সাতে পা দিল এই পুজো। একটু একটু করে নাচ-গান-আবৃত্তি-যন্ত্রসঙ্গীতের মহড়া দিয়েছে বাচ্চাগুলো।
দক্ষিণ লন্ডনে ভোরবেলা কিচ্ছুটি দেখা যায় না। ঘন কুয়াশা, আর আকাশে শুক্লাপঞ্চমীর বাঁকা চাঁদ নিয়ে সকাল শুরু হয় আর পাঁচটা দিনের মতোই। কিন্তু আজ যে বিশেষ দিন। ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশনের কচিকাঁচাদের বসন্ত উৎসবের সময়।
সাতে পা দিল এই পুজো। একটু একটু করে নাচ-গান-আবৃত্তি-যন্ত্রসঙ্গীতের মহড়া দিয়েছে বাচ্চাগুলো। নাচের কঠিন স্টেপ আয়ত্ত করে নিয়েছে অনায়াসে— একটি দু’টি রিহার্সালেই। ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘টুনটুনি’ আর ‘রাজার গপ্পো’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘নিবেদিতা’ নাটকের পর এ বারের থিম ‘মিলে সুর মেরা তুমহারা’— ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের সঙ্গীতের সুরে হাসবে গাইবে ওরা।
সরস্বতীও তো সর্বজনীন। তাই বেশ ক’টি তামিল ও মরাঠি পরিবার সামিল হয়েছে এই পুজোয়। এ সময় নতুনে অবগাহনের সময়। বসন্ত উৎসবও তো সেই নতুনেরই অঙ্গ। প্রবাসীদের কাছে বসন্ত মানে কৃষ্ণ আর রাধাচূড়া ফুল। জারুলের বেগুনি ফুল। শিমুল পলাশের মাথায় লাল আগুনের মুকুট! আমের গাছে কচি সবুজ সবুজ পাতা গজিয়ে উঠত। কুঁড়ি আসত। হলুদ শাড়ি-জামায় ছেলেমেয়েরা কেমন গাঁদাফুলের অঞ্জলি দিত। গোটা সেদ্ধ, কুলের অম্বল, খিচুড়ি অথবা জোড়া ইলিশের সুগন্ধে ভরে উঠত বাঙালির হেঁসেল!
লন্ডনে সে সব কোথায়! তবু আমরা নতুন ভাবে গড়ে তুলি বসন্ত উৎসবকে। এখানেও ড্যাফোডিল একটু করে মাথা তোলে, ক্যামেলিয়ার কুঁড়ি যেন চোখ মেলে চায়। টিউলিপের সারা শরীরে শিহরণ আসে বসন্ত আসছে বলে। আমরা যেন শীতকালের অনন্ত ঘুমের লেপের ওম ছেড়ে বেরিয়ে আসি। মেয়েরা মিলে নাড়ু বানাই আগের দিন সারা সন্ধে ধরে। ফলপ্রসাদ কুটি, মায়ের আসল ভোগে থাকে খিচুড়ি, পাঁচ রকম ভাজা, বাঁধাকপি, পাঁচমিশালি তরকারি, চাটনি, মিষ্টি, নলেন গুড়ের পায়েস। দেশি দোকানের নলেন গুড় সে রকম ভাল নয়। তাই যাঁরা ক্রিসমাসের ছুটিতে কলকাতা যায়, তাঁদের উপরই ভরসা করতে হয়।
পুরোহিতের ক্রাইসিস এই সময় সব দেশে। ছোটবেলায় সাইকেল করে যাওয়া ‘পুরুত’দের থামাত দাদা-কাকারা। একটু ফুল ‘ফেলে যাওয়া’র আর্ত অনুরোধ। বাড়ির ছেলেপুলেগুলো যে না খেয়ে বসে রয়েছে! অঞ্জলি না দিলে খাবে কী করে? এ রকম এক ‘পুরুত’ বাগদেবীকে বলেছিলেন বাগদা দেবী। ঠাকমা বলেছিল, ‘‘ও ঠাকুরমশাই, বাগদেবীকে বাগদাদেবী কও ক্যান?’’ ঠাকুরমশাই একটুও অপ্রতিভ না হয়ে বলেছিলেন, ‘‘ঠাকুমা যেমন পয়সা দেবেন, তেমনই তো মন্তর হবে?’’
এখানে অবশ্য পুরোহিত মশাই বড় ভাল, বিদ্বান মানুষ। শুধু মন্ত্র বলেন না, বুঝিয়ে দেন মন্ত্রের মানে। পুঁচকি মেয়েটা ছোট্ট শাড়ি পরে গুটি গুটি পায়ে এগোয় হাতেখড়ির জন্য। সেই রামখড়ি আর শ্লেটের বদলে আসে ম্যাগনেটিক ভ্যানিশিং স্লেট। পুরোহিত মশাই সযত্নে লিখিয়ে দেন, ‘অ আ ই...’। কিন্তু নিভৃতবাসিনীর যে নির্বাসন ঘটে গিয়েছে এত দিনে বাংলাভাষা থেকে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা আজ ব্রাত্য।
শুধু লন্ডন নয় কলকাতাও বড় ব্যতিক্রম নয় এ ব্যাপারে। কিন্তু আমরা যে আজীবন বাঙালি। আমরা বাংলায় গান গাই। তবু চাই বাংলা থাকুক আমাদের জীবনযাপনে, নিদ্রিত বা জাগ্রত অবস্থায়। আমাদের দু’বেলার খাবারের থালায়, সন্ধের টিভি-শোতে অথবা গল্পের বইতে। জানি, শপিং মলে আর ধুলোধোঁয়ায় চেনা জগৎটা ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছে। তবু আমরা ভুলি না সেই গরম কালের নিঝুম দুপুরে বাসনওলার ডাক, শিলকাটাইইই... অথবা গাড়ির আইসক্রিমওলার কথা। রোজ ভোরবেলা রাইকমলের ‘রাধে... রাধে’ সুরে ঘুমভাঙানিয়া গানের কথা! নিমের হাওয়ায় স্বপ্ন ভাসে, তাতে রূপনারায়ণ নদীর গন্ধ লেগে থাকে। আমরা প্রবাসীরা এ ভাবে কাটিয়ে দিই একটা গোটা জীবন। শুধু স্বপ্ন দেখতে দেখতে। যত বয়স বাড়ে তত মন শুধু স্বপ্ন দেখতে চায়। এক দিকে অতীতের স্বপ্ন আর এক দিকে ভবিষ্যতের মাঝখানে আমাদের বর্ত্তমানটুকু পিষে যায় কাজের চাপে, সন্তানদের জন্য চিন্তা-ভাবনায়।
এ ভাবেই পরবাসে আমাদের ছোট ছোট বাচ্চারা বড় হয়ে ওঠে। আমাদের যৌথ পরিবারও একটু একটু করে বড় হয়। নতুন অনেক মানুষ আসে আমাদের সঙ্গে, আমরা একসঙ্গে হাসি, কাঁদি, আনন্দ করি। এ ভাবেই এগিয়ে চলে আমাদের গল্প। মনেই হয় না এত দূর দেশে রয়েছি। ভুবনহাটে ঘরের দেওয়াল, জানলাকপাট হাতড়ে বেড়াই। ক্রয়ডন বেঙ্গলি কানেকশন আমাদের কাছে এক অলৌকিক দ্বীপ।