ইউক্রেনের মিকোলিয়েভে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর হামলায় গুঁড়িয়ে গিয়েছে মানসিক রোগীদের একটি হাসপাতাল। সেই ভগ্নস্তূপের ছবি তুলছেন হাসপাতালের চিকিৎসক আনাতোলি পাভলভ। মঙ্গলবার। ছবি: রয়টার্স।
দিকে দিকে পড়ে রয়েছে লাশ। গোটা শহরটাই যেন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেই মৃত নগরী মারিয়ুপোলে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব ইউক্রেন ফিরিয়ে দেওয়ায় আজ আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে বন্দর শহরে ঢুকে পড়ল রুশ ফৌজ। দু’টি শক্তিশালী বোমাও নিক্ষেপ করা হয়েছে। এখনও সেখানে আটকে রয়েছেন ২ লক্ষেরও বেশি মানুষ। তাঁদের উদ্ধারকাজ চলাকালীনই আছড়ে পড়ে রুশ বোমা। যদিও উপ-প্রধানমন্ত্রী ইরিনা ভেরেশচুক জানিয়েছেন, সমস্ত শহরবাসীকে যত ক্ষণ না অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হচ্ছে, শত আক্রমণ সত্ত্বেও উদ্ধারকাজ চালানো হবে। মারিয়ুপোল থেকে শিশুদের অবৈধ ভাবে রাশিয়ায় নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও তুলেছেন ইরিনা।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জ়েলেনস্কি বলেছেন, মারিয়ুপোলে আত্মসমর্পণের প্রশ্নই নেই, বরং যুদ্ধের পরিণাম দুর্ভিক্ষের মাধ্যমে চোকাতে হবে রাশিয়াকে। রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে চেয়েছেন তিনি। সঙ্গে জানিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যা না মেটালে রাশিয়া যে ক্ষতির সম্মুখীন হবে, তা মেটাতে লেগে যেতে পারে কয়েক প্রজন্ম।
প্রেসিডেন্টের অনমনীয় মনোভাবই যেন আজ সঞ্চারিত হয়েছে ইউক্রেনের বাহিনীর মধ্যে। প্রবল বিক্রমে কিভের উপকণ্ঠে গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মাকারিভ রুশ দখলমুক্ত করেছে ইউক্রেন। এর পরেই উত্তর-পশ্চিমাংশের সঙ্গে সংযোগকারী একটি গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়েও রুশ দখলমুক্ত করা হয়। ফলে কিভে প্রবেশে উন্মুখ রুশ সেনার কাজ আরও কঠিন হল।
তবে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক জানিয়েছে রুশ সেনা উত্তর-পশ্চিমের শহরতলি অঞ্চল বুচা, হসটোমেল, ইরপিনের কিছু অংশ দখল করেছে। রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে জানানো হয়েছে, নিহত ইউক্রেনীয় নাগরিকের সংখ্যা হাজার ছুঁইছুঁই। যদিও প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে অনেক বেশি বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। আজ ড্রোন হানায় কিভের সায়েন্টিফিক ইনস্টিটিউটে অন্তত এক জনের মৃত্যু হয়েছে।
ইউক্রেন পরিস্থিতি নিয়ে আজ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন। মোদী জানান, অবিলম্বে সংঘর্ষবিরতি ঘোষণা করে কূটনৈতিক আলোচনায় বসুক বিবদমান দুই দেশ। এর পাশাপাশি তিনি জানান, সমস্ত রাষ্ট্রের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্বকে সম্মান করে ভারত।
ইউক্রেনে হামলার জেরে রুশ সেনার ৯৮৬১ জন নিহত এবং ১৬,১৫৩ জন আহত হয়েছেন বলে ক্রেমলিনের একটি সরকারপন্থী সংবাদমাধ্যম খবর প্রকাশ করতেই চাঞ্চল্য তৈরি হয়। পরিস্থিতি সামলাতে ওয়েবসাইট থেকে দ্রুত সেই সংখ্যা মুছে ফেলা হয়। কিন্তু তত ক্ষণে সেই খবরের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। যদিও ইউক্রেনের দাবি, নিহত রুশ সেনার সংখ্যা ১৫ হাজারেরও বেশি।
কিভে অবস্থিত আমেরিকান দূতাবাস জানিয়েছে, ইউক্রেনের বিদেশ মন্ত্রকের তথ্য অনুযায়ী, ডনেৎস্ক ও লুহানস্ক থেকে ২৩৮৯ জন শিশুকে অপহরণ করে রুশ অধিকৃত অঞ্চলে আটকে রাখা হয়েছে।
ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ভিক্তর লিয়াশকো আজ জানান, রুশ হামলার জেরে এখনও পর্যন্ত ১০টি হাসপাতাল গুঁড়িয়ে গিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) জানিয়েছে, ইউক্রনের স্বাস্থ্য পরিষেবার উপরে অন্তত ৬২টি হামলা হয়েছে। রাতে স্টেট ইমার্জেন্সি সার্ভিস জানিয়েছে, লুহানস্ক ওবলাস্টের সেভেরোডনেৎস্কে শিশুদের একটি হাসপাতালের ছাদে রুশ বাহিনীর ছোড়া গোলায় আগুন লেগে যায়। সাত জন শিশু ও ১৫ জন প্রাপ্তবয়স্ককে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয়েছে।
এ দিকে জ়েলেনস্কির স্ত্রী ওলেনা জ়েলেনস্কা একটি সংবাদপত্রে জানিয়েছেন, ইউক্রেনের জমিনে রুশ হামলা আছড়ে পড়তেই গোটা বিশ্বের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছিলেন তিনি। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসুস্থ শিশুদের উদ্ধার ও ঠাঁই দেওয়ায় ফ্রান্সের ফার্স্ট লেডি ব্রিগিট মাকরঁ ও অন্যান্য দেশের শীর্ষ নেতার স্ত্রীদের ধন্যবাদ। এর পাশাপাশি তিনি কৃতজ্ঞতা জানান সেই সমস্ত ইউরোপীয়কে, যাঁরা নিজের বাড়িতে ইউক্রেনের শরণার্থীদের থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত করেছেন। মনোবল জুগিয়েছেন। শুধু কৃতজ্ঞতা নয়, ওই মানুষগুলোর যৌথ ভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া উচিত বলেও মনে করেন ইউক্রেনের ফার্স্ট লেডি।
এই সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতেও তাঁর স্বামী যে শান্ত ও মরিয়া মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন তারও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন ওলেনা।
ইউক্রেনের শরণার্থীদের চাকরি, শিক্ষা ও বাসস্থানের কী বন্দোবস্ত করা যায়, তা নিয়ে আগামীকাল বৈঠকে বসতে চলেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জানিয়েছেন, ভ্লাদিমির পুতিনের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছে। বাইডেনের কথায়, ‘‘পুতিন আন্দাজ করতে পারছেন না ঐক্যবদ্ধ ভাবে আমাদের শক্তি কতখানি।’’ এর পরেই পুতিনের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের পরিকল্পনার অভিযোগ তুলেছেন তিনি। বাইডেনের বক্তব্য, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে জৈব ও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের ভুয়ো অভিযোগ তুলেছিল রাশিয়া। এই ভিত্তিহীন অভিযোগ থেকেই স্পষ্ট পুতিন নিজেই এমন কোনও হামলার ফন্দি আঁটছেন। এর আগে বাইডেন পুতিনকে যুদ্ধপরাধী বলেছিলেন। সেই ঘটনার জেরে রাশিয়া আমেরিকান দূত জন সুলিভানকে ডেকে জানিয়েছে, প্রয়োজন হলে আমেরিকার সঙ্গে সমস্ত রকম সম্পর্ক ছিন্ন করতেও দ্বিধা করবে না তারা।
গত কাল প্রথম বার ওডেসার আবাসিক অঞ্চলে রুশ হানার খবর সামনে এসেছিল। ওডেসার এমপি-র আশঙ্কা, কৃষ্ণ সাগরের দিক থেকে এ বার নিরন্তর হামলা চালাতে পারে রাশিয়া। কিভের কাছেই অবস্থিত বরিসপিলেও হামলার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানান মেয়র ভলোদিমির বরিসেঙ্কো। তিনি বাসিন্দাদের দ্রুত শহর ছাড়ার আবেদন জানিয়েছেন।
আজ রাষ্ট্রপুঞ্জের মহাসচিব আন্তোরিয়া গুতেরেস জানিয়েছেন, মারিয়ুপোল ঘিরে গত এক পক্ষকালের বেশি সময় ধরে রুশ বাহিনী আক্রমণ চালাচ্ছে। তাঁর কথায়, ‘‘এ সব কিসের জন্য? যদি মারিয়ুপোলের পতনও হয়, তা সত্ত্বেও ইউক্রেনের প্রতিটি শহর, রাস্তা, বাড়ি জয় করা সম্ভব নয়। এ সবের পরিণাম হল আরও ধ্বংস, আরও প্রাণহানি।’’ তবে রুশ হামলা থামেনি। ডনেৎস্ক অঞ্চলের আভদিভকায় আজ নিহত হয়েছেন পাঁচ ইউক্রেনীয়।
ইটালির প্রধানমন্ত্রী মারিয়ো দ্রাঘির অফিস জানিয়েছে, তারা চায় ইউক্রেন ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দিক। অশান্তির জেরে যাঁরা ইউক্রেন ছাড়ছেন সেই শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছে ইটালি।
আজ ইউক্রেনের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, রুশ অধিকৃত খেরসনে তিন লক্ষেরও বেশি মানুষ খাবার, ওষুধটুকু পাচ্ছেন না। ওই মানুষদের উদ্ধারকাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগও তুলেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে।
আজ ইউক্রেন দাবি করেছে, রুশ সেনার ভাঁড়ারে যে অস্ত্র ও খাবার রয়েছে, তা সর্বাধিক তিন দিন চলবে। বাড়ন্ত জ্বালানিও।