এখনও আমার কাছে সাহায্য চেয়ে ফোন আসছে। এখনও বিভিন্ন শহরে ভারতীয়-সহ একাধিক পডুয়া আটকে রয়েছে। আমি তাদের বলেছি, অপেক্ষা করতে। ইউক্রেন সরকারের তরফে ফের কোনও ব্যবস্থা করলে তবেই বার হতে। এর কারণ, আকাশপথে যে কোনও সময়ে হানা হতে পারে।
ছবি রয়টার্স।
প্রায় দু’দশক ধরে ইউক্রেনে রয়েছি। যে দেশের মানুষ আমাকে দীর্ঘদিন ধরে ভালবাসা ও সম্মান দিয়েছেন, আজ প্রথম সুযোগে সেই দেশ ছেড়ে চলে গেলে নিজের ও তাঁদের কাছে ছোট হয়ে যাব। তা ছাড়া, শিক্ষক ও চিকিৎসক হিসাবে আমার কিছু দায়িত্ব রয়েছে। সেই দায়িত্ব থেকেই পড়ুয়াদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া।
যুদ্ধ যে হবে, তা ১৬ ফেব্রুয়ারিই মোটামুটি আন্দাজ করা গিয়েছিল। আমেরিকান গোয়েন্দাদের কাছ থেকে খবর এসেছিল— যুদ্ধ আসন্ন। ইউক্রেনের সমস্ত সংবাদমাধ্যমে ছাপা হয়েছিল সেই খবর। সঙ্গে সঙ্গেই আমি আমার পরিচিত পড়ুয়াদের বলে দিয়েছিলাম, তারা যেন যত শীঘ্র সম্ভব দেশে ফিরে যায়। এখানকার গোয়েন্দা দফতরও আভাস দিচ্ছিল, যুদ্ধ হতে পারে। তখনও ‘ইভ্যাকুয়েশন’ শুরু হয়নি। তখনই জানা যায়, বিমানের টিকিটের মূল্য আকাশছোঁয়া। প্রায় সত্তর-আশি হাজারে বিকোচ্ছে দেশে ফেরার টিকিট। তখন কিছু ছাত্র-ছাত্রী আমাকে বলেছিল— “দাদা, এখন তো ভীষণ দাম। ২৪ তারিখ দেখাচ্ছে ২৪ হাজারের মতো। তখনকার টিকিটই কাটছি তা হলে।” তাদের বলেছিলাম ‘‘ঠিক আছে’’। তখনও আন্দাজ করতে পারিনি পরিস্থিতি এত দ্রুত, এত ভয়াবহ হয়ে যাবে।
তার পরে ২৪ ফেব্রুয়ারি রাত বারোটার সময় আমার কাছে একটা ফোন এল। ফোনটা করেছিল টার্নোপিল ন্যাশনাল মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটির কিছু পড়ুয়া। তারা জানায়, কিভ বিমানবন্দরে তাদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। টনক নড়ে আমার। খোঁজ-খবর নিতে শুরু করি। আর ওই পড়ুয়াদের বলি— ‘‘তোমরা কিভ শহরে একটা হস্টেল নিয়ে নাও।’’ তার পরে ভোর চারটের সময়ে আর একটি ফোন আসে। জানতে পারলাম একটি বাস ভর্তি ভারতীয় পড়ুয়াকে কিভ শহরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। কিভের আগের শহরে আটকে রয়েছে তারা। তার পরেই ভোর পাঁচটার সময়ে এখানকার গোয়েন্দা দফতর সূত্রে খবর পাই— যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তাঁরা শুধু বলেছিলেন... ‘ওয়ার!’। খোঁজ খবর করে জানতে পারি, বেলারুস সীমান্ত থেকে কিভ বিমানবন্দর এলাকায় বেশ কিছু শেলিং হয়েছিল। তাই হঠাৎ করে ওই নিরাপত্তা।
আমি অবশ্য একেবারে প্রস্তুত ছিলাম না যে, তা নয়। ২১ তারিখেই কিছু চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল ও নুন কিনে রেখেছিলাম। যাতে কিভে থাকা পড়ুয়াদের সাহায্য করতে পারি। তা ছাড়া, সকলকেই সতর্ক করে বলেছিলাম, অন্তত দু’সপ্তাহের খাবারের জোগাড় করে রাখতে।
২৪ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধ শুরু হলে আমি পড়ুয়াদের সীমান্তে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা শুরু করি। ইউক্রেনীয় বাসের চালকেরা নিজেরা ভয় পেলেও প্রাণ হাতে করে আমাদের সাহায্য করেছেন। মূলত তিনটি পথে পড়ুয়াদের সীমান্তে পাঠানো হচ্ছে। বাসে করে, চের্নিভৎসি থেকে রোমানিয়ার সীমান্ত মাত্র ৩০-৪০ কিলোমিটার দূরে। অথবা তারা বাসে করে যাবে লিভিভ, যেখান থেকে কাছেই পোল্যান্ডের সীমান্ত। অথবা তারা যাবে উজগোরো থেকে চপ বলে একটা শহরে, সেখান থেকে জোহানিভে। সেখান থেকে কাছেই হাঙ্গেরির সীমান্ত। এ ছাড়া বেশ কিছু পড়ুয়াদের কিভে রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ট্রেনে তুলে দিচ্ছি। আপাতত আমার কাছে যারা সাহায্য চেয়েছিল, তাদের সকলকেই নিরাপদে সীমান্তে পৌঁছে দিয়েছি। সংখ্যাটি ৩৫০ জনেরও বেশি। তাদের মধ্যে প্রায় ১৫০ জনের বেশি ভারতীয় পড়ুয়া। কম পক্ষে ৫০ জনের কাছাকাছি বাঙালি।
এখনও আমার কাছে সাহায্য চেয়ে ফোন আসছে। এখনও বিভিন্ন শহরে ভারতীয়-সহ একাধিক পডুয়া আটকে রয়েছে। আমি তাদের বলেছি, অপেক্ষা করতে। ইউক্রেন সরকারের তরফে ফের কোনও ব্যবস্থা করলে তবেই বার হতে। এর কারণ, আকাশপথে যে কোনও সময়ে হানা হতে পারে। চেচনিয়া জঙ্গিরা আক্রমণ করতে পারে। এই অবস্থায় মাথা ঠান্ডা করে পদক্ষেপ করতে হবে। এখনও পশ্চিমের শহরগুলো পুরোপুরি নিরাপদ। যদিও সেখানে থাকার জায়গার ভীষণ অভাব। প্রায় এক কোটি ইউক্রেনীয় দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছে, যদিও ওদের সংবাদমাধ্যম বলছে সংখ্যাটি লক্ষের ঘরে। এই সমস্ত দেশবাসী ভিড় করেছে বা পার হয়েছে পশ্চিমের শহরগুলি দিয়ে। ফলে ওখানে এখন প্রবল ভি়ড়। তাও বলব, তুলনায় পশ্চিমের শহরগুলি এখনও নিরাপদ।
যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি যেমন হয়, কিভের অবস্থা এখন ঠিক তেমন। চারপাশ নিশ্চুপ। রাস্তায় সাধারণ মানুষ একেবারেই নেই। সশস্ত্র সেনা ঘুরছে রাস্তায় রাস্তায়। কার্ফু চলছে বিকেল পাঁচটা থেকে সকাল আটটা পর্যন্ত। এ ছাড়াও, দিনের বেলা যদি কোনও প্রয়োজনে বেরোতে হয় তা হলে নিজের বাসস্থানের আশপাশের জায়গা থেকে বেশি দূরে যাওয়ার নিয়ম নেই। যেতে চাইলে সঙ্গত কারণ দেখাতে হবে। আর অন্য শহরে যাওয়ার তো কোনও প্রশ্নই নেই। শহর জুড়ে নানা সঙ্কট। পেট্রল নেই, ওষুধের পর্যাপ্ত জোগান নেই। ইউক্রেনীয়রা খুব পাঁউরুটি খেতে ভালবাসে, তাও নেই পর্যাপ্ত। খাবার দোকানের সামনে লম্বা লাইন। এটিএমে টাকা না থাকায় আর্থিক সমস্যাও হচ্ছে। আপনার কাছে ডলার থাকলেও আপনি তা দিয়ে কিছু করতে পারবেন না, কারণ যথাযথ মূল্য পাবেন না। তবে, সম্প্রতি এখানকার কিছু কিছু দোকান একটা ব্যবস্থা করেছে, যদি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে টাকা থাকে তা কার্ডের মাধ্যমে দোকানের অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করলে দোকানটি নগদ টাকা দিচ্ছে। ফলে একটু সাহায্য হচ্ছে শহরবাসীর। আসলে এখানে প্রত্যেকে প্রত্যেককে সাহায্য করছেন। প্রতি ইউক্রেনীয়ই এখন দেশের সৈনিক।
নিজেকে নিয়ে তো উৎকণ্ঠা রয়েছেই। কিন্তু কোথাও গিয়ে সব ছাপিয়ে ওঠে দায়িত্ববোধ। বাবা-মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়, তাঁরা দুশ্চিন্তা করছেন। তাঁদের দুশ্চিন্তা করতে বারণ করি। বলি, আমি ঠিক সামলে নেব। যে দেশে এত দিন রয়েছি, বিপদে সে দেশকে ফেলে রেখে যেতে ইচ্ছা হয় না।
অনুলিখন: শ্রেয়া ঠাকুর
লেখক একজন চিকিৎসক