নানা রূপে: প্রিয় মার্কিন প্রেসিডেন্টের প্রতিকৃতির সামনে শিল্পী ত্রাম লাম বিন।
যুদ্ধের সেই ছবিটা ভোলেনি ভিয়েতনাম। ৪৭ বছর আগেকার ছবি। ‘নাপাম বোমা’র জ্বালা থেকে বাঁচতে দক্ষিণ ভিয়েতনামের রাস্তায় পড়িমরি দৌড়চ্ছে বছর দশেকের একটি মেয়ে। গায়ে একটা সুতোও নেই! আর পিঠের দিকটা ঝলসে গিয়েছে অনেকখানি।
১৯৭৩-এ পুলিৎজ়ার পেয়েছিল ছবিটা। আর নাড়িয়ে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। এ বার সেই ভিয়েতনামেই আসছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ মাসের শেষ দু’দিন হ্যানয়ে উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠক করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
একাংশ অসন্তুষ্ট। ক্ষুব্ধও। বছর পঁয়ত্রিশের চিত্রশিল্পী ত্রাম লাম বিন কিন্তু উৎসাহে ফুটছেন। ২০১৬ থেকে নাগাড়ে ‘ট্রাম্প’ আঁকছেন তিনি। সংখ্যায় যা এখনও পর্যন্ত ৫০। মাঝে ছ’ফুটের পিতল-মূর্তিও গড়েছেন। বৈঠকের আর দিন কয়েক বাকি। তাই দিনরাত এখন হ্যানয়ের স্টুডিয়োতেই তেল-রঙে ট্রাম্পকে ‘ফিনিশিং টাচ’ দিচ্ছেন শিল্পী। কিমের ছবি এঁকেছেন ১০টি। এক ফাঁকে মেসেঞ্জারে বললেন, ‘‘ইতিহাস থাকুক। কিন্তু তা নিয়ে পড়ে থাকলে চলবে কেন! শান্তির কথা বলতে যাঁরা আসছেন, তাঁদের স্বাগত। এ বার বরং নতুন ইতিহাস তৈরি হোক।’’
সে দিনের ‘নাপাম-কন্যা’ এখন ৫৫-র প্রৌঢ়া। ইউনেস্কোর শুভেচ্ছা দূত এবং বহু ‘শান্তি’ পুরস্কার-জয়ী। এখন কানাডায় থাকেন কিম ফুক। সেখান থেকেই তিনি নজর রাখবেন, হ্যানয়ে কী হয়! বিন কিন্তু শান্তি আলোচনায় আস্থা রাখছেন একশো ভাগ। গত জুনে সিঙ্গাপুরে উত্তর কোরিয়ার পরমাণু নিরস্ত্রীকরণ নিয়ে দুই রাষ্ট্রনেতার বৈঠকের পর থেকে তিনি কিমেরও ভক্ত। বললেন, ‘‘ওঁর কৌতুকবোধ আমায় খুব টানে। হাজারো নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও কিম যে ভাবে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে।’’
কিমে মুগ্ধ হ্যানয়ের হেয়ার-ডিজ়াইনার লে তুয়ান জ়ুয়ং-ও। জানালেন, এই বৈঠকের দিন ঠিক হওয়ার পর থেকেই তাঁর সেলুনে ভিড় উপচে পড়ছে। বিনামূল্যে ‘ট্রাম্প-কিম ছাঁট’ দিচ্ছেন যে! তবে জনপ্রিয়তায় বেশ পিছিয়ে ট্রাম্প। গত কয়েক দিনে যেখানে ২০০ জন মাথার চারপাশ প্রায় কামিয়ে ফেলেছেন, সেখানে ট্রাম্পের সোনালি চুল আপন করেছেন মাত্র ৫ জন!
বিনের মতে, এই বিদ্বেষ স্বাভাবিক। ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়েছিলেন জন এফ কেনেডি, রিচার্ড নিক্সনের মতো পাঁচ মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বলা হয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চার গুণ বোমা পড়েছিল ভিয়েতনামে। সেই মার্কিন আগ্রাসন ভোলেনি ভিয়েতনামের একটা বড় অংশ। বিন জানালেন, যুদ্ধের ছবি দেখে তিনিও ফুঁসতেন এক সময়।
কিন্তু এখন তিনি ‘ট্রাম্প-নাম’ই করে চলেছেন। সমাজের বাঁকা চোখ উপেক্ষা করেই। জানালেন, বাড়ির আপত্তি সত্ত্বেও ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে তিনি কয়েকটা ছবি নিয়ে ওয়াশিংটনেও চলে গিয়েছিলেন। তবে হোয়াইট হাউসের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারেননি। তাঁর আশা, এ বার ট্রাম্প নিজেই আসবেন তাঁর স্টুডিয়োয়। তাঁর কথায়, ‘‘যখন ট্রাম্পকে আঁকি, মনে হয় ওঁর ভিতরটা পড়তে পারছি। এই আনন্দই শেষ কথা। এমন একটা বর্ণময় চরিত্রকে ক্যানভাসে জীবন্ত করে তোলাটাই চ্যালেঞ্জ। অতীত ভুলে অনেকটা এগিয়েছি। আমেরিকাও বদলেছে। এ বার সামনে তাকাতেই হবে।’’
ভিয়েতনামে মানুষ মারতে ‘নাপাম’ আর জমি-বাড়ি উজাড় করতে ‘অরেঞ্জ এজেন্ট’ ফেলেছিল আমেরিকা। শেষমেশ অবশ্য হো চি মিনের দেশ থেকে পালাতে বাধ্য হয়েছিল আমেরিকা। প্রতিবাদী কলকাতাও সে বার স্লোগান দিয়েছিল ‘তোমার নাম, আমার নাম— ভিয়েতনাম-ভিয়েতনাম’।
ব্যতিক্রমী নাম বিন তবু বলছেন, ‘‘আমি যুদ্ধ দেখিনি। দেখতেও চাই না। নয়া প্রজন্মের এক জন হিসেবে আমি শান্তি চাই। চাই, পৃথিবীটা সুন্দর হোক। একটা সময় তো হো চি মিনকেও এঁকেছি। এখন ট্রাম্প-কিম আঁকছি।’’
ট্রাম্পের দাবি, তিনিও যুদ্ধ চান না। তাই সিরিয়া ও আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন। আর তাঁর দেশেরই সংবাদমাধ্যম বলছে— সেনা আইনে বাধ্যতামূলক ভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যাওয়ার কথা ছিল ট্রাম্পেরও। তখন তিনি ছাত্র। কিন্তু তিন বার উচ্চশিক্ষা আর এক বার ভগ্নস্বাস্থ্যের কথা বলে যুদ্ধে ‘ফাঁকি’ দিয়েছিলেন ট্রাম্প।