US Election Results 2020

‘একযোগে সারিয়ে তুলতে হবে দেশকে’

ফল ঘোষণার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হোয়াইট হাউসের সামনের রাস্তা আর ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজ়া’-য় নামল জনতার ঢল। উঠল স্লোগান— ‘না, না, গুডবাই।’ কেউ প্ল্যাকার্ডে লিখলেন— ‘দুঃস্বপ্ন ঘুচল’।

Advertisement

সুপ্রতিম সান্যাল

উইলমিংটন (ডেলাওয়্যার) শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০২০ ০৪:৪৯
Share:

খুদের সঙ্গে আলাপরত আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস। জয় সুনিশ্চিত হওয়ার পরে ডেলাওয়্যারের সভায়। রয়টার্স

প্রথমে সিএনএন। তার কয়েক মিনিটের মধ্যে দেশের প্রায় সব ক’টা চ্যানেল জানিয়ে দিল— জো বাইডেন আর কমলা হ্যারিসই জিতেছেন। এমনকি মিনিট দশেক পার করে ফক্স নিউজ়ও স্বীকার করল— ডোনাল্ড ট্রাম্পের দৌড় শেষ। আর ঠিক তখনই একটা নোটিফিকেশন ঢুকল ফোনে। একটা ইউটিউব লিঙ্ক পাঠিয়েছেন আমার আত্মীয় আশুতোষ চট্টোপাধ্যায়। তেমন এক্সক্লুসিভ কিছু নয়। আমাদের সবার প্রিয় সত্যজিতের একটা সিনেমার শেষ দৃশ্য— ‘দড়ি ধরে মারো টান/ রাজা হবে খান-খান।’ বহু বার দেখা। কিন্তু মনে হল, এর থেকে প্রাসঙ্গিক আর কিছু নেই আজ।

Advertisement

খবর পাওয়া মাত্রই শুনতে পেলাম, বাইডেন-কমলাকে ঘিরে উৎসব শুরু হয়ে গিয়েছে পূর্বের নিউ ইয়র্ক, মিয়ামি থেকে শুরু করে পশ্চিমের ডেনভার, অস্টিন-সহ দেশের নানা প্রান্তে। রাস্তায় নেমে নাচ-গানে জয়োল্লাস। টিভিতে দেখলাম, কেউ একটানা গাড়ির হর্নই বাজিয়ে গেলেন আনন্দে।

ফল ঘোষণার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হোয়াইট হাউসের সামনের রাস্তা আর ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার প্লাজ়া’-য় নামল জনতার ঢল। উঠল স্লোগান— ‘না, না, গুডবাই।’ কেউ প্ল্যাকার্ডে লিখলেন— ‘দুঃস্বপ্ন ঘুচল’। বাইডেনের পেনসিলভেনিয়া জয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ফিলাডেলফিয়া শহরেও দেখলাম কফির কাপ, ককটেল নিয়ে রাস্তায় নেমেছে জনতা।

Advertisement

২৭০-এর ম্যাজিক সংখ্যা ছুঁয়েছিলেন আগেই। কিছু চ্যানেল বলছে, বাইডেনের প্রাপ্ত ইলেক্টোরাল ভোট এখন ২৯০! ট্রাম্প আটকে সেই ২১৪-তে। তাই সব জল্পনার মোটামুটি অবসান। ট্রাম্পকে হটিয়ে হোয়াইট হাউসে আসছেন বাইডেনই।

সেই বাইডেন, প্রথম প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেটের মঞ্চে দাঁড়িয়ে যিনি ট্রাম্পের ভাষাতেই ট্রাম্পকে থামিয়ে দিতে চেয়ে বলেছিলেন— ‘উইল ইউ শাট আপ ম্যান!’ রাজনৈতিক মহলের একাংশ এখনও মনে করেন, এর চেয়ে কুৎসিত প্রেসিডেন্সিয়াল ডিবেট আমেরিকার ইতিহাসে আগে কখনও হয়নি। ডিবেটের আগে বিশেষজ্ঞেরা বাইডেনকে বার বার সতর্ক করেছিলেন, ট্রাম্পের উস্কানিতে পা না-দিতে। তবু ক্ষণে-ক্ষণে মেজাজ হারাতে দেখা গিয়েছিল বাইডেনকে। ডেমোক্র্যাট শিবিরের একটা অংশ তাতে উচ্ছ্বসিত হলেও, অনেকেই প্রমাদ গুনেছিলেন।

কাল ফল ঘোষণার পরে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটা পোস্ট দেখলাম— ‘ট্রাম্প আর পা-ই রাখতে পারবেন না। হোয়াইট হাউস এখন forBiden!’ বাইডেনের মুখে কিন্তু সম্পূর্ণ উল্টো সুর। ডেলাওয়্যারে নিজের শহর উইলমিংটন থেকে বললেন, ‘‘নীল-লাল প্রদেশ নয়। এ বার আমরা এক আমেরিকা দেখতে চাই। কেউ কারও শত্রু নই, আমাদের পরিচয়— আমরা আমেরিকান। আমাদের একজোট হয়ে আমেরিকাকে সারিয়ে তুলতে হবে।’’

এই মুহূর্তে জোড়া রোগে ধুঁকছে আমেরিকা। কোভিড আর ভয়ঙ্কর এক রাজনৈতিক মেরুকরণে। ক্ষমতায় আসার প্রথম দিনই নয়া করোনা টাস্ক ফোর্সকে মাঠে নামানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বাইডেন। আর ট্রাম্প-সমর্থকদের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘‘ভোটের এই ফলাফলে যে অনেকেই হতাশ, সেটা বুঝতে পারছি। এই ব্যথাটা ভালই বুঝি, কারণ আমি নিজেও অন্তত দু’বার হেরেছি। কিন্তু এ বার চলুন ঘুরে দাঁড়াই। পরস্পরকে অন্তত একটা সুযোগ দিই। দেশের মেরুদণ্ডটাকে আবার পোক্ত করতেই হবে। হাল ফেরাতে হবে মধ্যবিত্তের। গোটা বিশ্বের কাছে আমেরিকার হৃতসম্মান আবার ফেরাতেই হবে আমাদের।’’ পাশে থেকে ভরসা রাখার জন্য ধন্যবাদ জানালেন সমর্থকদেরও।
ডিবেটের মঞ্চে মরিয়া এক প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে দেখেছিলাম। কাল দেখলাম, পাঁচ দশকের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন দক্ষ প্রশাসককে। ক্ষমতা আর দায়িত্ববোধ মনে হয় এ ভাবেই একসঙ্গে আসে! হোয়াইট হাউসে এসেই ট্রাম্প-জমানার বেশ কয়েকটি নীতি বদলানোর ইঙ্গিত দিয়েছেন বাইডেন। আমেরিকা ফের হয়তো প্যারিস চুক্তিতে ঢুকবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সঙ্গেই থাকবে। কিছু মুসলিম দেশের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠবে হয়তো। শোনা যাচ্ছে, এইচ১বি ভিসাধারীদের স্ত্রী কিংবা স্বামীর চাকরি নিয়েও সুখবর দেবেন নয়া প্রেসিডেন্ট।

ট্রাম্প সমর্থকদের একাংশ কিন্তু এখনও হার মানতে নারাজ। আজও ‘ভোটচুরি বন্ধ হোক’ জাতীয় ব্যানার নিয়ে তাঁদের বিক্ষোভ দেখাতে দেখা গিয়েছে নানা প্রদেশের রাজধানী শহরে। কোথাও অস্ত্র-সহও। তবে বড়সড় অশান্তির কোনও খবর নেই।

বরং এখন উৎসবের সময়। ঝুঁকি নিয়ে তাই স্ত্রী, ছেলে-মেয়েকে নিয়ে আমিও নামলাম রাস্তায়। আমেরিকার ব্যস্ততম হাইওয়ে ইন্টারস্টেট ৯৫ ধরে ডেলাওয়্যার প্রদেশের দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে ঢুকলে উইলমিংটন শহর আধ ঘণ্টার রাস্তা। মাঝে ‘বাইডেন ওয়েলকাম সেন্টার’ নামের রাস্তায় নেমে ছবি-টবি তুলে আবার গাড়িতে। মিনিট কুড়ি গাড়ি চালিয়ে ব্যাকলাইট জ্বালানো শ’য়ে-শ’য়ে গাড়ির জ্যাম ঠেলে যখন রিভারফ্রন্ট কনভেনশন সেন্টারের পার্কিং লটে পৌঁছলাম, তখন সন্ধে সাড়ে ৬টা। সাড়ে ৮টার একটু আগে আটাত্তরের বাইডেন মঞ্চে উঠলেন প্রায় দৌড়ে। সঙ্গে হ্যারিস। জনতার উল্লাসে মন হল, একসঙ্গে জোড়া গোল দিলেন মেসি। তার পর আরও কত! একটা সময়ে বক্তৃতা শেষ করলেন দু’জনে। অদ্ভুত! মিথ্যে প্রতিশ্রুতি নেই, কাউকে খাটো করা নেই, অদ্ভুত কোনও দাবিও নেই। কিছু মানুষকে উস্কে দেওয়ার চেষ্টাও তো কই নজরে এল না!

এখন দেখার, ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া আদৌ সহজে মেটে কি না! তিনি যে সহজে ক্ষমতা ছাড়তে চাইবেন না, আগেই সেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন ট্রাম্প। হালে তাতে জুড়েছে কিছু প্রদেশে ভোট-কারচুপির অভিযোগ এবং পুনর্গণনার আর্জি জানিয়ে ট্রাম্প শিবিরের মামলা। যদিও একটি সংবাদমাধ্যম সূত্রের খবর, ট্রাম্প প্রশাসন ইতিমধ্যেই ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ শুরু করে দিয়েছে।

ট্রাম্প শিবিরের কিছু মামলা নাকচ হয়ে গেলেও জর্জিয়া, উইসকনসিনে ভোট পুনর্গণনা হতে পারে। যদিও তাতে ফল ওল্টানোর কোনও সম্ভাবনাই দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা। ট্রাম্পের কাছে শেষ রাস্তা কংগ্রেস। নিয়ম অনুযায়ী, হাউসের অন্তত এক জনকে লিখিত ভাবে অভিযোগ জানাবে এবং সেনেট তাতে মান্যতা দেবে। কিন্তু হাউসে যদি ডেমোক্র্যাটদেরই আধিপত্য থাকে, তা হলে সেটাও কঠিন হবে। আমেরিকার ভোট-রাজনীতিতে প্রচলিত— কেউ ভোটে জিতলে বর্তমান প্রেসিডেন্ট হার স্বীকার করে বিজয়ী প্রার্থীকে অভিনন্দন জানান। বিজয়ী প্রার্থী এর পাল্টা বিদায়ী প্রেসিডেন্টকে ধন্যবাদ জানিয়ে নিজের জয় ঘোষণা করেন। কিন্তু এ বার তা আর হল কই! চ্যানেলে যখন ফল ঘোষণা হচ্ছে, ট্রাম্প তখন গল্‌ফ ক্লাবে। সেখান থেকেই টুইটারে দাবি করলেন, আসলে তিনিই বিপুল ভোটে জিতেছেন। দেশবাসীকে মনে করিয়ে দিলেন, তিনি কোর্টে যাচ্ছেন। কারণ ট্রাম্পের দাবি, এই ভোটে এত কারচুপি হয়েছে যে, তাঁর নিশ্চিত জয় ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছেন বাইডেন-হ্যারিস।

এ সব এখন ভিত্তিহীন। ট্রাম্প যা-ই করুন, ২০ জানুয়ারি দেশের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেনের শপথ নেওয়া প্রায় নিশ্চিত। দেশের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে সে দিন শপথ নেবেন কমলাও। মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান এখনও পায়নি আমেরিকা। গত বারের ভোটে ট্রাম্পের থেকে ৩ লক্ষ বেশি ভোট পেয়েও ইলেক্টোরাল কলেজ সিস্টেমে আটকে গিয়েছিলেন হিলারি ক্লিন্টন। এ বার তবু কমলা ডেপুটি তো হচ্ছেন!

কথায় কথায় সল্ট লেক সিটি-নিবাসী আমার বন্ধু নবনীতা সেন একটি তথ্য দিলেন। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে এ দেশে স্বীকৃত হয়েছিল মহিলাদের ভোটাধিকার। ক্ষমতার অলিন্দে আসতে নারীর শতাব্দী পেরিয়ে গেল, এই যা আক্ষেপ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement