অভিনেত্রী অপরাজিতা আঢ্য
আমার শৈশব কৈশোর কেটেছে হাওড়ায়। সেখানে এক দিদি ছিল। দিদির ছিল এক প্রেমিক। ওরা বেশ সবার চোখের সামনে দিয়ে বীর দর্পে ঠাকুর দেখতে যেত। কারণ ওদের বিয়েটা ঠিক হয়েই গিয়েছিল।
ওদের সঙ্গে ১৫-১৬ জন ভাই বোন ঠাকুর দেখতে যেত। তারা সকলেই আমার বন্ধু ছিল। আমিও থাকতাম ওই দলে। খাওয়া দাওয়া, ফুচকা-রোল-নাগরদোলা, সবই জুটে যেত নিখরচায়। দিদির প্রেমিকের দৌলতে।
বিয়ের পর এলাম কলকাতায়। শ্বশুরবাড়ির পাড়ার পুজোটা বড়দের অনুপ্রেরণায় আমরাই চালু করি। বেশ ভাল লাগত। ২০১৯ থেকে পুজোটা কেমন যেন হয়ে গেল! একটা কালো রঙের মূর্তি এনে মায়ের পুজো হল। সেই মূর্তির মধ্যে আমার দুগ্গাকে খুঁজে পেলাম না। সিদুঁর খেলার দিন এমন একটা পরিস্থিতি হল যে ভাল করে সিদুঁর পরানো যাচ্ছিল না, বরণ করা যাচ্ছিল না। প্রতিমা প্যান্ডেল থেকে বের করতে খুব অসুবিধে হল দশমীর দিন। চিরকালই বিসর্জনের সময় আমরা মেয়েরা নাচতে নাচতে যেতাম। সে বার আর যাইনি। বিরক্তি লাগছিল। তার পরের বছর পুজোয় তো আমাদের বাড়ির সকলের করোনা হল। তার পরের বছর আমার শ্বশুরমশাই চলে গেলেন। মা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। পর পর কয়েক বছর পুজো বেশ মন খারাপে কেটেছে। আশা করি এ বছরটা ভাল কাটবে। যদিও পাড়ার পুজোয় আমি আর তেমন ভাবে জড়িয়ে নেই।
অষ্টমীর দিন অঞ্জলি দিতে যাব পাড়ার পঞ্চাননতলার মন্দিরে। লাল পাড় একটা শাড়ি পরব ও দিন। আমি যখন অঞ্জলি দিতে যাই, আমার বর আমার পিছন পিছন যায়। হাফ প্যান্ট আর গেঞ্জি পরে। খুব রাগ হয়। পুজোর সকাল গুলিতে কিছুতেই ওকে একটু ভাল পোশাক পরাতে পারি না। ঠিক করেছি পুজোয় ওকে এবার কিচ্ছু দেব না। আমি এতদিন পুজোতে সবাইকে উপহার দিয়েছি। স্টুডিয়ো পাড়ার সহকর্মীদেরও পুজোয় কিছু না কিছু দিয়েছি। কিন্তু এ বছর সবাইকে খামে করে টাকা দিয়ে দেব।
পুজো পরিক্রমা করতে করতে প্রচুর ঠাকুর দেখা হয়ে যায় আজকাল। কিন্তু ছোটবেলার ঠাকুর দেখার মজা আলাদা ছিল। আমার বাবা খুব লম্বা চওড়া মানুষ ছিলেন। একদম ছোটবেলায় মনে পড়ে বাবার ঘাড়ে চেপে গলার দু’পাশ দিয়ে দুটো পা ঝুলিয়ে বাবার চুলের মুঠি ধরে আমাদের হাওড়ার অন্নপূর্ণা ক্লাবের ঠাকুর দেখতে যেতাম। আমাদের পাড়ার আর এক ক্লাবে অকাল বোধনের দুর্গা পুজো হত। সেখানে রামচন্দ্র, হনুমানজির মূর্তি গড়া হত। একজন অতি বৃদ্ধ শিল্পী সেই মূর্তি গড়তেন। স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রতি দিন দেখতাম, মূর্তি কত দূর গড়া হল। বৃদ্ধ শিল্পী মানুষটি যখন কাঁপা কাঁপা হাতে মহালয়ার দিন এক টানে মায়ের চোখ আঁকতেন, মুগ্ধ হয়ে দেখতাম!
একটা কথা, আমার কিন্তু চণ্ডীপাঠের দীক্ষা নেওয়া আছে। বাড়িতে মহালয়া থেকে চণ্ডীপাঠ করি। সন্ধিপুজোর হোম নিজেই করি। আজকাল এই বাড়ির চণ্ডীপাঠেই বেশি মন দিই। তার কারণ যে সব অল্প বয়সি ছেলে মেয়েরা পাড়ার পুজোয় হইহই করত তারা আজ নেই। কেউ বিয়ে হয়ে অন্যত্র থাকে। কেউ চাকরি নিয়ে প্রবাসে। পাড়াটা এখন এক কথায় বৃদ্ধাবাস।
পুজোয় একটা ব্যাপার খুব ফিরে পেতে ইচ্ছে করে। যে সব ছেলেদের সঙ্গে পুজোয় খুনসুটি হত, যারা আমাদের ইয়ার্কি ঠাট্টা করে পিছু নিত, তাদের খুব দেখতে ইচ্ছে করে। জানি না দেখলে কেমন অনুভূতি হবে, তা’ও দেখতে চাই।
পুজোর সময় অল্প বয়সে প্রেম? নিশ্চয়ই হয়েছে। সেই প্রেম এখনও পুজো এলে মনে পড়ে। কেমন যেন শূণ্য শূণ্য লাগে! সে প্রেম তো আর ফিরবে না।
পুজো মানে অবশ্য আমার কাছে একটা আনন্দ। জ্বলজ্বলে মুখের হাসি। সবার মুখে এই হাসিটুকু দেখার জন্যই পুজোয় কলকাতার বাইরে যাই না। আমি চাই পুজোয় যে যেখানে থাকুক, যেন আনন্দে থাকে। হাসিতে ভ’রে থাকে।
অনুলিখন: সংযুক্তা বসু।
এই প্রতিবেদনটি 'আনন্দ উৎসব' ফিচারের একটি অংশ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy