ডুবে যাওয়া জাহাজের দিকে এগোচ্ছে উদ্ধারকারী নৌকা। ছবি: রয়টার্স।
“পরে কখনও বলার সুযোগ পাব কি না জানি না, তোমায় খুব ভালবাসি মা।” ছেলে শিন ইয়ং জিনের থেকে এ রকম একটা এসএমএস পেয়েই মনটা কু ডেকেছিল। তা-ও সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পাঠিয়েছিলেন মা। “তোমাকেও খুব ভালবাসি।” তখনও জানতেন না, ছেলে বাঁচার জন্য লড়াই করছে সমুদ্রের মাঝখানে। শিন অবশ্য সেই সৌভাগ্যবানদের মধ্যে এক জন, যে মায়ের কাছে ফিরতে পেরেছে। বুধবার দক্ষিণ কোরিয়ার একটি জাহাজ ডুবে গিয়ে মৃত অন্তত পক্ষে ন’জন। সেই জাহাজেই ছিল শিন-সহ আরও ৪৭৫ জন যাত্রী। তাঁদের মধ্যে ৩২৫ জনই স্কুলপড়ুয়া। ২৮৭ জন এখনও নিখোঁজ। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, ১৭৯ জনকে উদ্ধার করা গিয়েছে এখনও পর্যন্ত।
শিনের মতো পরিবারের কাছে ফিরতে পারেনি ষোলো বছরের কিম উং কি। মাঝ সমুদ্রে বিপদ আসছে বুঝে দাদাকে এসএমএস করেছিল কিম। “জাহাজে আমার ঘরটা ৪৫ ডিগ্রি কাত হয়ে গিয়েছে। মোবাইলটাও ভাল কাজ করছে না।” দাদা অভয় দিয়ে এসএমএস করেছিলেন, “ভয় পেয়ো না, বড়রা যা করতে বলছেন তা-ই করো। সব ঠিক হয়ে যাবে।” সত্যি হয়নি দাদার কথা। জাহাজ কর্মীদের ঘোষণা শুনে ঘরেই ছিল কিম। জাহাজ ডুবে যায় তাকে নিয়েই।
জাহাজটা হয়তো ডুবে যাবে বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে এ রকমই আরও অনেক এসএমএস, ফোন কল এসেছিল ছাত্রছাত্রীদের মা-বাবার ফোনে। সেই যোগাযোগটুকু সন্তানের শেষ স্মৃতি হিসেবে রয়ে গিয়েছে তাঁদের অনেকের কাছেই।
কোরীয় উপদ্বীপ থেকে ১০০ কিলোমিটার দক্ষিণের জেজু দ্বীপে ছাত্রছাত্রীদের ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল দানওন হাইস্কুল। তাদের নিয়ে বুধবার ভোর ভোর বেরিয়ে পড়েছিল দক্ষিণ কোরিয়ার একটি জাহাজ। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছনোর আগেই সলিলসমাধি হল তার। উপকূল ছেড়ে ২০ কিলোমিটার এগোনোর পরেই হঠাৎ ঘটে দুর্ঘটনা। উদ্ধার হওয়া এক ছাত্র চা ইউন ওক জানিয়েছেন, দুর্ঘটনাটি ঘটার সময় ডেকেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। “হঠাৎ খুব জোরে একটা শব্দ, সঙ্গে সঙ্গে জাহাজের মাথাটা নীচের দিকে হয়ে ডুবতে শুরু করল।” বললেন তিনি।
তখন স্থানীয় সময় সকাল ন’টা। উপকূলরক্ষী বাহিনীর কাছে একটি বিপদ সঙ্কেত এসে পৌঁছয় দুর্ঘটনাগ্রস্ত জাহাজটি থেকে। দূর থেকে দেখা যায়, জাহাজের পিছন দিকটা জলে ভাসছে শুধু। বাকি জাহাজ জলের নীচে। সঙ্গে সঙ্গেই তৎপর হয় উদ্ধারকারী দল। নৌসেনা ও উপকূলরক্ষী বাহিনীর যৌথ উদ্যোগে শুরু হয় উদ্ধারকাজ। যোগ দেয় কম্যান্ডোও। প্রশাসনিক সূত্রের খবর, যে এলাকায় দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেখানে সমুদ্রের জলের তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। উদ্ধারকারী দল পৌঁছতে যে সময় লেগেছে, তার মধ্যে ঠান্ডায় হাইপোথারমিয়া হয়ে মৃত্যু হওয়াটাই স্বাভাবিক। ওই এলাকায় সমুদ্রের গভীরতা ৩৭ মিটার। তলায় প্রচুর পরিমাণে কাদা-মাটি থাকায় সমুদ্রগর্ভে উদ্ধার কাজ চালানোও বেশ কষ্টকর।
দুর্ঘটনার কারণ নিয়ে অবশ্য ধোঁয়াশায় প্রশাসন। নৌসেনা সূত্রের খবর, দুর্ঘটনা ঘটার সময় এলাকায় কোনও কুয়াশা ছিল না। জাহাজটির যান্ত্রিক ত্রুটি ছিল বলেও জানা যায়নি। ১৪৬ মিটার লম্বা জাহাজটি ১৯৯৪ সালে জাপানে তৈরি হয়। ৯০০ জন যাত্রী পরিবহণ করার ক্ষমতা ছিল তার।
উদ্ধার হওয়া যাত্রীদের অনেকেই জানাচ্ছেন, ডুবতে শুরু করার আগে খুব জোরে একটি আওয়াজ শোনা গিয়েছেল। তার পর জাহাজে ঘোষণা করা হয়, জাহাজের মধ্যেই যেন থাকে সবাই। উদ্ধার হওয়া এক ছাত্র লিম হাইয়ং মিন বললেন, “সবাই ঘোষণা শোনার পর চুপচাপ বসে ছিল। কিন্তু জাহাজটা খুবই কাঁপছিল। ওটা কাত হতে শুরু করতেই আমি জলে ঝাঁপ দিই। ঠান্ডায় হাড় কেঁপে যাচ্ছিল। উদ্ধারকারী নৌকা এসে যাওয়ায় প্রাণে বেঁচে গিয়েছি।”