—ফাইল চিত্র
কিছু দিন আগেই এক পুরনো পত্রিকায় একটি বিশেষ ছবি নজরে আসে। ১৯৪৩-এর আমেরিকার তদানীন্তন বিখ্যাত কৃষ্ণাঙ্গ সঙ্গীতশিল্পী পল রবসনের এক অনুষ্ঠানের ছবি। ইলিনয়ের এক খ্যাতনামা সৈনিক স্কুলে। ছবিটির বিশেষত্ব ছিল দর্শক সারিতে শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গদের স্পষ্ট ও দৃষ্টিকটু বিভাজন। আমেরিকার বর্ণবৈষম্যের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এটি খুবই অর্থবহ ছবি।
বেশ কয়েক দশক পেরিয়ে এসেছি। নাগরিক অধিকার আন্দোলনের উত্থান, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের হত্যা দেখেও এই একবিংশ শতাব্দীতে কিন্তু আমেরিকা বর্ণবৈষম্যশূন্য হতে পারেনি। ২৫ মে মিনিয়াপোলিস শহরে মধ্যবয়সি কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ পেরি ফ্লয়েডের পুলিশের হাতে হত্যার খবর আজ কারও অজানা নয়। তার পরেই আছড়ে পড়েছে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ঢেউ। শান্তিপূর্ণ ভাবে শুরু হয়েও যা পরে চরম বিধ্বংসী ভূমিকা নেয়। শিকাগোও তার ব্যতিক্রম নয়। হাজার হাজার মানুষের ‘কৃষ্ণাঙ্গদের জীবনও মূল্যবান’ ও ‘ফ্লয়েডের জন্য বিচার চাই’ স্লোগানকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা সরকার বা পুলিশ, কারও ছিল না। এই প্রতিবাদ-মিছিলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন বর্ণ নির্বিশেষে নানা সম্প্রদায়, নানা বয়সের মানুষ।
ঠিক এক সপ্তাহ আগে, গত শনিবার সন্ধ্যা থেকে এই সব বিক্ষোভের জেরে শিকাগো রণক্ষেত্রের রূপ ধারণ করেছিল। শহরের ‘লুপ’ এলাকায় বিচ্ছিন্ন খণ্ডযুদ্ধ থেকে শুরু হওয়া এই বিক্ষোভ দাবানলে পরিণত হতে বেশি সময় নেয়নি। বেশ কিছু জ্বলন্ত পুলিশের গাড়ি খবরের শিরোনামে আসে। শুরু হয় সম্মুখসমর ও তার সঙ্গে চূড়ান্ত অনভিপ্রেত ভাবে চলতে থাকে লুটপাট। শিকাগোর অত্যন্ত বিখ্যাত ‘ম্যাগনিফিসেন্ট মাইল’-এর বেশ কিছু নামি বিপণন কেন্দ্রে ভাঙচুর এবং অবাধ লুণ্ঠন চলছে। রাত ৯টায় জরুরি অবস্থা ঘোষণার পরে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আসে, তবে সারা রাতব্যাপী চলতে থাকে প্রতীকী প্রতিবাদ। অবস্থা আরও সঙ্গিন হয় রবিবার বিকেলে। শিকাগোর দক্ষিণ দিকে প্রতিবাদ মিছিলের পাশাপাশি কিছু অনুপ্রবেশকারী তাল মিলিয়ে লুণ্ঠন আর ভাঙচুর চালাতে থাকে। অসংখ্য প্রতিবাদী গ্রেফতার হন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও লুণ্ঠনের শিকার হয়েছিলেন বেশ কিছু স্থানীয় নিম্নবিত্ত কৃষ্ণাঙ্গ ও কিছু হিসপ্যানিক এলাকার ব্যবসায়ীরা, যাঁদের অনেকেরই বিমা নেই। এই লুণ্ঠনকারীদের পরিচয় নিয়ে অনেক জল্পনার মধ্যেও যা মনে দাগ কেটে যায়, তা হল— বহু প্রতিবাদী মানুষের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব থামানোর আপ্রাণ চেষ্টা।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের কোনও পূর্ব নির্ধারিত গতিধারা থাকে না। এবং সামান্য প্ররোচণাতেই তা ধ্বংসাত্মক আকার ধারণে সক্ষম। শিকাগোর বিক্ষোভে ক্ষতির পরিসংখ্যানকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। কিন্তু যা না-বললেই নয় তা হল— আমেরিকায় পুলিশের ক্রমবর্ধমান বর্ণবৈষম্যমূলক আচরণ বর্তমান মার্কিন সমাজের একটি গুরুতর সমস্যা। আজ এই যুগান্তকারী বিপ্লবে শামিল হওয়া কাতারে কাতারে জনতার লড়াই এক জন ফ্লয়েডের বিচার চেয়ে নয়, তাঁদের বিক্ষোভ বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে। তাঁদের উদ্দেশ্য পুলিশতন্ত্রের সংস্কার সাধন, নাগরিক অধিকার অর্জন এবং এক সমব্যথী সরকারকে ক্ষমতায় আনা। পারিপার্শ্বিক অশান্তি এই উদ্দেশ্যকে আপাতদৃষ্টিতে লঘু করে দিল। শান্তিপূর্ণ ভাবে এই লড়াই বজায় রাখাই আপাতত বিক্ষোভকারীদের মূল লক্ষ্য।
এই প্রসঙ্গে দু’জনের কথা না-বললেই নয়। ডেভিড কোই— একটি ছোট কোরিয়ান খাবার দোকানের কর্তা এবং বৃদ্ধ ডন ফ্লেস— শিকাগোর শতবর্ষ প্রাচীন ঐতিহাসিক ‘সেন্ট্রাল ক্যামেরার’ কর্ণধার। দু’জনই গত শনিবার এই বিক্ষোভের জেরে তাঁদের প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস হতে দেখেছেন, কিন্তু তাঁদের গলায় দোষারোপের বদলে সমবেদনার সুর স্পষ্ট। পুনর্নিমাণের পাশাপাশি তাঁদের লড়াইও চলবে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে।
শিকাগোর রাজপথে আজ অনেক মার্টিন লুথার কিং।
(লেখক সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার)
‘প্রতিবাদ আগেও হয়েছে, এ রকম দেখিনি কখনও’ শীর্ষক সংবাদ প্রতিবেদনের (পৃ ৬, ৬-৬) শিরোনামটি একটি সংস্করণে ভুল ছাপা হয়েছে। অনিচ্ছাকৃত এই ভুলের জন্য আমরা দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।