সঈদ এবং শেরিফ কুয়াশি
অ্যাম্বুল্যান্সের সাইরেন, ঘোড়ার খুরের আওয়াজ আর মাঝেমধ্যেই ভারী বুটের টহল। সেই সঙ্গে টিভিতে ঘনঘন ‘নিউজ ফ্ল্যাশ’ ফের বন্দুকবাজের হানা রাজধানীর কাছেই। আশঙ্কা, ভয় ও উদ্বেগে কেটে গেল গোটা একটা দিন।
যদিও দিনেদুপুরে ছবি ও কবিতার শহর প্যারিসের জমজমাট এলাকায় শার্লি এবদো পত্রিকার অফিসে যারা গুলি চালিয়ে শেষ করে দিয়েছিল ১২টি প্রাণ, সেই দুই সন্দেহভাজন আততায়ী এখনও অধরাই। এখনও পর্যন্ত শুধু এটুকুই জানা গিয়েছে, উত্তর ফ্রান্সের একটি পেট্রল স্টেশনে অভিযুক্তদের দেখা মিলেছে।
গতকালের তৃতীয় বন্দুকধারী অবশ্য নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে পুলিশের কাছে। ১৮ বছর বয়সী স্কুল পড়ুয়া তরুণী মুরাদ হামিদ জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তার নাম ঘোরাফেরা করতে দেখে পরিবারই আত্মসমর্পণ করতে বলেছিল। তাই নিজে থেকেই ধরা দিয়েছে সে। এখন সেই মুরাদকে জেরা করেই তদন্ত চলছে। প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং মুরাদের বয়ান শুনে পুলিশের সন্দেহ, ওই দুই পলাতক জঙ্গি সম্পর্কে ভাই। নাম শেরিফ এবং সঈদ কুয়াশি। তাদের হন্যে হয়ে খুঁজছে প্যারিস পুলিশ। তবে শেরিফ ও সঈদের সঙ্গে মুরাদের ঠিক কী সম্পর্ক, তা জানা যায়নি এখনও।
সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত থাকার ইতিহাস রয়েছে দুই ভাইয়েরই। জানা গিয়েছে, দু’জনই ফরাসি-আলজেরিয়। একটি জঙ্গি দলের সদস্য হওয়ার অভিযোগে তারা প্রথম গ্রেফতার হয় ২০০৫ সালে। পরে ২০০৮ সালে তিন বছরের জেল হয়েছিল শেরিফের। সে বার অভিযোগ ছিল, ইরাকে জিহাদি পাঠানোর ষড়যন্ত্রে জড়িত রয়েছে ৩২ বছরের শেরিফ ও তার বছর দুয়েকের বড় দাদা সঈদ। কিন্তু ১৮ মাস জেল খাটার পরই ছাড়া পেয়ে যায় শেরিফ। আর সঈদ মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল জিজ্ঞাসাবাদের পরেই।
দেশজোড়া কড়া নিরাপত্তার ঘেরাটোপে এমন দুই কুখ্যাত জঙ্গি কালাশনিকভ হাতে কী ভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রশ্ন উঠছে তা নিয়েই। পুলিশের বক্তব্য, ওই তিন জনের পিছনে জড়িয়ে রয়েছে আরও বেশ কিছু নাম। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী বের্নার্দ ক্যাজনভ জানিয়েছেন, অভিযানে নেমে ইতিমধ্যেই ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের প্রত্যেকে কোনও না কোনও ভাবে জড়িত রয়েছে শার্লি এবদো-কাণ্ডে। তবে কারওরই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি তদন্তকারী অফিসারেরা। শুধু এটুকু জানিয়েছেন, ধৃতদের মধ্যে পুরুষ ও মহিলা উভয়েই রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মানুয়েল ভল একটি ফরাসি রেডিও চ্যানেলকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, পলাতক দু’জনই গোয়েন্দাদের চেনা মুখ। খুব শীঘ্র তাদেরও ধরা হবে।
তবে এই আশ্বাসে ভয় কাটছে না। স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক দানা বেঁধে রয়েইছে। কারণ গত ২৪ ঘণ্টায় প্যারিস-লাগোয়া চার-চারটি জায়গায় ঘটে গিয়েছে নাশকতা। শার্লির দফতরের সামনে যখন থিকথিক করছে পুলিশ, বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী যখন স্ট্রেচারে করে একে একে বার করে আনছেন জখমদের, মুখোশধারীরা যে তখন বন্দুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল শহরতলিতে।
শার্লির পর দ্বিতীয় নাশকতার খবর আসে গত কাল সন্ধে নাগাদ দক্ষিণ ফ্রান্সের পোর্ত-লা-ন্যুভেল থেকে। গুলি চালানো হয় একটি মুসলিম প্রার্থনাগৃহে। পরে মধ্যরাতে গ্রেনেড হানায় কেঁপে ওঠে প্যারিসের পশ্চিমে ল্য মান শহরে। মসজিদ লক্ষ্য করে তিনটি ফাঁকা গ্রেনেড ছোড়া হয়। এর পর আজ সকালে লিয়ঁ-র একটি মসজিদের কাছে কাবাবের দোকানের সামনে বিস্ফোরণ ঘটে। তবে কোনও হতাহতের খবর নেই। পরের খবর আসে ফের দক্ষিণ ফ্রান্সের মঁরুজ থেকে। বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিহিত বন্দুকবাজ প্রথমেই আক্রমণ করে দুই মিউনিসিপ্যাল অফিসারকে। তাঁরা তখন একটি পথ দুর্ঘটনার তদন্ত করছিলেন। বন্দুকধারীর বেপরোয়া গুলিতে প্রাণ হারান এক মহিলা অফিসার। জখম হন এক সাফাই কর্মীও।
প্রতিটি ঘটনা যে শার্লি এবদো কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত জঙ্গিরাই ঘটিয়েছে, সে নিয়ে অবশ্য নিশ্চিত নয় প্যারিস পুলিশ। তবে যোগাযোগ কোথাও না কোথাও রয়েইছে সে নিয়ে একমত সকলেই।