জেমস বন্ডের প্রিয় অ্যাসটন মার্টিন গাড়ির সঙ্গে শন কনরি। ১৯৬৫-তে । ছবি: টুইটার
তাঁর মতো রিভলভার তাক করতে পারতেন না কেউ। বাহুলগ্না নায়িকার দিকে থেকে বিন্দুমাত্র নজর না-সরিয়ে দুষ্টু লোককে গুলি চালিয়ে উড়িয়ে দেওয়াতেও তাঁর জুড়ি মেলা ছিল ভার। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ঝুলিয়ে রেখে যখন বলতেন, ‘দ্য নেম ইজ় বন্ড, জেমস বন্ড’, হৃদ্স্পন্দন থেমে যেত মেয়েদের। হয়তো ছেলেদেরও।
কাল রাতে বাহামাসের রাজধানী নাসাউয়ে তাঁর নিজের বাড়িতে ঘুমের মধ্যে মারা গিয়েছেন সেই আদি ও অকৃত্রিম বন্ড— শন কনারি। গত তিন বছর এই ক্যারিবীয় দ্বীপেই নিরবচ্ছিন্ন অবসরযাপন করছিলেন স্কটিশ অভিনেতা। সেখানেই গত অগস্ট মাসে ৯০ বছরের জন্মদিন পালন করেছিলেন। আজ স্কটল্যান্ডের ফার্স্ট মিনিস্টার নিকোলা স্টার্জন এই খবর জানিয়ে টুইট করেন, ‘‘দেশের অন্যতম প্রিয় সন্তান চলে গেলেন।’’
এডিনবরার বস্তি থেকে হলিউডের খাস অলিন্দ ঘুরে বাহামাসের বিলাসবহুল ভিলা— চমকপ্রদ শনের জীবনাখ্যান। ‘শন’ হিসেবে অবশ্য তাঁর পরিচিতি অনেক পরে। অতলান্তিক পেরিয়ে হলিউড মাতানোর আগে তিনি ছিলেন নেহাতই এক ‘টমি’।
টমাস শন কনারির জন্ম ১৯৩০-এর ২৫ অগস্ট, এডিনবরার ফাউন্টেনব্রিজ এলাকার এক খুপরি অ্যাপার্টমেন্টে। মা এফি ছিলেন সাফাইকর্মী, আর বাবা জো লরিচালক। একটা ভাগের বাথরুম, যার দাবিদার আরও দু’টি পরিবার। সদ্যোজাতের জন্য আলাদা খাট কেনার সামর্থ্য ছিল না মা-বাবার। তাই কাঠের দেরাজের নীচের তাকে বিছানা পেতে ব্যবস্থা হয়েছিল ছোট্ট টমিকে শোয়ানোর। ‘ছোট্ট’ টমি অবশ্য কয়েক বছরেই দিব্য মাথাচাড়া দেয়। তার যখন আট বছর বয়স, বাড়িতে আর এক সদস্য এল— ভাই নীল। সংসারে বাড়ল আরও অনটন। ফলে ১১ বছর বয়সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দুধ বেচা শুরু করে দিল টমাস।
মানুষ হিসেবে কেমন ছিলেন এই তুখোড় অভিনেতা, তা বুঝতে সাহায্য করবে তাঁর এই কঠিন ছেলেবেলা। যখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে, এক লক্ষ পাউন্ড ফি হাঁকতেন সিনেমা-পিছু, আবার চোখের পলক না-ফেলে দান করে দিলেন ৫০ হাজার পাউন্ড, কখনও স্কটিশ স্কুল কমিটিকে, কখনও বা ব্রিটিশ ফুটবল সোসাইটিকে। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘‘ছোটবেলায় কখনও ভাল করে স্নান করিনি। একটা বাথটব ছিল বহু দিনের শখ। এখন যখন বাথটবে ডুবে বসে থাকি, মনে হয়, যেন স্বর্গের সুখ উপভোগ করছি।’’
যখন ২৩ বছর বয়স, এক বন্ধুর পাল্লায় পড়ে গিয়েছিলেন লন্ডনে, ‘মিস্টার ইউনিভার্স’ প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে। ছোটখাটো একটা খেতাবও জুটে গিয়েছিল— লম্বা ছেলেদের ক্যাটেগরিতে তৃতীয় স্থান। কিন্তু এই প্রতিযোগিতাই তাঁর জীবনের মোড় পাল্টে দিল।
৬ ফুট দু’ইঞ্চির টমাসকে মনে ধরেছিল এক মিউজ়িক্যাল নির্মাতার। ‘সাউথ প্যাসিফিক’ নামের সেই মিউজ়িক্যালে কোরাসে গলা মেলানোর সুযোগ দেওয়া হয় কনরিকে। দুধ বিক্রি বা ছোটখাটো কাজ করে যা রোজগার হত, মঞ্চে অর্থপ্রাপ্তিটা তার কিঞ্চিৎ বেশি বলেই নাটকের দলের সঙ্গে জুড়ে যান স্কটিশ যুবক। আর তখনই নামের প্রথম অংশ ছেঁটে ফেলে হয়ে যান— শন কনারি।
ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলস ঘুরে ঘুরে নাটক করার সময়ে শনের সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব হয় আমেরিকান এক মঞ্চাভিনেতা রবার্ট হেন্ডারসনের। তাঁর থেকে বয়সে বেশ কিছুটা বড় এই রবার্টই শনের হাতে তুলে দেন সাহিত্য নামে জাদুকাঠিটি। ‘‘জর্জ বার্নার্ড শ, অস্কার ওয়াইল্ড, হাইনরিখ ইবসেন, ইংরেজি ভাষায় বা অনুবাদে যা পেতাম, গোগ্রাসে গিলতাম। নাটকের অভিনয় না-থাকলে চলে যেতাম স্থানীয় লাইব্রেরিতে। বই যে মানুষের জীবন পাল্টে দিতে পারে, তার সব থেকে জ্বলন্ত উদাহরণ আমি’’— বলেছিলেন কয়েক বছর আগে।
এর পরে আরও কয়েকটি নাটক, আর টিভিতে ছোটখাটো কিছু রোল। তার পরে সেই দিন— ৩১ মার্চ ১৯৫৭। ‘রিকুয়েম ফর আ হেভিওয়েট’ নামে বিবিসি-র এক সিরিজ়ে প্রৌঢ় বক্সারের ভূমিকায় টিভি পর্দায় মুখ দেখানোর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সিনেমার একাধিক অফার। ১৯৬১-র ‘আনা কারেনিনা’য় ভ্রনস্কি-রূপী কনরিকে দেখে হলিউডের এক প্রযোজকের মনে হয়, ইয়ান ফ্লেমিংয়ের ০০৭কে রুপোলি পর্দায় তুলে ধরতে পারবেন ইনিই। ১৯৬২তে মুক্তি পায় প্রথম বন্ড-ছবি ‘ডক্টর নো’।
যে জেমস বন্ড হিসেবে তাঁর সব থেকে বেশি নামযশ, পাঁচটি ছবির পরে সেই বন্ড সিরিজ থেকে স্বেচ্ছাবসর নেন শন। পরে অবশ্য আরও দু’টি ছবিতে বন্ড হয়েছেন তিনি। বন্ড সিরিজ় থেকে সরে আসার কারণ হিসেবে বলেছিলেন, ‘‘আমি যে বোকাহাবা বা বুড়ো, সব ধরনের চরিত্রেই অভিনয় করতে পারি, তা নিজের বোঝা খুব দরকার ছিল।’’ ১৯৭৫-এর ‘দ্য ম্যান হু উড বি কিং’ থেকে শুরু করে ২০০৩-এর ‘দ্য লিগ অব এক্সট্রাঅর্ডিনারি জেন্টলমেন’, বন্ডের বাইরে তাঁর অভিনয়ের পরিধি বহু দূর বিস্তৃত। চৌকস ব্রিটিশ এজেন্টের মতোই মনোগ্রাহী ‘এনট্র্যাপমেন্ট’-এর ‘রবার্ট ম্যাকডুগাল’, ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য লাস্ট ক্রুসেড’-এর ‘ডক্টর হেনরি জোনস’ বা ‘রবিন অ্যান্ড মারিয়ান’-এর ‘রবিন হুড’।
অভিনেত্রী ডায়ান সিলেন্টোর সঙ্গে প্রথম বিয়ে টিঁকেছিল বছর নয়েক। তার পরে নামী গল্ফার ও মরোক্কান শিল্পী মিশেলিন রকব্রুনের সঙ্গে বিয়ে ১৯৭৫-এ। গল্ফ কোর্স থেকে অস্কারের রেড কার্পেট, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁদের আলাদা করতে পারেনি কেউ।
কয়েক দশক ধরে হলিউড দাপিয়ে বেড়ালেও তাঁর স্কটিশ শিকড় কখনও ভুলে যাননি কনরি। স্কটিশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন, প্রতি মাসে ৫ হাজার পাউন্ড অনুদান দিতেন তাদের। এই দলেরই চাপে কনরিকে ২০০০ সালে নাইটহুড দিতে একপ্রকার বাধ্য হন রানি দ্বিতীয় এলিজ়াবেথ।
২০০৪-এ যখন স্বাধীনতার দাবিতে গণভোট দিচ্ছেন স্কটেরা, একটি উত্তর-সম্পাদকীয়তে কনারি লিখেছিলেন, ‘‘নতুন দেশ গড়ার মতো আনন্দের আর কিছুই নেই।’’ আমৃত্যু ডান হাতে এঁকে রেখেছেন ‘ফরেভার স্কটল্যান্ড’ ট্যাটু। বলেছেন বহু বার, ‘‘নিজের অম্তরাত্মা থেকে বিচ্ছিন্ন হইনি কখনও। তাই তো এত ভাল অভিনয় করে যেতে পেরেছি।’’