কোন রন্ধ্র দিয়ে ঢুকছে এই সর্বনাশ? এখনই খুঁজতে হবে

পা‌শাপাশি দু’টো মুখ। দু’টোই তারুণ্যে ঝলমলে, চোখেমুখে একরাশ আলো যেন। তরতাজা দু’টো প্রাণ। জানতে পারলাম দু’জনেই মেধাবী। নামী এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে।

Advertisement

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৬ ০৩:১৮
Share:

পা‌শাপাশি দু’টো মুখ।

Advertisement

দু’টোই তারুণ্যে ঝলমলে, চোখেমুখে একরাশ আলো যেন। তরতাজা দু’টো প্রাণ।

জানতে পারলাম দু’জনেই মেধাবী। নামী এবং লব্ধপ্রতিষ্ঠ স্কুলে, কলেজে, ইউনিভার্সিটিতে পড়াশোনা করেছে। সম্প্রতি দু’জনকেই পড়াশোনার সূত্রে দেশের বাইরে থাকতে হচ্ছিল। এক জন মালয়েশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে, অন্য জন আমেরিকার।

Advertisement

ঢাকায় জঙ্গি হামলার পর এই দু’জনকেই মৃত অবস্থায় পাওয়া গেল।

না, এ বার কিন্তু আর দু’জনকে এক গোত্রে ফেলা যাচ্ছে না। এত ক্ষণ পর্যন্ত তরুণী তারিশি জৈন আর তরুণ নিবরাস ইসলামের মধ্যে সবটাই মিল ছিল। মৃত্যুটাও প্রায় এক সঙ্গেই হয়ে গেল। কিন্তু মৃত্যুর কিছুটা আগে থেকেই দু’জনে পরস্পরের সম্পূর্ণ উল্টো মেরুতে। তারিশি খুন হয়েছেন। নিবরাস খুন করেছে।

সম্পন্ন ঘরের দুই তরুণ-তরুণী, শৈশব থেকেই প্রাচুর্যের মধ্যে বেড়ে ওঠা, জীবন যতটা এগিয়েছে, তাতে সাফল্যের ভাগই বেশি, হাসিখুশি রোজনামচা, না পাওয়ার বেদনা নেই, অভাব নেই, সামনে অতুল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ-- সব নিঃশেষ একটা রাতে। এক জন স্বেচ্ছায় এই ভয়ঙ্কর পথ বেছে নিল। আর এক জনকে শেষ করে দেওয়া হল।

তারিশি আর নিবরাসের মধ্যে কী এই রকম একটা সম্পর্ক তৈরি হওয়া উচিত ছিল? দু’জনের কেউই পরস্পরের পরিচিত নয়। হোলি আর্টিজান বেকারিতে শুক্রবার রাতে প্রথম দেখা দু’জনের। এই পৃথিবীটায় সব কিছু যদি ঠিকঠাক থাকত, সব অঙ্ক যদি হিসেব অনুযায়ী চলত, তা হলে তারিশি-নিবরাসের বন্ধুত্ব হওয়ার কথা ছিল সে রাতে। কিন্তু সে রাতে হোলি আর্টিজান কোনও রেস্তোরাঁ ছিল না, তা নরকে বদলে গিয়েছিল! নরকে যা ঘটা উচিত, তাই ঘটল।

কী অভাব ছিল নিবরাস ইসলামের? দারিদ্র নেই, অপ্রাপ্তি নেই, অক্ষমতা নেই, অবহেলা নেই। পরিজন, পরিচিত, বন্ধুবান্ধব নিয়ে মসৃণ এগোচ্ছিল জীবন। পরিচিতির পরিসর বলছে, সুশীল, মিষ্টভাষী হিসেবেই সুনাম ছিল ঝকঝকে ছেলেটার। সমাজ যাকে প্রায় সব দিয়েছে, অসামাজিকরা কোন রন্ধ্রপথে তার কাছে পৌঁছল? আইএস-এর মতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের মতাদর্শ কী করে তার মগজে ঘাঁটি গাড়ল?

শুধু নিবরাস নয়, তার আর যে সঙ্গীরা গুলশনের রেস্তোরাঁয় সেনার গুলিতে মারা পড়েছে, তাদের অধিকাংশের কাহিনীই নিবরাসের মতোই। শুধু ঢাকাতেও কিন্তু নয়। প্যারিসে বা অরল্যান্ডোতে, বা লন্ডনেও একই কাহিনী। সালাহ আবদেসসালাম, ওমর মতিন বা সিদ্ধার্থ ধর ওরফে আবু রুমায়েশকেও আমরা দেখেছি। প্রত্যেকে তরুণ, প্রত্যেকে প্রতিশ্রুতিমান, প্রত্যেকে সম্ভাবনায় মোড়া। কিন্তু প্রতিটা প্রাণই বেপথু। হিংস্রতা, নৃশংসতা, অন্ধত্বের অতল খাদে নিক্ষিপ্ত।

তবে এই সময় কিন্তু শুধু বিপথগামীকে দুষে দায় সেরে ফেলার নয়। সমস্যার শিকড়ে পৌঁছনর সময় এটা। প্রচলিত ব্যবস্থাটায় নিশ্চয়ই রয়ে গিয়েছে কোনও ছিদ্র। সেই ছিদ্র দিয়েই সুস্থ-স্বাভাবিক নাগরিক জীবনে ভয়ঙ্কর হিংসার এমন নিঃশব্দ অনুপ্রবেশ এবং তার পর এমন সদর্প পদচারণা। না হলে ভরা-ভর্তি জীবনের মাঝখান থেকে কাউকে এ ভাবে মৃত্যুর দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া যায় না। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এরা। এরা এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। তাই প্রশ্ন জাগছে, নিবরাস-তারিশির কাহিনী কোনও অনাগত ভবিষ্যতের আভাস দিয়ে গেল কি? আমাদের ভবিষ্যৎ কি এ ভাবেই পরস্পরকে আঘাত করতে করতে শেষ হয়ে যাবে?

নিজেদের আশেপাশে, একটু দূরে, অনেকটা দূরে, যত দূর চোখ যায়-- সর্বত্র নজর ঘোরানো দরকার। নরকের অন্ধকারটা কি শুধু সে রাতের হোলি আর্টিজানেই ছিল? নাকি আরও অনেক জায়গায় ঘাপটি মেরে রয়েছে? আমার-আপনার নিজের ঘরের কোনায় এমন কোনও আঁধার অলক্ষ্যে ঘনাচ্ছে না তো? গভীর চোখে দেখে নেওয়ার সময় হয়েছে। গলদ থাকলে, তাকে শুধরে নেওয়ার সময় হয়েছে। রন্ধ্রটাকে খুঁজে বার করতে হবেই। তাকে বন্ধ করতে হবেই। দায়িত্বটা সকলকেই নিতে হবে। এখন থেকে। এই মুহূর্ত থেকে।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement