Sunita Williams Return

মাসের পর মাস ধরে মহাকাশে থাকলে নভশ্চরদের স্বাস্থ্যে কী কী ধরনের প্রভাব পড়ে? দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিও কি হয়?

মানবদেহ যে হেতু মাধ্যাকর্ষণহীন পরিস্থিতিতে কাজ করার জন্য তৈরি নয়, তাই মহাকাশে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগে নভশ্চরদের। দেখা দেয় নানা শারীরিক সমস্যাও, যা খুব উদ্বেগের না হলেও, নেহাত ফেলনাও নয়।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক

শেষ আপডেট: ১৯ মার্চ ২০২৫ ১৩:২৬
Share:
মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস।

মহাকাশচারী সুনীতা উইলিয়ামস। — ফাইল চিত্র।

আট দিনের সফর দীর্ঘায়িত হয়ে দাঁড়ায় ন’মাসে। অবশেষে দীর্ঘ সময় মহাকাশে কাটিয়ে পৃথিবীতে ফিরেছেন নভশ্চর সুনীতা উইলিয়ামস এবং বুচ উইলমোর। ভারতীয় সময় বুধবার ভোরবেলা ফ্লরিডার সমুদ্রে অবতরণ করে তাঁদের মহাকাশযান। তবে পৃথিবীতে ফিরলেও এখনই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না সুনীতারা। কারণ, দীর্ঘ সময় মাধ্যাকর্ষণ শক্তিবিহীন দিনযাপন।

Advertisement

সাধারণত মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস)-এর অভিযানগুলি অন্তত ছ’মাসের হয়। ফলে নাসার একজন মহাকাশচারীর কাছে আইএসএসে কাজের দায়িত্ব পাওয়ার অর্থ মহাকাশে অন্তত ছ’মাস থাকার প্রস্তুতি নেওয়া। এই দীর্ঘ সময়ে মানবদেহে শারীরবৃত্তীয় নানা পরিবর্তন হয়, তবে তাতে যে পৃথিবীতে ফেরার পর মহাকাশচারীরা দুর্বল হয়ে পড়েন, তা নয়। এমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা।

অনিবার্য কারণে কখনও কখনও নভশ্চরদের মহাকাশে ছ’মাসের কম সময় কাটাতে হতে পারে, কখনও আবার তার বেশিও থাকতে হতে পারে তাঁদের। যেমনটা হয়েছে মার্কিন মহাকাশচারী সুনীতা এবং বুচের ক্ষেত্রে। প্রযুক্তিগত ত্রুটির কারণে মহাকাশ স্টেশনে ন’মাসেরও বেশি সময় কাটাতে হয়েছে তাঁদের। গত বছর সুনীতার বেশ কিছু ছবি প্রকাশ্যে এসেছিল, যেখানে তাঁকে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছিল। গুজব রটেছিল, মহাকাশে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন সুনীতা। কমেছে ওজনও। যদিও সে সব গুজব বার বারই উড়িয়ে দিয়েছে নাসা। তবুও, মানবদেহ যে হেতু মাধ্যাকর্ষণহীন পরিস্থিতিতে কাজ করার জন্য তৈরি নয়, তাই মহাকাশের মাধ্যাকর্ষণশূন্যতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগে নভশ্চরদের। দেখা দেয় নানা শারীরিক সমস্যাও, যা খুব উদ্বেগের না হলেও, নেহাত ফেলনাও নয়।

Advertisement

‘স্পেস সিকনেস’

বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, মহাকাশের ‘মাইক্রোগ্র্যাভিটি’ পরিস্থিতি শরীরের মধ্যস্থ তরল ও রক্তচাপের উপর প্রভাব ফেলে। শরীরের তরল পদার্থ উপরের দিকে বইতে থাকে। যার ফলে মস্তিষ্কে তরল জমা হয়, মুখমণ্ডল ফুলতে থাকে, ক্রমশ রোগা হতে থাকে পা। নানা শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়াতেও হেরফের ঘটে। এর ফলে মহাকাশে যাওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন বেশির ভাগ মহাকাশচারীরই অসুস্থতা, বমি বমি ভাব এবং মাথা ঘোরার মতো উপসর্গ দেখা দেয়। একে বলে ‘স্পেস সিকনেস’। তা ছাড়া, শূন্য মাধ্যাকর্ষণে থাকার কারণে পাল্লা দিয়ে কমতে থাকে হাড়ের ওজন, ভঙ্গুর হয়ে পড়ে হাড়, যা অস্টিয়োপোরোসিসের আর এক নামান্তর। এ সব থেকে নিজেকে চাঙ্গা রাখতে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে প্রতি দিন কয়েক ঘণ্টা করে ব্যায়াম করতে হয় মহাকাশচারীদের। সে সব নিয়ম মেনে চললে মোটামুটি সুস্থ শরীরেই পৃথিবীতে ফিরে আসেন মহাকাশচারীরা।

দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া

মহাকাশের ওজনশূন্যতায় চোখের মণির আকার বদলে যায়, রেটিনায় গঠনগত পরিবর্তন হয়। চোখে রক্ত সঞ্চালনও কমে যায়। কখনও কখনও দৃষ্টিশক্তিও কমে যায় মহাকাশচারীদের।

‘বেবি ফিট’

দীর্ঘ কাল আইএসএসের শূন্য মাধ্যাকর্ষণে ভাসমান অবস্থায় থাকার কারণে পা মাটির সংস্পর্শে আসে না। ফলে পায়ের তলা নরম হতে হতে শিশুদের পায়ের মতো সংবেদনশীল হয়ে যায়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে ‘বেবি ফিট’ বলা হয়। এর ফলে পৃথিবীতে ফেরার পর প্রথম কয়েক দিন হাঁটাচলা করতে বেশ বেগ পেতে হয় নভশ্চরদের।

ক্যানসারের আশঙ্কা

মহাজাগতিক রশ্মি এবং ক্ষতিকর সৌর বিকিরণ থেকে রক্ষার জন্য পৃথিবীতে বায়ুমণ্ডল এবং চৌম্বক ক্ষেত্র রয়েছে। কিন্তু মহাকাশে তো তা নেই! ফলে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে সর্ব ক্ষণ বিকিরণের সংস্পর্শেই থাকতে হয় মহাকাশচারীদের। আর দীর্ঘ কাল ক্ষতিকর বিকিরণের সংস্পর্শে থাকলে ক্যানসারের ঝুঁকিও বেড়ে যায়। ক্ষতিকর বিকিরণের কতটা শরীর দ্বারা শোষিত হচ্ছে, তা মাপার জন্য সর্ব ক্ষণ দেহে ডোসিমিটার নামে এক যন্ত্র পরে থাকতে হয় মহাকাশচারীদের। তবে নাসা বলছে, নভশ্চরদের দেহে যে মারণরোগ বাসা বাঁধবেই, এমনটাও নয়। মহাকাশচারীদের ক্যানসারের ঝুঁকি সাধারণ মানুষের থেকে মাত্র ৩ শতাংশ বেশি।

এ তো গেল মহাকাশে থাকাকালীন মানবদেহে কী কী সমস্যা দেখা দেয়, তার কথা। তবে এখানেই শেষ নয়, দীর্ঘ কাল মহাকাশে কাটানোর পর পৃথিবীরে ফিরে আর এক দফা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় মহাকাশচারীদের।

প্রথমত, মানবশরীরের ভারসাম্য রক্ষা করে কানের অভ্যন্তরে থাকা ‘ভেস্টিবুলার সিস্টেম’। তা এত দিন পর হঠাৎ পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সংস্পর্শে এসে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। যে কারণে পৃথিবীতে ফিরে প্রথম বেশ কয়েক দিন মহাকাশচারীরা টলমল পায়ে হাঁটেন। কখনও আবার পরিস্থিতি এতটাই গুরুতর হয়ে পড়ে যে, অবতরণের পর পরই ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য নিয়ে যেতে হয় নভশ্চরদের। সূত্রের খবর, গত বছরের অক্টোবরে ‘ক্রু ড্রাগন’ যানে ফেরা এক মহাকাশচারীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল, যদিও গোপনীয়তার কারণ দেখিয়ে তাঁর নাম-পরিচয় খোলসা করেনি নাসা। তাঁর ঠিক কী হয়েছিল, জানা যায়নি তা-ও।

স্পেসএক্স ক্রু-৮ মিশনের কমান্ডার ম্যাথিউ ডমিনিক জানাচ্ছেন, কখনও কখনও পৃথিবীতে ফেরার পর সুস্থ হতে সপ্তাহ কিংবা মাসখানেক সময় লেগে যেতে পারে নভশ্চরদের। ম্যাথিউয়ের কথায়, ‘‘কেবলমাত্র অস্থির হয়ে পড়া কিংবা মাথা ঘোরাই নয়, কখনও কখনও কাঠের চেয়ারে বসার মতো সামান্য জিনিসও খুবই যন্ত্রণাদায়ক হতে পারে।’’ পৃথিবীতে ফেরার দিন কয়েক পর পরিবারের সঙ্গে এক নৈশভোজে অংশ নিয়েছিলেন ম্যাথিউ। এখনও সে কথা স্মরণ করলে শিউরে ওঠেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘আমি সেই শক্ত চেয়ারে বসতেও পারছিলাম না। তাই শেষমেশ বারান্দার বাইরে মাটিতে তোয়ালে পেতে কোনওমতে শুয়ে পড়ি, যাতে এক টেবিলে বসতে না পারলেও কথোপকথনে অংশ নিতে পারি।’’ গত সপ্তাহে নিজের মহাকাশে কাটানো সময়ের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিয়েছিলেন নাসার আর এক মহাকাশচারী জেসিকা মেয়ার। জেসিকা জানান, মহাকাশে থাকাকালীন তাঁর দৃষ্টিশক্তিতে পরিবর্তন দেখা দেয়। তবে ফেরার দিন কয়েক পর তা আবার স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিল। ২০১৫-১৬ সালে মহাকাশ স্টেশনে ৩৪০ দিন কাটিয়েছিলেন নাসার আর এক নভশ্চর স্কট কেলি। এত দিন মহাকাশে থাকা তাঁর স্বাস্থ্যের উপর কী প্রভাব ফেলেছে, তা নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা হয়েছিল। এ জন্য সংগ্রহ করা হয়েছিল পৃথিবীতে থাকা স্কটের যমজ ভাই মার্ক কেলির নমুনাও। সেই গবেষণায় দেখা যায়, এত দিনে স্কটের শরীরে নানা পরিবর্তন হয়েছে। দেহের কোনও কোনও কোষে ডি‌এনএ-র মিউটেশন বা গঠনগত স্থায়ী পরিবর্তন হয়েছে। পরীক্ষায় আরও দেখা যায়, স্কটের মাইক্রোবায়োমে নতুন ধরনের ব্যাক্টেরিয়া জন্মেছে। বদলেছে শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও।

তবে ধীরে ধীরে সে সব প্রভাব কাটিয়ে ওঠেন মহাকাশচারীরা। সুস্থ হয়ে উঠে অন্যান্য পরিসরেও কাজে যোগ দেন কেউ কেউ। যেমন, অবসরপ্রাপ্ত নভশ্চর মার্ক এখন আমেরিকার একজন সেনেটর। অন্য মহাকাশচারীদের কেউ কোনও সংস্থার নেতৃত্বপদে রয়েছেন, কেউ বসেছেন নাসারই গুরুত্বপূর্ণ পদে। কেউ কেউ আবার মহাকাশের হাতছানি উপেক্ষা করতে না পেরে ফিরে গিয়েছেন পুরনো পেশায়। এই অমোঘ টান যে শেষ হওয়ার নয়!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement