এই ছবিই বদলে দিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি। ছবি সৌজন্য: নিক উট।
১৯৭২ সালে এই ছবি তোলা হয়েছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের একটি গ্রামে। পিছনে কুখ্যাত নাপাম বোমার ধোঁয়া। যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে নগ্ন হয়ে দৌড়চ্ছে নয় বছরের এক বালিকা। অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের এক চিত্রসাংবাদিকের তোলা এই ছবি দেখার পর কী করবেন, তা বুঝতে পারছিলেন না নিউইয়র্ক টাইমসের এডিটররা। নগ্নতার জন্যই একটু দ্বন্দ্বে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু সাহস করে শেষ পর্যন্ত ছবিটা তাঁরা ছেপেই দিয়েছিলেন পরের দিনের সংবাদপত্রে। বাকিটা ইতিহাস। একটা ছবি বদলে দিয়েছিল ভিয়েতনাম যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি।
৯ বছরের বালিকা কিম ফুকের বাড়ি ছিল দক্ষিণ ভিয়েতনামের একটি গ্রামে। ভিয়েতনাম জুড়ে তখন ‘নাপাম বোমা’ আর কুখ্যাত রাসায়নিক বিষ ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’ ঢালছে মার্কিন সেনা। স্থানীয় কাওদাই মন্দির চত্বর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে রওনা দিয়েছিল কিম ফুক ও তার গ্রামের লোকজন। বোমারু বিমান রেহাই দেয়নি তাঁদের। ওপর থেকে ফেলতে থাকে নাপাম বোমা। বোমার আঘাতে ঘটনাস্থলেই মারায় যায় কিম ফুকের চার পড়শি। বোমায় জ্বলে যায় তাঁর দেহের একটা অংশ। জ্বলে যাচ্ছে! জ্বলে যাচ্ছে! এই চিৎকার করতে করতেই দৌড়তে থাকেন কিম। সেই মুহূর্তই লেন্সবন্দী করেছিলেন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের চিত্রসাংবাদিক নিক উট।
যুদ্ধের আগুনে চোখের সামনে সব ছারখার হতে দেখা সেই মেয়েটির মধ্যে কি আজও জ্বলে প্রতিহিংসার আগুন? গত মাসেই জার্মানিতে একটি অনুষ্ঠানে তিনি বললেন, ‘‘ওই মুহূর্ত, ওই দিনের ছবিটা নিশ্চিত ভাবেই আমার জীবন বদলে দিয়েছে। ছবিটা দেখলে ওই দিনের আগুনের গন্ধ, ধোঁয়া, জ্বলুনি সব মনে পড়ে যায়। চারিদিকে আগুন দেখতে পাচ্ছিলাম। পুড়ে গিয়েছিল আমার জামা। তখন আমার ভেতর কী হচ্ছিল, তা আমার এখনও মনে আছে। আমার ন’বছর বয়স ছিল তখন। আমার মনে হচ্ছিল, হে ভগবান! আমি পুড়ে গিয়েছি। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই ভয় থেকেই আমি প্রাণপণে দৌড়চ্ছিলাম। সেই সময়ই ছবিটা তোলা হয়।’’ কিমের মনে হয়, তিনি এই পৃথিবীতে যুদ্ধের শিকার হওয়া লক্ষ লক্ষ শিশুদের মধ্যে একজন। পৃথিবীর মানুষের উদ্দেশে তাঁর বার্তা, ‘‘সবাই একটু ভালবাসা, আশা আর ক্ষমা— এই তিনটি বিষয় দিয়ে জীবন সাজাতেই পারে, কারণ এটা করা সম্ভব। আমাদের পৃথিবীতে যুদ্ধের কোনও প্রয়োজন নেই। একটা ছবির একটা বাচ্চা মেয়ে যদি যুদ্ধ থামিয়ে দিতে পারে, তাহলে সবাই পক্ষেই এটা সম্ভব।’’
ড্রেসডেন শান্তি পুরষ্কারের মঞ্চে কিম। ছবি: এএফপি।
যুদ্ধের ভয়াবহতা নিজের চোখে দেখার পর থেকেই যুদ্ধবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন কিম। এখন তিনি থাকেন কানাডায়। যুদ্ধে আক্রান্তদের চিকিৎসা ও শুশ্রুষার জন্য খুলেছেন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। যুদ্ধের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইয়ের জন্য গত মাসেই তাঁকে ড্রেসডেন শান্তি পুরষ্কার দিল জার্মানির সরকার। সেখানেই দেওয়া বক্তৃতাতেই এই কথাগুলি বলেছেন তিনি।
আরও পড়ুন: দুই ভাই এক বোন ছিল, এখন আমি একা, বলছে আইএস জঙ্গিদের শেষ ঘাঁটি থেকে উদ্ধার হওয়া হারেথ
কিন্তু কাদের জন্য কোন পরিস্থিতিতে মাত্র ন’বছর বয়সে যুদ্ধের মুখোমুখি হতে হয়েছিল কিম ফুককে? তা জানতে পিছিয়ে যেতে হবে আরও ৫৮ বছর। সময়টা ১৯৬১। ঠাণ্ডা যুদ্ধের মহড়া হিয়েবে ভিয়েতনামকেই বেছে নিয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর আমেরিকা। ভিয়েতনামের মাটি থেকে জঙ্গল, ফসল আর সব ধরণের সবুজ চিরতরে মুছে দেওয়ার পরিকল্পনায় তখন সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি। সেই কাজ মসৃণ করতে রাসায়নিক তৈরির বরাত দেওয়া হয়েছে বহুজাতিক রাসায়নিক সংস্থা মনস্যান্টো আর ডাউ কেমিক্যালসকে। এই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক আইন মেনেই এবং এর আগেও এই ধরনের রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের নজির আছে, এমনটাই যুক্তি ছিল মার্কিন প্রশাসনে। যেমন ভাবা, তেমনই কাজ। জঙ্গলের আড়ালে লুকিয়ে থাকছে গেরিলারা, তাই ধ্বংস করে দিতে হবে সমস্ত রকমের সবুজই। দক্ষিণ ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট গেরিলাদের জব্দ করতে এর পরই ভিয়েতনাম জুড়ে গ্যালন গ্যালন রাসায়নিক ঢালতে শুরু করে মার্কিন সেনা।
রামধনু রাসায়নিক।কুখ্যাত এই বিষকে এই নামেই ডাকতো মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলি। এই নামেই তা পরিচিত ছিল মার্কিন সেনাদের কাছেও। কারণ আমেরিকা থেকে তা ভিয়েতনামে নিয়ে যাওয়া হত গোলাপি, সবুজ, লাল, সাদা, কমলা রঙের বাহারি ড্রামে। ১৯৬১ সালে এই রাসায়নিক ব্যবহারের সবুজ সঙ্কেত পাওয়ার পর পরের দশ বছরে ভিয়েতনামে ঢালা হয়েছিল এই সাতরঙা বিষের মধ্যে সব থেকে কুখ্যাত ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’। সব মিলিয়ে মোট সাড়ে চার কোটি লিটার ‘এজেন্ট অরেঞ্জ’।
বি-৫২ বোমারু বিমান থেকে বোমাবর্ষণ করছে মার্কিন বায়ুসেনা। ফাইল চিত্র।
রাসায়নিক দিয়ে সবুজ ধ্বংসের পাশাপাশি রাসায়নির দিয়ে গাছ জ্বালানোর অভিযানেও নেমেছিল আমেরিকা। সেই কাজে তাঁদের হাতিয়ার ছিল নাপাম বোমা। প্লাস্টিক পলিয়েস্টিরিন, হাইড্রোকার্বন বেঞ্জিন আর গ্যাসোলিন দিয়ে তৈরি এই জেলির মতো রাসায়নিক মিশ্রণ ভিয়েতনাম জুড়ে ফেলেছিল মার্কিন সেনারা। কখনও স্প্রে করে, কখনও বা সরাসরি বোমা ফেলে জ্বালিয়ে দেওয়া হত জঙ্গল, ঘরবাড়ি সব কিছুই। এই রাসায়নিকে আগুন লাগলে তা জ্বলতে থাকে দশ মিনিট ধরে, তাপমাত্রা পৌঁছয় ১০০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে।
মাত্র ন’বছর বয়সে নাপাম বোমার সেই জ্বালাই টের পেয়েছিলেন কিম ফুক। ছবিটা তোলার পরই তাঁকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে দৌড়েছিলেন চিত্র সাংবাদিক নিক উট। সাইগনের হাসপাতালে পৌঁছনোর পর চিকিৎসকেরা জানিয়ে দিয়েছিলেন কিমের বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। সারা শরীরের ৩০ শতাংশই থার্ড ডিগ্রি মাত্রায় পুড়ে গিয়েছিল। কিন্তু হাল ছাড়েননি নিক উট। ১৪ মাস হাসপাতালে রেখে সারিয়ে তুলেছিলেন কিমকে। করতে হয়েছিল মোট ১৭টি অস্ত্রোপচার, তার মধ্যে ছিল পুড়ে যাওয়া ত্বক প্রতিস্থাপনও।
আরও পড়ুন: যুদ্ধ বিরোধী অবস্থানের জেরেই ট্রোলড নিহত বাঙালি জওয়ানের স্ত্রী
এই ছবি এতটাই প্রভাব ফেলেছিল জনমানসে, যে তা নিয়ে বিব্রত হয়েছিলেন খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন। সামনে এসেছিল মার্কিন সেনাপ্রধানের সঙ্গে তাঁর সেই আলাপচারিতার অডিয়ো টেপ। সেখানে নিক্সনকে বলতে শোনা যায়, ‘‘আমার মনে হচ্ছে এই ছবি সাজানো।’’ মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই বক্তব্য সামনে আসার পর তাঁর তীব্র সমালোচনা করেছিলেন নিক উট। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছিলেন, ‘‘আমার তোলা এই ছবি ভিয়েতনাম যুদ্ধের মতোই সত্য। ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতা রেকর্ড করার জন্য কোনও কিছু সাজানোর দরকার নেই।’’
নিজের তোলা বিখ্যাত ছবির সঙ্গে নিক উট। ফাইল চিত্র।
১৯৭৩ সালে সারা পৃথিবীর চিত্রসাংবাদিকদের বিচারে সেরা ফোটো নির্বাচিত হয় এই ছবি। কিমের কথা সামনে আসায় নিন্দার ঝড় উঠেছিল সারা বিশ্ব জুড়ে। দেশের মাটিতেও মার্কিন সরকারের ভিয়েতনাম নীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নামেন মার্কিন নাগরিকেরা। যা দেখে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন মার্কিন প্রশাসন ও মার্কিন সেনার কর্তাব্যক্তিরা। নাপাম কন্যা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন কিম। দেশের ভাবমূর্তি তলানিতে পৌঁছে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভিয়েতনাম আগ্রাসনের তীব্রতা কমাতে বাধ্য হয় আমেরিকা। কয়েক বছর পর সাইগনের পতন হয়, থামে ২০ বছর ধরে চলতে থাকা কুখ্যাত ভিয়েতনাম যুদ্ধ। এই কুড়ি বছরে অবশ্য ভিয়েতনাম হয়ে গিয়েছে এমন একটা জায়গা, যেখানে পৃথিবীর মধ্যে সব থেকে বেশি বোমা ফেলা হয়েছে, মাইলের পর মাইল জঙ্গল ধ্বংস হয়ে গিয়েছে, অধিকাংশ চাষ জমি হয়ে গিয়েছে অনাবাদী, প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৩০ লক্ষ সাধারণ মানুষ।
আরও পড়ুন: পাক গোলাবর্ষণে হত মা ও দুই সন্তান
কিন্তু কিমের জীবন থেকে কতটা শিক্ষা নিয়েছে আজকের পৃথিবী? ক্ষমা, ভালবাসা আর আশার কথা শোনার জায়গায় কি আছে আজকের পৃথিবী? এই মুহূর্তের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি কিন্তু সেই কথা বলছে না। এখন সারা পৃথিবী জুড়েই বাজছে যুদ্ধের দামামা। যুদ্ধ চলছে আফ্রিকা, এশিয়ার এক বিরাট অংশে। যুদ্ধের ঘনঘটা আমাদের উপমহাদেশেও। প্রতিদিন প্রাণ যাচ্ছে সাধারণ মানুষের, প্রাণ হারাচ্ছেন জওয়ানেরাও। কিমের কিন্তু আশা— পরিস্থিতি বদলাবে, মানুষ এক দিন প্রতিহিংসা ভুলে হাঁটবে শান্তির পথেই।