। যে যার কক্ষপথ বেছে নিল। কেমন করে যেন ওর সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ রয়েই গেল। পুজোর যে কোনও এক দিন সকালটা আমরা ঠিক করে নিয়ে এক সঙ্গে কাটাতাম। কখনও উত্তর কলকাতার পুজো, তো কখনও মাঠঘাট ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে। ওই এলোমেলো তালটা ঠিক আর কারুর সঙ্গে আমি পেতাম না; বোধহয় ও-ও পেত না।
চিংকুর (শিল্প নির্দেশক ইন্দ্রনীল ঘোষ) সঙ্গে আমার বিয়ের পর যত দিন ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে থেকেছি, তত দিন আমাদের ঘরের গোল বারান্দায় বসে নানা সময়ে আমরা তিনজন নির্ভেজাল আড্ডা মেরেছি। শর্ত একটা থাকত, সাধারণত। সেটা হল, আমি যেন পাঁঠার মাংসটা রান্না করি।
উৎসব যেমন মানুষকে একত্র করে তেমন একাও করে দেয়। বেশ কিছু সময় পেরিয়ে গেলে বন্ধুবান্ধবরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। কাজের জায়গা আলাদা হয়ে যাবার সূত্রে মানুষের ভাল লাগার জায়গা, ইচ্ছেপূরণের জায়গাগুলোও আলাদা হয়ে যায়। ধরাবাঁধা জীবনের বাইরে যারা, তাদের কর্মজীবনই তাদের আশ্রয় হয়ে দাঁড়ায়। ঋতুরও তাই হয়েছিল। কাজের সূত্রে যারা ওর কাছকাছি আসত কোনও না কোনও পুজোরবেলা ভাগ করে নিয়ে তাদের সঙ্গে কাটাত। এটা শুনতে যত সোজা করতে তত নয়। পারমুটেশন কম্বিনেশন করে ঘোরপ্যাঁচের সমাধান। কতকটা ওই গেছোদাদার অঙ্কের মতো । প্রথমে দেখতে হবে কে কে আছে, তার পর কবে কবে আছে, তার পর কখন কখন আছে, তারপর কোথায় কোথায় আছে। মাস্টার টাইমটেবিল তৈরি করে পূজো কাটানো। সকলেরই তো পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব রয়েছে।
যত দিনে ও ফিতে কাটা বা পুজো পরিক্রমার বিচারকের পর্যায়ে পৌঁছেছে, তত দিনে ওর লোক দেখলে গায়ে জ্বর আসত। তাই সে সবেও খুব বেশি সময় দেবার কোনও ইচ্ছে ছিল না, দিতও না। আসলে সামাজিকভাবে কেউ যদি অ-প্রথাসিদ্ধ হয়, তো মানসিক দিক থেকে তার সামাজিক গ্রহপথ সাধারণত ছোট হয়ে আসে। কোথাও নিজেকে আর পাঁচজনের মতো করে খুঁজে পাওয়া বড় কঠিন হয়ে ওঠে। সাধারণত ‘অষ্টুমী’র (বরাবর অষ্টুমীই বলি) দিন সকালে ও আমাদের গলফ ক্লাবের বাড়িতে আসত। পাঁঠার মাংস সে দিন নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের পর্যায়ে থাকত। বামুন না হলেও ছাঁদাবাঁধার পবিত্র অধিকার ওর ছিল বলে ও বিশ্বাস করত। তাই মেনুতে যাই থাকুক না কেন ছাঁদ-মতো বেঁধে দিতে হত। ওকে অবশ্য খাইয়ে খুব সুখ ছিল। খেয়ে খুব খুশি হত আর খুব খুশি হয়েই খেত।
সত্যি বলতে কী, আমি যখন সবে রান্না শিখছি তখন সমঝদার হিসেবে ও আর আমার ভাই ছিল আমার একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক। দু’হাজার বারোর ‘অষ্টুমী’ – তত দিনে নিজে ডিজাইন করা জামাকাপড় পরা চালু করে দিয়েছে। একটা গোল গলা না টিশার্ট , না টপ পরে হুড়মুড় করে এসেই ব্যাগটা আমাদের বিছানার ওপর ছুঁড়ে ফেলে হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগল। অস্পষ্ট ছাড়া ছাড়া ছাড়া কথা, ‘সুনীলদা আর নেই দীপান্বিতা! ভাবতে পারছি না রে, আমাদের ছোটবেলা, আমাদের কলেজের দিনগুলো।’
- তুই সারা অষ্টুমী কাঁদবি বুঝি?
কড়া না হয়ে উপায় ছিল না।
আমরা আঠেরো বছর বয়েস পড়েছি, আঠেরো বছরে একই সঙ্গে, একুশ বছর বয়সে পড়েছি, একুশ বছর বয়সে একই সঙ্গে। পিকনিক করতে গিয়ে ভুবনডাঙার মাঠ খুঁজেছি ; এক্সকারশনে গিয়ে পরস্পরকে পাহাড় দেব বলে পাহাড় খুঁজেছি। আসলে এক কান্নায় কত কান্না মিশে থাকে তা কেউ জানে না। হয়তো বাংলা সিনেমাকে ও অনেক কিছু দিয়েছি, ইতিহাসে নামও লিখিয়েছে, কিন্তু বহু দূর বহু দূর বড় একলা পথ হেঁটেছে।
‘কী যে খেলি , কী যে খেলি ভাবতে ভাবতেই খেলার সময় ফুরিয়েছে। দুঃখ চেয়েছিল হয়তো, তা বলে এতটা দুঃখিত হতে চায় নি ; কার কাছে যাবে কাকে যে বলবে, কেউ নেই, কোনও নাম মনে নেই।
পুণ: প্যারাফ্রেজিং পাঠকরা আশা করি মাপ করবেন
এই প্রতিবেদনটি ‘আনন্দ উৎসব’ ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy