আরব সাগরের তীরে একটি বন্দর ও একটি প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক করিডর। পাকিস্তানের এ হেন জোড়া প্রকল্প চিন্তা বাড়াতে চলেছে সাউথ ব্লকের। কারণ মূলত একটাই। এই দুই ক্ষেত্রেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিচ্ছে চিন।
ক্ষমতায় এসেই পাকিস্তানের বৃহত্তম গভীর সমুদ্র বন্দর গদর-এর পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব চিনের হাতে তুলে দিয়েছিল নওয়াজ শরিফ সরকার। এ বার সেই বন্দর থেকে চিনের সিনচিয়াং প্রদেশের কাশগড় পর্যন্ত ২০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্থনৈতিক করিডর নির্মাণে ইসলামাবাদের সঙ্গে চুক্তি করেছে বেজিং। পাক সরকার-সূত্রে খবর, চিন আগামী ১০ বছরে এই প্রকল্পে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ করবে। গদর বন্দর থেকে ইসলামাবাদ ছুঁয়ে গোটা পাক ভূখণ্ড পেরিয়ে কাশগড় পর্যন্ত তৈরি হবে গাড়ির রাস্তা এবং রেলপথ। পাতা হবে তেল ও গ্যাসের পাইপলাইন এবং আধুনিক যোগাযোগের জন্য ফাইবার অপটিকস লাইন। মোটরওয়ের দু’পাশে তৈরি হবে অন্তত এক ডজন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এই সড়ক ও রেলপথ যাবে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়েও।
ভারতের বিদেশ মন্ত্রক প্রকাশ্যে এ বিষয়ে মন্তব্যে নারাজ। তবে কূটনীতিকদের একাংশ মেনে নিচ্ছেন, করিডরটি সম্পূর্ণ হলে সমগ্র পাকিস্তানে এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরে চিনের প্রভাব বাড়বে। তা ছাড়া, গদর বন্দর পরিচালনার দায়িত্বে চিনা সংস্থা থাকায় সেখানে জাহাজ ঢোকা-বেরোনোয় তারা হস্তক্ষেপ করবে। তার চেয়েও চিন্তার কথা, চাইলে গদর থেকে মুম্বইয়ের নৌঘাঁটির উপরে নজরদারিও করতে পারবে চিন। এ ছাড়া, গদর বন্দরকে ব্যবহার করে অনেক কম খরচে পশ্চিম এশিয়া থেকে চিন সরকার জ্বালানি তেল আমদানি করতে পারবে।
পাক বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র তসনিম আসলামের কথায়, “প্রকল্পটি পাকিস্তানের চেহারা বদলে দেবে। ২০০০ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ সড়কপথের দু’ধারে নানা ধরনের আর্থিক কাজকর্ম চলবে। এতে চিন যেমন দীর্ঘ সমুদ্রপথ এড়িয়ে পশ্চিম এশিয়া থেকে কাশগড়ে তেল নিয়ে যেতে পারবে, তেমনই পাকিস্তানের মাটিতে তেল, রসায়ন, পেট্রো-রসায়ন শিল্পে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে।” যে কোনও মূল্যেই এই প্রকল্প বাস্তবায়িত করতে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ বদ্ধপরিকর বলেও জানান তসনিম।
প্রকল্পটি ঠিক কী? গদর বন্দর নিয়েই বা এমন হইচই কেন?
বালুচিস্তান প্রদেশের গদরে গত কয়েক বছর ধরেই এই সমুদ্র বন্দরটি তৈরি করছিল পাকিস্তান। কাজের বরাত দেওয়া হয়েছিল ‘সিঙ্গাপুর পোর্ট অথরিটি’ নামে একটি সংস্থাকে। অর্থনৈতিক করিডর নিয়ে চিন-পাকিস্তান আলোচনা শুরু হয়েছিল ১০-১২ বছর আগেই। মাঝে বিষয়টি ধামাচাপা পড়ে যায়। বস্তুত, সিঙ্গাপুরের সংস্থা গদরের বরাত পাওয়ায় কিছুটা ক্ষুণ্ণ হয়েই চিন প্রকল্পটি স্থগিত করে দিয়েছিল। ইতিমধ্যে নওয়াজ শরিফের সরকার ক্ষমতায় এসে চিনের সরকারি সংস্থা ‘চায়না ওভারসিজ পোর্ট’কে সদ্যনির্মিত গদর বন্দর পরিচালনার ভার দেয়। প্রসঙ্গত, কোনও স্বাধীন দেশ অন্য একটি দেশকে নিজেদের বন্দর পরিচালনার ভার দিচ্ছে, এমন নজিরও সম্ভবত এই প্রথম।
গদরের ভার হাতে পেয়েই চিন ওই বন্দরের পাশে একটি তেল শোধনাগার নির্মাণের কথা ঘোষণা করে। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের পরিকল্পনা ও উন্নয়ন মন্ত্রী এহসান ইকবাল বেজিং সফরে গিয়ে ফের অর্থনৈতিক করিডরের বিষয়টি চূড়ান্ত করে আসেন। তার পর থেকেই পাকিস্তান জুড়ে এই প্রকল্প নিয়ে জোরদার আলোচনা শুরু হয়েছে। এর মাধ্যমে ভারতকে কতটা চাপে রাখা যাবে, পাক সংবাদমাধ্যমের চর্চায় সেই প্রসঙ্গও উঠেছে। গোটা বিষয়টি নজরে রাখছে আমেরিকাও।
চিন কেন প্রকল্পটি নিয়ে তৎপর?
ইসলামাবাদ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ মহম্মদ মুনির জানান, চিন এখন তার প্রয়োজনীয় জ্বালানির প্রায় ৮০% আরব সাগর ও ভারত মহাসাগর দিয়ে আমদানি করে। পারস্য উপসাগরের তীরে কুয়েতের মতো তেল উৎপাদনকারী দেশ থেকে জ্বালানি ভর্তি চিনা জাহাজ ভারতের জলসীমা পেরিয়ে হংকং, সাংহাই, তিয়াংজিং বন্দরে যায়। এই দীর্ঘ পথ এড়িয়ে সরাসরি গদর বন্দর হয়ে সড়ক পথে জ্বালানি আমদানি করা গেলে ঝুঁকি (বিশেষত ভারতীয় নৌবাহিনীকে নিয়ে মাথাব্যথা রয়েছে চিনের) আর খরচ, দু’টোই কমবে। সেই কারণে গদরের পাশেই শোধনাগার তৈরি করছে চিন, যাতে অর্থনৈতিক করিডরের চাহিদামতো পরিশোধিত তেলও সহজে পাওয়া যায়। আর মুনিরের মতো পাক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, চিনকে এই প্রকল্পে সহায়তা করলে আখেরে পাকিস্তানেরই লাভ। এতে দেশের আর্থিক তথা শিল্প পরিস্থিতিই বদলে যেতে পারে বলে আশা করছেন তাঁরা।
এই প্রকল্পে ভারতের চিন্তা করার মতো কি সত্যিই কিছু রয়েছে?
দেশের প্রাক্তন সেনাপ্রধান শঙ্কর রায়চৌধুরী মনে করিয়ে দিলেন, পাকিস্তানের বন্দর বলতে এত দিন ছিল শুধু করাচি। অতীতে ভারত সেই বন্দরে আঘাত হেনেছিল। তাই পাকিস্তান একটি বিকল্প বন্দরের খোঁজে ছিল। শঙ্করবাবুর আশঙ্কা, বাণিজ্যিক ব্যবহারের পাশাপাশি গদর পাকিস্তানের বিকল্প নৌ-ঘাঁটি হিসেবেই গড়ে উঠবে। চিনের হাতে সেটি চলে যাওয়া ভারতের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। একই সঙ্গে তাঁর মত, পারস্য উপসাগরের যে অংশ দিয়ে ভারত তেল আমদানি করে, গদর বন্দর থেকে তার উপর নজরদারি করা সম্ভব। চিন-পাকিস্তান যৌথ ভাবে সেই কাজ করতে পারে।
আর ২০০০ কিলোমিটার দীর্ঘ অর্থনৈতিক করিডর? প্রাক্তন সেনাপ্রধানের কথায়, “যে কোনও পরিকাঠামো-প্রকল্পের দুটি উপযোগিতা থাকে। একটি বাণিজ্যিক, অন্যটি সামরিক। চিন যদি গদর থেকে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের উপর দিয়ে মোটরওয়ে নির্মাণ করে, পাইপলাইনে তেল-গ্যাস চালান শুরু করে, তা হলে অনেক সুবিধাজনক জায়গায় পৌঁছে যাবে। যা সত্যিই চিন্তার।”
তবে শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটির সার্থক বাস্তবায়ন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয়ও রয়েছে শঙ্করবাবুর। কারণ, ওই দীর্ঘ সড়কপথের যাওয়ার কথা গিলগিট-বালটিস্তানের উপর দিয়ে। পাকিস্তানের এই অংশে তালিবান বেশ সক্রিয়। নওয়াজ সরকারের এক প্রতিনিধি অবশ্য দাবি করলেন, বেজিং এবং ইসলামাবাদ গোটা পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তালিবানের বিরুদ্ধে সেনা নামিয়ে কঠোর বার্তা দিচ্ছেন শরিফ। তা ছাড়া চিনা প্রধানমন্ত্রী লি খ্যছিয়াং প্রকল্পটি নিয়ে বাড়তি উৎসাহ নেওয়ায় দেশে এ নিয়ে আশার সঞ্চার হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি।