শেষ মুহূর্তে ভোটের প্রস্তুতি। ব্যালট বাক্স বিতরণের আগে চলছে নথি যাচাইয়ের কাজ। শনিবার ঢাকায়। ছবি: রয়টার্স।
এ বার নির্বাচন নিয়ে বেশ একটা বৈঠকি মেজাজে অনেকে। দেশ জুড়ে এই মেজাজের কথা বলছে সরকারও। ঢাকার গোপীবাগ স্টেশনে শুক্রবার রাতে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়ার ঘটনা নিশ্চিত ভাবেই তাতে টোল ফেলেছে। কিন্তু জনজীবনে এই ঘটনার খুব যে প্রভাব পড়েছে, সাধারণ মানুষ ভারী সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন— একেবারেই তা নয়। বরং এক ভারতীয় সাংবাদিক নাশকতার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তোলায় পঞ্চায়েত নির্বাচনের উল্লেখ করে পশ্চিমবঙ্গকেই ঠেস দিলেন বাংলাদেশের প্রধান নির্বাচন কমিশনার। কাজী হাবিবল আউয়াল বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনে তো ৪২ জন মারা গিয়েছেলেন, তা হলে কি বলতে হবে ভারতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই?”
সকাল থেকে টেলিভিশনে ঢাকার বাইরের উপজেলাগুলিতে একের পর এক নাশকতার খবর। পল্টন মোড়ের একটি দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তা দেখতে দেখতে অবিচল রিকশচালকের ঘোষণা— “রাস্তার মোড়ে মোড়ে বোম ফুটতে দ্যাখসি। এইখানে বাসটা দাঁড়াল, গান পাউডার ঢেলে জ্বালিয়ে দিল— চোখের সামনে। নতুন করে কী ভয় দ্যাখাবা!” উদাসিন দোকানির সংযোজন, “হরতালের দিনে এইটুকু তো করবাই!”
ট্রেনে আগুনের ঘটনায় পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। তবে নিরাপত্তার পাঁচ স্তরের চাদরে মুড়ে ফেলা রাজধানী ঢাকায় এর বেশি নাশকতা ঘটা মুশকিল। ঘটেছে বিভিন্ন উপজেলায়। রবিবারের নির্বাচনে অধিকাংশ ভোটের বুথ হচ্ছে সরকারি স্কুলগুলিতে। ৯টি জেলায় এমন ১৩টি স্কুলে আগুন দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন জায়গায় ৯টি যানবাহন ভাঙচুর হয়েছে। রাজবাড়িতে বুথ পাহারায় মোতায়েন এক গ্রাম-পুলিশের দেহ উদ্ধার হয়েছে। পরিবারের অভিযোগ, তুলে নিয়ে গিয়ে খুন করা হয়েছে তাঁকে। কিন্তু এত কিছুর পরেও, ২০১৪-য় ভোট বানচালে বিএনপি ও জামাতে ইসলামি যে পরিমাণ নাশকতা করেছিল, তার পাশে এ বার তা অনেক কম বলেই জানাচ্ছেন অনেকে। পুলিশের হিসাবে, প্রায় ৭৫৭টি স্কুল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল সে বার। ৫ জানুয়ারি শুধু ভোটের দিনেই নাশকতার বলি হয়েছিলেন ১৮ জন। বিএনপির এক কর্মী পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে শুক্রবার রাতে ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনার পরিকল্পনার খুঁটিনাটি প্রকাশ করেছে। এর পরে কয়েক জন নিচুতলার কর্মীর পাশাপাশি মহানগর বিএনপির এক নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান থেকে মুখ্য নির্বাচন কমিশনার— সকলেই শনিবার শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু ভোটের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বিশেষ বাহিনী র্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশিদ হোসেন জানিয়েছেন, ভোটারদের বাধা দেওয়া বেআইনি। কেউ সে চেষ্টা করলে কঠোর ভাবে দমন করা হবে। একই সঙ্গে, ভোটারদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা হয়েছে। বার্তা, ভোটাররা শুধু দয়া করে ভোটটি দিয়ে যান। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী আউয়াল জানিয়েছেন, সুষ্ঠু ভাবে নির্বাচন করার জন্য তাঁরা সব রকম বন্দোবস্ত করেছেন। দেশবাসী এ বার ভোট দিয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটির নিরবচ্ছিন্নতা বজায় রাখুন। অর্থাৎ, বল এ বার ভোটারের কোর্টে।
ব্যারিকেড ও অস্থায়ী চেক পোস্টে ছেয়ে দেওয়া হয়েছে শনিবারের ঢাকাকে। সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তোপখানা রোডে নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিল বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাইফুল হকের নেতৃত্বে ১৩ জনের একটি ‘মিছিল’। এর পরে ‘জনসভা’য় বিএনপি-র ‘সমমনা’ বক্তারা ঠিক সেই সেই কথাগুলি বললেন, আগের দিন বিএনপি যা বলে গিয়েছে। ‘ডামি ভোটার দিয়ে ডামি নির্বাচন’-এর শব্দবন্ধটিও অবিকল। পথচলতি মানুষের মন্তব্যে স্পষ্ট, মরমে পশছে না তাদের এই ভোট বয়কটের ডাক। প্রেস ক্লাবের গেটে পাহারায় থাকা পুলিশও জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুনতে শুনতে চোখ বুজে আরামে দাঁত খুঁচিয়ে চলেছেন খড়কে কাঠি দিয়ে।
ঠিক কত শতাংশ ভোট রবিবার পড়লে সন্তুষ্ট হবেন? প্রশ্ন করা গিয়েছিল শাসক দলের এক প্রভাবশালী তরুণ নেতাকে। হিসাবে মোট ভোট থেকে বিএনপি, জামাত, অলস ভোটারদের বিয়োগ করে তার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সমর্থক, অসাম্প্রদায়িক এবং উন্নয়নের ভুক্তভোগী শ্রেণির ভোটকে যোগ-গুণ-ভাগ করে জানালেন ৩৫ থেকে ৪০% ভোটারের উপস্থিতিকেই ডিস্টিংশান বলে ধরবেন তাঁরা। তার উপরে হলে ভাল, তবে টেনেটুনে পাশমার্ক ৩০%।
বাংলাদেশের ‘গণতন্ত্র’-এর পরীক্ষা রবিবার সকাল ৮টা থেকে, আর রিপোর্ট কার্ড পরদিন সকালের মধ্যেই। কারণ, এ দেশে ভোট শেষ হওয়ার পরেই বুথে বুথে শুরু হয়ে যায় ব্যালট গোনা।